ঢাকা,বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪

পেকুয়ায় ৪০ দিনের কর্মসংস্থান কর্মসূচীতে লুটপাঠের মহোৎসব!

durnitiমুহাম্মদ গিয়াস উদ্দিন, পেকুয়া :::

কক্সবাজারের পেকুয়া উপজেলায় সরকারের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় কর্তৃক চলমান অতি দরিদ্রের জন্য কর্মসংস্থান কর্মসূচী (ইজিপিপি) এর প্রকল্প বাস্তবায়নে সীমাহীন অনিয়ম, দূর্নীতি ও সরকারী অর্থ লুটপাটের মহোৎসব চলছে। দায়সারাভাবে প্রকল্পের কাজ চললেও তা যেন দেখা কেউ নেই! সংশ্লিষ্ট দফতরের কর্মকর্তাদের প্রকল্প তদারকীতে চরম গাফিলতির কারণেই এসব অনিয়ম হচ্ছে বলে স্থানীয়রা অভিযোগ করেছেন।

 পেকুয়া উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ২০১৫-১৬ অর্থ বছরে ২য় পর্যায়ে অতি দরিদ্রের জন্য কর্মসংস্থান কর্মসূচী বাস্তবায়নের উপজেলার সাত ইউনিয়নে ২৬ প্রকল্পের বিপরীতে ৮৩ লাখ ২৮ হাজার টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। এসব প্রকল্পের কাজ বাস্তবায়নের জন্য সাত ইউনিয়ন থেকে পুরুষ শ্রমিক ৭৭১ জন ও মহিলা শ্রমিক ২৭০ জন নিয়োগ করা হয়। গত মাসের ৭ এপ্রিল থেকে পেকুয়া উপজেলার সাত ইউনিনের এ কর্মসূচীর কাজ শুরু হয়। গতকাল ১ জুন পর্যন্ত ৪০ দিনের মধ্যে ২০ দিনের কাজ দায়সারাভাবে বাস্তবায়ন হয়েছে। এবং প্রত্যেক ইউনিয়নের কাজ চলাকালীন তদারকীর জন্য সাত জন টেগ অফিসার নিয়োগ দেওয়া হয়। সাত ইউনিয়নের মধ্যে পেকুয়া সদরে উপজেলা কৃষি অফিসার এইচ, মনিরুজ্জামান রব্বানী, মগনামা ইউনিয়নে উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. মাহফুজুর রহমান, উজানটিয়া ইউনিয়নে কর্মসংস্থান কর্মসূচী পেকুয়া উপজেরা সুপার ভাইজার মাহফুজ, রাজাখালী ইউনিয়নে একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্পের উপজেলা সমন্বয়কারী সেলিমুল হক, বারবাকিয়া ইউনিয়নের উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা হাসান মুরাদ চৌধুরী, শিলখালী ইউনিয়নের পেকুয়া এলজিইডির উপসহকারী প্রকৌশলী হারুর কুমার পাল ও টইটং ইউনিয়নে উপজেলা সমবায় কর্মকর্তা ওসমান গণিকে প্রকল্পের কাজ চলাকালীন তদারকীর জন্য দায়িত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু এসব কর্মকর্তারা কর্মসৃজন কর্মসূচীর কাজ শুরু হওয়ার পর থেকে সরকার নির্দেশিত দায়িত্ব পালনে চরম অবহেলা প্রদর্শন করছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।

 খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত মাসের ৭ এপ্রিল কর্মসংস্থান কর্মসূচীর কাজ শুরুর পর থেকে শিলখালী ইউনিয়নের দায়িত্বপ্রাপ্ত টেগ অফিসার হারু কুমার পাল একদিনের জন্য শিলখালী ইউনিনের প্রকল্প পরিদর্শন করতে যায়নি। একইভাবে মগনামা ইউনিয়নের দায়িত্বপ্রাপ্ত টেগ অফিসার মাহফুজুর রহমানও পরিদর্শন করেনি। বারবাকিয়া ইউনিয়নের উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার হাসান মুরাদ চৌধুরীকে দায়িত্ব দেওয়া হলেও তিনিও প্রকল্পের কাজ পরিদর্শনে যায়না। এসব কর্মকর্তারা শুধু প্রকল্প কমিটির লোকজনের প্রস্তুত করে দেওয়া মাষ্টাররোলে স্বাক্ষর দিয়েই তাদের উপর অর্পিত সরকারী দায়িত্ব পালন করছেন!

 গতকাল ১ জুন পেকুয়া উপজেলার মগনামা ইউনিয়ন, টইটং ইউনিয়ন, শিলখালী ও বারবাকিয়া ইউনিয়নের বিভিন্ন প্রকল্প পরিদর্শনকরে কর্মসংস্থান প্রকল্পে নিয়োজিত শ্রমিকদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, টেগ অফিসাররা কোন দিন তাদের প্রকল্পে পরিদর্শন করতে আসেনি। এমনকি টেক অফিসার কারা তাও তারা জানেনা। অন্যান্য ইউনিয়নেও একই অবস্থা। অথচ, দূর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রণীত মাঠ পর্যায়ের কর্ম সহায়ক নির্দেশিকা বইয়ের ৩.৩ এর ঘ অনুচ্ছেদে সু-ষ্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে, ট্যাগ অফিসারগণ প্রকল্প বাস্তবায়ন এবং মজুরি পরিশোধ তদারক করবেন। কিন্তু পেকুয়ার ক্ষেত্রে তার চিত্র ভিন্ন। এখানে গত ২০ দিন ধরে সাত ইউনিয়নের জন্য নিয়োগকৃত টেক অফিসারগণ প্রকল্প পরিদর্শন না করে অফিসে বসেই বিলে সই-স্বাক্ষর করছেন। মাঠ পর্যায়ে প্রকল্পের সুষ্টু তদারকী না থাকার কারণে সংশ্লিষ্ট প্রকল্প কমিটি গুলো অনুপস্থিত শ্রমিকদের নামে বিল তৈরী করে সুকৌশলে ব্যাংক থেকে দৈনিক মজুরী উত্তোলন করে নিচ্ছেন।

 সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, রাজাখালী ইউনিয়নের উলুদিয়া রাস্তার মাথা থেকে আরব শাহ বাজার পর্যন্ত মেইন রোডের সাইড ভরাট, কাঞ্চন পাড়া রাস্তার সাইট ভরাটসহ আরো কয়েকটি প্রকল্পে ১০০জন শ্রমিক প্রকল্প চলাকালীন কাজ করার কথা থাকলেও নিয়মিত এখানে কাজ করছেন ৬০-৭০ জন শ্রমিক। প্রকল্পের কাজ চলাকালীন এসব প্রকল্পে নিয়মিত ৩০ জনেরও অধিক শ্রমিক কাজে অনুপস্থিত থাকলেও তাদের বিল ব্যাংক থেকে উত্তোলন করা হয়। একাধিক নির্ভরযোগ্য সুত্রে জানা গেছে, প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা প্রকল্পের কাজ চলাকালীন অনুপস্থিত শ্রমিকদের মাষ্টাররোলে উপস্থিত দেখিয়ে টেগ অফিসারদের কাছ থেকে বিলে স্বাক্ষর হাতিয়ে নেন। পরে অনুপস্থিত শ্রমিকদের দৈনিক মজুরীর টাকা প্রকল্প কমিটির লোকজন ভাগাভাগি করে নেন।

 মগনামা ইউনিনের ৫ ও ৬ নং ওয়ার্ড়ের ৩টি প্রকল্পে নিয়মিত শ্রমিক থাকার কথা ৬৬ জন। সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, এ ওয়ার্ড়ের প্রকল্প সমূহে নিয়মিত কাজ করছেন ৩০-২৫ জন শ্রমিক। অর্ধেক শ্রমিক কাজে অনুপস্থিত থাকলেও মাষ্টার রোলে উপস্থিতি দেখিয়ে মজুরীর টাকা ব্যাংক থেকে উত্তোলন করা হচ্ছে। মগনামা ইউনিয়নের ৬ নং ওয়ার্ড়ের নারী শ্রমিক ইয়াসমিন আলম জব কার্ড নং ৯৯, মাহমুদুল করিম জব কার্ড ১০০, রবি আলম জব কার্ড নং ১০৮, জসিম উদ্দিন জব কার্ড নং ১০৯, শাহাজাহান জব কার্ড নং ১১২, আবদু জব্বার জব কার্ড ১০৬সহ আরো কয়েকজন শ্রমিক কাজ শুরু হওয়ার পর থেকে একদিনও প্রকল্পের কাজে যোগদান করেনি। কাজ না করলেও ওই প্রকল্পের সাথে সংশ্লিষ্টরা মাষ্টার রোলে ওই ৬ জনের উপস্থিতি দেখিয়ে ব্যাংক থেকে সরকারী টাকা উত্তোলন করে আত্মসাৎ করা হচ্ছে। এছাড়াও মগনামা ইউনিয়নের ১ নং ওয়ার্ড়ের তালিকাভূক্ত শ্রমিক ইমাম হোছাইন জব কার্ড নং ৬। শ্রমিকের তালিকায় ইমাম হোছাইনে নাম অন্তর্ভূক্ত থাকলেও প্রকল্পের কাজে তাকে দেখা যায়না। মগনামার ১ নং ওয়ার্ড়ের ৩টি প্রকল্পে ৪৮ জন শ্রমিক তালিকাভূক্ত করা হয়। কিন্তু প্রতিদিন প্রকল্পের কাজ করছেন ২০-২৫ জন শ্রমিক। অনুপস্থিত শ্রমিকদের মাষ্টার রোলে উপস্থিতি দেখিয়ে ব্যাংক থেকে দৈনিক মজুরীর টাকা উত্তোলন করে প্রকল্প কমিটির লোকজন ভাগাভাগি করে নিচ্ছেন। মগনামা ইউনিয়নের ৪ নং ওয়ার্ড়ে ২টি প্রকল্পে ৩৩ জন শ্রমিক কাগজে-কলমে থাকলেও প্রকল্পে কাজ করছেন ২০জন। একইভাবে ৯ নং ওয়ার্ড়ে ৩২ জন শ্রমিক থাকলেও অর্ধেকের বেশি শ্রমিক কাজে উপস্থিত থাকেনা।

 এদিকে গত কয়েক দিন ধরে সরেজমিনে পেকুয়ার সাত ইউনিয়নের বিভিন্ন প্রকল্প পরিদর্শন করে মগনামার মতো অভিন্ন চিত্র লক্ষ্য করা গেছে। প্রায় অধিকাংশ প্রকল্পেই শ্রমিকরা প্রকল্পের কাজে অনুপস্থিত থাকছেন। শ্রমিকরা কাজে অনুপস্থিত থাকলেও মাস্টার রোলে তাদের হাজিরা খাতায় উপস্থিত দেখানো হচ্ছে।

 জানা গেছে, পেকুয়া সদর ইউনিয়নের ৩ নং ওয়ার্ড় ও ১ নং ওয়ার্ড়ের ৩টি প্রকল্পে ৮৪ জন শ্রমিক রয়েছে কাগজে-কলমে। সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, এসব প্রকল্পে সমূহে কাজ করছেন ৪০-৫০ জন শ্রমিক। পেকুয়া সদরের ৪ নং ওয়ার্ড় ও ৬ নং ওয়ার্ড়ের প্রকল্প সমূহে ৭৯ জন শ্রমিক নিয়োগ করা হয়। কিন্তু মাঠের চিত্র ভিন্ন। এখানে কাজ করছেন গড়ে ৪-৫০জন। অনুপস্থিত শ্রমিকদের মাষ্টাররোলে উপস্থিত দেখিয়ে ব্যাংক থেকে দৈনিক মজুরীর টাকা উত্তোলন করে নেওয়া হচ্ছে।

 কর্মসংস্থান প্রকল্পে অন্তর্ভূক্ত মগনামা ইউনিয়নের ৬ নং ওয়ার্ড়ের কয়েকজন অনুপস্থিত শ্রমিক নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, তারা কাজে অনুপস্থিত থাকলে প্রকল্প কমিটির লোকজন তাদের উপস্থিতির হাজিরা দেওয়া হয়ে থাকে। ব্যাংক থেকে টাকা উত্তোলন করে চারভাগের তিন ভাগ প্রকল্প কমিটি ও গ্রাম পুলিশকে দিয়ে দিতে হয়।

 এভাবে পেকুয়া উপজেলার বারবাকিয়া, রাজাখালী, শিলখালী, টইটং, উজানটিয়া ইউনিয়নের চলমান ইউজিপিপি প্রকল্পের কাজে অন্তর্ভূক্ত অধিকাংশ শ্রমিকর প্রকল্পের কাজে অনুপস্থিত থাকলেও থাকলেও সংশ্লিষ্ট প্রকল্প কমিটির লোকজন শ্রমিকদের হাজিরা খাতায় উপস্থিতি দেখিয়ে ব্যাংক থেকে সরকারী টাকা উত্তোলন করে লুটপাটে মেতে উঠেছে।

 স্থাণীয় সচেতন মহল অভিযোগ করেছেন, পেকুয়া পিআইও অফিস ও সংশ্লিষ্ট ইউনিনের দায়িত্বপ্রাপ্ত টেগ অফিসারদের দায়িত্ব পালনে অবহেলার কারণেই সরকারী এ জনগুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পের বিপুল পরিমান অর্থ লুটপাট হয়ে যাচ্ছে।

 জানা গেছে, গত ২০ দিন ধরে পেকুয়া উপজেলার সাত ইউনিয়নের কর্মসংস্থান প্রকল্পের অধীনে ২৬টি প্রকল্পে দায়সারা কাজ বাস্তবায়ন করা হয়েছে। ব্যাংক উত্তোলনকৃত দৈনিক মজুরীর বিপরীতে তেমন উন্নয়ন কাজ হয়নি। অধিকাংশই প্রকল্পেই দায়সারাভাবে কাজ চলমান থাকায় সরকারের একটি মহৎ উদ্যোগ মাঠ পর্যায়ে সংশ্লিষ্ট সরকারী কর্মকর্তাদের গাফিলতির কারণে ভেস্তে যেতে বসেছে।

 পেকুয়া উপজেলায় ইউজিপিপি প্রকল্পের সুপার ভাইজার মো. মাহফুজ এ প্রসঙ্গে জানান, পেকুয়ার সাত ইউনিয়নের কর্মসৃজন প্রকল্পে অনিয়ম রোধে তিনি সোচ্ছার রয়েছেন। টেক অফিসারদের প্রকল্প তদারকী বাড়াতে তাদের চিঠি দেওয়া হবে। প্রকল্পের কাজে অনুপস্থিত শ্রমিকদেরকে বিল দেওয়ার নিয়ম নেই জানিয়ে তিনি আরো বলেন, সামনে থেকে এ ব্যাপারে আরো কঠোরভাবে তদারকী করা হবে।

 এ প্রসঙ্গে জানকে পেকুয়ার পিআইও সৌভ্রাত দাশের মুঠোফোনে গতকাল ১ জুন সন্ধ্যা ৭টা ৪৪মিনিটে ফোন করা হলে তার মুঠোফোন বন্ধ পাওয়া গেছে। তাই তার বক্তব্য সংযোজন করা সম্ভব হয়নি।

পাঠকের মতামত: