ঢাকা,মঙ্গলবার, ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪

আজ ভয়াল ২৯ এপ্রিল, ৩২ বছরেও সুরক্ষিত হয়নি উপকূল বাঁধ

কক্সবাজারে ১৯৯১ সালের প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ের ৩২ বছর পরও চকরিয়া-পেকুয়া অংশের উপকূলীয় এলাকার বেড়িবাঁধ অরক্ষিত থেকে গেছে। এই দুই উপজেলার অনেক অংশে এখন বড় জোয়ার আসলেও পানি ঢুকে যাচ্ছে লোকালয়ে। ফলে ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাসের খবর শুনলেই আতঙ্কে দিন কাটছে লাখো মানুষের।

এরইমধ্যে প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ের শোকাবহ দিন আজ ২৯ এপ্রিল চলে এসেছে। সেই রাতে ঘূর্ণিঝড় ও ভয়াবহ জলোচ্ছ্বাস কেড়ে নেয় উপকূলের লাখো মানুষের প্রাণ। তাদের মধ্যে কক্সবাজারের চকরিয়া ও পেকুয়া উপজেলায়ই অন্তত ২৫ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়। একই সঙ্গে প্রাণ যায় লাখ লাখ গবাদিপশুর। প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ উপকূলীয় এলাকা কয়েক ঘণ্টার মধ্যে পরিণত হয় বিরাণভূমিতে।

আজকের দিনটি ঘিরে উপকূলীয় এলাকার মানুষ তাদের হারানো স্বজনদের স্মরণ করে। ২৯ এপ্রিল রাতের সেই বিভীষিকা স্মরণ করে আজও শিউরে ওঠে উপকূলের মানুষ। মূলত সেই সময়ে টেকসই বেড়িবাঁধ না থাকায় উপকূলীয় এলাকা রাতের মধ্যেই বিরাণভূমিতে পরিণত হয়েছিল। আর এখনো সেই অরক্ষিত অবস্থা কাটেনি।

বেড়িবাঁধ নির্মাণকারী পানি উন্নয়ন বোর্ড পুরো উপকূল রক্ষায় টেকসই কোনো প্রকল্প এখনো বাস্তবায়ন করেনি। বর্ষা আসলে কেবল জোড়াতালি দিয়েই সময়টা পার করে। ফলে সরকারি বরাদ্দের কোনো সুফল মেলে না। এলাকাবাসীরও কোনো উপকার হয় না।

তবে সম্প্রতি পেকুয়া মগনামায় শেখ হাসিনা সাবমেরিন ঘাঁটি ঘিরে ওই এলাকায় সাগর উপকূলে টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মিত হয়েছে। একই ধরনের বেড়িবাঁধ বড় প্রকল্প নিয়ে চকরিয়া-পেকুয়া উপকূলজুড়ে বাস্তবায়ন চান আতঙ্কে থাকা এলাকাবাসী।

যদিও পানি উন্নয়ন বোর্ড কক্সবাজারের নির্বাহী প্রকৌশলী ড. তানজির সাইফ আহমেদ বলেন, পুরোপুরি সুরক্ষিত উপকূল আমি এটা কখনোই বলব না। তবে সেই ঘূর্ণিঝড়ের পর এখন উপকূলের বেড়িবাঁধের অনেক উন্নয়ন হয়েছে। সর্বশেষ সিত্রাং ঘূর্ণিঝড়েও আপনি দেখবেন অতটা ক্ষয়ক্ষতি হয়নি কারণ বেড়িবাঁধের দুর্বল অংশ ধাপে ধাপে সংস্কার, উন্নয়ন, শক্তিশালী করা হয়েছে।

তাঁর মতে, মাতারবাড়ীতে টেকসই অর্থাৎ একশ বছর মেয়াদি বেড়িবাঁধ নির্মাণে আমরা জাপানি সহায়তা চাইছি। আর কুতুবদিয়া দ্বীপের বেড়িবাঁধ নির্মাণে সরকারি অর্থায়নে করার পরিকল্পনা নিচ্ছি। এ ছাড়া চকরিয়া যেই গুরুত্বপূর্ণ অংশে ঝুঁকি আছে সেগুলো বিদেশি কোনো অর্থায়নে বড় প্রকল্পের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করার চেষ্টা করছি। কারণ এতটাকা সরকারি অর্থায়নে এই মুহূর্তে সম্ভব নয়। এরই অংশ হিসেবে মাতামুহুরী নদী শাসনটা জাপানের জাইকাকে দিয়ে এবং মাতামুহুরী নদীতে দুটি রাবারড্যাম সংস্কার সরকারি অর্থায়নে করতে চাইছি।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্যমতে, কক্সবাজারের চকরিয়া ও পেকুয়া উপজেলায় সমুদ্র উপকূল, নদীতীরের প্রায় ২৮৭ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ রয়েছে। তন্মধ্যে চকরিয়ায় রয়েছে প্রায় ৪৭ কিলোমিটার এবং পেকুয়ায় ২৪০ কিলোমিটার। এই বেড়িবাঁধের মধ্যে চকরিয়ার প্রায় ৩৬ কিলোমিটার অংশ ভঙ্গুর অবস্থায় রয়েছে। সেই ভঙ্গুর বেড়িবাঁধ এবং নদী ভাঙনের কবল থেকে প্রায় ২৭ কিলোমিটার পর্যন্ত তীর টেকসইভাবে সংরক্ষণের জন্য ব্লক বসানো, ১৬টি নতুন স্লুুইস গেট স্থাপন করা, পুরাতন ২৭টি স্লুইস গেট রিপেয়ারিং করার জন্য প্রকল্প প্রস্তাব ঢাকায় পাঠানো হয়েছে। চকরিয়া অংশের এসব কাজ বাস্তবায়নের জন্য সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হয়েছে ৯২২ কোটি ৫৪ লাখ টাকা।

অপরদিকে পেকুয়া উপজেলার প্রায় ২৪০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধের মধ্যে একেবারে নাজুক অবস্থায় রয়েছে প্রায় ৭ কিলোমিটার। সেই বেড়িবাঁধ টেকসই ও আধুনিকভাবে নির্মাণের জন্য বর্তমানে সমীক্ষার কাজ চলছে।

চকরিয়ার বদরখালী, পশ্চিম বড় ভেওলা, চিরিঙ্গা, কোনাখালী, ঢেমুশিয়া, ডুলাহাজারা ও পেকুয়ার মগনামা, রাজাখালী, উজানটিয়া ইউনিয়নের জনপ্রতিনিধিরা জানান, এসব ইউনিয়নের বেড়িবাঁধগুলো নির্মিত হয়েছিল ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড় পরবর্তী। এর পর মাঝেমধ্যে সমস্যা বিবেচনায় জরুরিভিত্তিতে আপদকালীন কিছু কাজ করা হলেও কার্যত ভঙ্গুর ও জরাজীর্ণ অবস্থায়ই রয়েছে বেড়িবাঁধগুলো। এতে ১৯৯১ সালের মতো ফের যদি বড় কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ হয় তাহলে ক্ষয়ক্ষতি এড়ানো যাবে না আগের মতো।

মগনামা ইউনিয়ন পরিষদ  চেয়ারম্যান জানান, বানৌজা শেখ হাসিনা সাবমেরিন ঘাঁটি স্থাপন করায় কাঁকপাড়া বেড়িবাঁধ টেকসইভাবে নির্মাণকাজ চলছে। বর্তমানে ভঙ্গুর অবস্থায় রয়েছে শরতঘোনা থেকে মগনামা জেটিঘাট পর্যন্ত প্রায় দুই কিলোমিটার বেড়িবাঁধ।

চকরিয়ার বদরখালী ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান নূরে হোছাইন আরিফ জানান, দক্ষিণ মাথার ফিশারীঘাট থেকে নাপিতখালী হয়ে মামা-ভাগিনা পাড়া পর্যন্ত প্রায় দুই কিলোমিটার বেড়িবাঁধের অবস্থা খুবই নাজুক। শুধু সামুদ্রিক অস্বাভাবিক জোয়ার নয়, ভারি বর্ষণ হলেই সেই ভঙ্গুর বেড়িবাঁধ বিলীন হতে সময় লাগবে না।

পশ্চিম বড়ভেওলা ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বাবলা বলেন, ‘৬৫ নম্বর পোল্ডারের চৌয়ারফাঁড়ি, ফুলতলা, ডেবডেবি, লম্বাখালী এলাকার সমুদ্র উপকূলের প্রায় ৪ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ একেবারেই বিলীন হয়ে রয়েছে। ফুলতলার ভাদিবইন্যা পয়েন্টের বেড়িবাঁধসহ স্লুইস গেটটির অবস্থা এমন নাজুক যে, বৃষ্টিপাত শুরু হলে এবং সামুদ্রিক অস্বাভাবিক জোয়ারের পানিতে যে কোনো সময় পুরো বিলীন হয়ে পশ্চিম বড় ভেওলা, ঢেমুশিয়া, কোনাখালী ইউনিয়ন তলিয়ে যাবে।’

পাঠকের মতামত: