ঢাকা,শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪

 আর্ন্তজাতিকমানের সাফারিতে ঠাই পাচ্ছে ডুলাহাজারা বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্ক

বন্যপ্রাণি থাকবে বনের উন্মুক্ত পরিবেশে আর পর্যটক-দর্শনার্থীরা থাকবেন সুরক্ষিত গাড়িতে

এম.জিয়াবুল হক, চকরিয়া ::
১৯৯৯ সালে দেশের প্রথম সাফারি পার্ক হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাওয়া কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলার ডুলাহাজারা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সাফারি পার্ক এখন আর্ন্তজাতিকমানের সাফারিতে রপান্তর হতে চলছে। প্রতিষ্ঠার পরে এতটি বছর পার্কের আধুনিকায়নে অর্থবরাদ্দ নিয়ে নানাধরণের জটিলতা আর দুর্দশা থাকলেও ইতোমধ্যে সরকারের বন অধিদপ্তর ডুলাহাজারা বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্কের উন্নয়নে নীতিগত সিদ্বান্ত নিয়েছেন। এরই অংশহিসেবে পার্কের আধুনিকায়নে চলতি ২০২১-২০২২ অর্থবছর ২৮ কোটি ৬৫ লাখ টাকা ব্যয়ে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে অন্তত ৩১টি মেগাউন্নয়ন প্রকল্পের কাজ। ইতোমধ্যে এসব উন্নয়নকাজের অগ্রগতি হিসেবে ৯০ শতাংশের বেশি কাজ সম্পন্ন হয়েছে। চলতি মাসে কার্যাদেশ অনুযায়ী শতভাগ উন্নয়ন কাজ সমাপ্ত হবে এমনটাই অভিমত প্রকাশ করছেন প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা।
ডুলাহাজারা বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্ককে আর্ন্তজাতিকমানের সাফারিতে রূপান্তরের আওতায় মহাপরিকল্পনার অংশহিসেবে উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ (২য় পর্যায়) শীর্ষক প্রকল্পের অধীনে ৩১টি প্যাকেজে উন্নয়নকাজ প্রায় সমাপ্ত হয়েছে। ২৮ কোটি ৬৫ লক্ষ টাকা ব্যয়ে চলমান এসব কাজের ইতোমধ্যে ৯০ শতাংশের বেশি কাজ সুচারুভাবে সম্পন্ন করা হলেও। বাকী কাজ সম্পন্ন হলেই চলতি মাসে শেষ হবে। এরপর সত্যিকার অর্থে চকরিয়ার বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্কের দৃশ্যপট হয়ে উঠবে আরো আর্কষণীয় ও মনোরম এমন ধারণা করছেন পার্ক কর্তৃপক্ষ।
সরেজমিনে দেখা গেছে, ডুলাহাজারা সাফারি পার্কে প্রথম ধাপে ৩১ প্যাকেজের আওতায় উন্নয়নপ্রকল্পের মধ্যে ইতোমধ্যে দৃশ্যমান হওয়া আর্কষণীয় কাজগুলোর মধ্যে আছে, পার্কের বাইরে সবুজ মাঠে বঙ্গবন্ধুর দৃষ্টিনন্দন ভাস্কর্য্য সংস্কারকাজ, ভাস্কর্য্য চত্বর উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ, আধুনিকমানে ফুটপাত নির্মাণ, টিকেট কাউন্টার ও দর্শনার্থী অপেক্ষাকক্ষ নির্মাণ, গাড়ি পার্কিং, প্রবেশ-বাহির হওয়ার সড়ক নির্মাণ, বাঘ-সিংহ সাফারিতে প্রবেশ-বাহির হতে স্বয়ংক্রিয় ফটক নির্মাণ, চিলড্রেন এমিউজিং পার্ক নির্মাণ (ফিডিংসহ), বিভিন্ন বন্যপ্রাণির জন্য আধুনিকমানের ১৭টি বেষ্টনী নির্মাণ, কুমিরের আবাসস্থল উন্নয়ন, জলজ পাখির বেষ্টনীর জলাশয়ে পানির প্রবাহ উন্নয়ন-সম্প্রসারণ, দৃষ্টিনন্দন লেক (জলাশয়) নির্মাণ (কালভার্ট, স্লুইস গেট, ড্রেন নির্মাণসহ), তিন কিলোমিটারের বিদ্যুৎ সরবরাহ লাইন, সাফারি পার্কের দক্ষিণাংশে ১ কিলোমিটার সীমানা প্রাচীর নির্মাণ, পর্যটক-দর্শনার্থীর জন্য রেষ্টিং শেড নির্মাণ, পর্যটক-দর্শনার্থীর জন্য ৬০ ফুট উচ্চতার পর্যবেক্ষণ টাওয়ার, নিরাপত্তা নিশ্চিতকল্পে নিরাপত্তাকর্মীদের জন্য ৩০ ফুট উচ্চতার পরিদর্শন টাওয়ার নির্মাণ, ডরমেটরী মেরামত, কালভার্ট নির্মাণ, বন্যপ্রাণির বেষ্টনীর আড়াই কিলোমিটার কার্পেটিং কানেক্টিং সড়ক, এইচবিবি-মেকাডম-কার্পেটিং দ্বারা তৃণভোজী বেষ্টনীর অভ্যন্তরে তিন কিলোমিটার নতুন সড়ক নির্মাণ ও পুরোনো ৪ কিলোমিটার সড়ক মেরামত, ড্রেনেজ সিস্টেমের উন্নয়ন, ভূমি উন্নয়নসহ দৃষ্টিনন্দন ফটক (মূল গেইট) নির্মাণ, বাঘ, সিংহ ও তৃণভোজী সাফারির অভ্যন্তরে তিন মিটার প্রস্তের ৫ কিলোমিটার সার্ভিস রোড নির্মাণসহ সর্বমোট ৩১টি প্যাকেজে উন্নয়ন ও সম্প্রসারণমূলক কাজ।
সাফারি পার্কের কর্মকর্তারা বলেছেন, পার্কের অবকাঠামো, যোগাযোগ, আবাসন খাতের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি একইসময়ে বন্যপ্রাণির আবাসস্থল উন্নয়নের পাশাপাশি সেখানে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন প্রজাতির লতা-গুল্ম-ঘাসেরও আবাদ করা হয়েছে। যাতে পার্কের বিচরণরত বন্যপ্রাণিরা খাবার খেতে পারে। এতে বন্যপ্রাণির সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করা যাবে।
শনিবার সাফারি পার্ক এলাকা ঘুরে দেখা গেছে- চলতি অর্থবছর ৩১ প্যাকেজের আওতায় সাফারি পার্কের উন্নয়ন-সম্প্রসারণ প্রকল্পের প্রথমধাপের কাজগুলোর বেশিরভাগ কাজের অবকাঠামো দৃশ্যমান হয়েছে। পার্কের বিভিন্ন স্পটে প্রাকৃতিক মনোরম আবহও তৈরী হয়েছে। পরিবেশগত উন্নয়নের ফলে পার্কে আগত দেশি-বিদেশি পর্যটক-দর্শনার্থীরাও পার্কের পুরোনো মলিন আবহগুলো পাল্টে যেতে দেখে বেশ মুগ্ধ।
পার্ক কর্তৃপক্ষ বলছেন-বিনোদনের জন্য ছুটে আসা দেশি-বিদেশি পর্যটক-দর্শনার্থীর সঙ্গে আসা কোমলমতি শিশু-কিশোরও ধারণা পাবে দেশে কত প্রকার বন রয়েছে। তাই পার্কের অভ্যন্তরে এবং বাইরে পর্যটকদের জন্য প্রধান আকর্ষণ হবে লেকের (জলাশয়) কাছে স্থাপন করা চিলড্রেন শেড। এই শেড হবে একেবারেই শিক্ষনীয়। এখানে সাজানো থাকবে বাংলাদেশের তিন প্রজাতির বনের চিত্র। সেখানে শাল বন, ম্যানগ্রোভ বন ও সংরক্ষিত (হিল) বনের ধারণা পাবে বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ পড়–য়া প্রাণীবিদ্যা বিভাগের শিক্ষার্থীরা। সেভাবেই কাজ চলমান রয়েছে। পাশাপাশি পশুস্বাস্থ্য শতভাগ নিশ্চিতকরণসহ কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থাও জোরদারকরণের কাজ চলছে।
ডুলাহাজারা বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্কের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (তত্ত্বাবধায়ক) রেঞ্জ কর্মকর্তা মো. মাজহারুল ইসলাম বলেন, সাফারি মানে বনের ভেতরে কোন ধরণের দৃশ্যমান দেওয়াল বা বেড়া থাকবে না। প্রাকৃতিক পরিবেশ-প্রতিবেশগতভাবেই গাছপালা, ঝোপ-জঙ্গল, লতাগুল্মসহ গাছগাছালিতে ভরপুর থাকবে সাফারি। যা দেখলেই সহজেই বুঝা যাবে এটি বন-জঙ্গলের পরিবেশ। আর সেটাই হতে যাচ্ছে এই সাফারি পার্কে।
তিনি বলেন, বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতেও সাফারি পার্ক রয়েছে। সেখানে বন্যপ্রাণিরা অবাধে বিচরণ করে আর পর্যটক-দর্শনার্থীরা খাঁচায় বন্দি থেকে বিচরণকৃত বন্যপ্রাণিকে খুব কাছ থেকে অবলোকন করে থাকে। আশা করছি, উন্নয়নকাজে মহাপরিকল্পনার অংশহিসেবে আগামী বছর ২০২৩ সালে ডুলাহাজারা বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্ক আর্ন্তজাতিকমানের সাফারিতে দেখবেন পর্যটক দর্শনার্থীরা। সেইভাবেই সাফারি পার্ককে তৈরী করা হচ্ছে।
সাফারি পার্কের ভারপ্রাপ্ত তত্ত্বাবধায়ক মো. মাজহারুল ইসলাম বলেন, উন্নয়ন মহাপরিকল্পনার অংশহিসেবে ৩১টি প্যাকেজের কাজের মান শতভাগ নিশ্চিত করতে পার্ক কর্তৃপক্ষের পাশাপাশি কনসালটিং ফার্মের পাঁচজন প্রকৌশলী মাঠপর্যায়ে কাজ করেছেন। যাতে উন্নয়ন কাজে কোনধরণের বিচ্যুতি বা অনিয়ম করতে না পারে ঠিকাদার।’
ডুলাহাজারা বঙ্গবন্ধু সাফারিপার্কের প্রকল্প পরিচালক এবং চট্টগ্রাম বন্যপ্রাণি ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংররক্ষন বিভাগ চট্টগ্রামের বিভাগীয় বনকর্মকর্তা (ডিএফও) মো. রফিকুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ‘উন্নত দেশগুলোতে সাফারি পার্ককে গড়ে তোলা হয়, ঠিক সেভাবে বাংলাদেশের প্রাকৃতিক ঘন জঙ্গল, পরিবেশ-প্রতিবেশে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর নামে প্রতিষ্ঠিত এই পার্ককে আর্ন্তজাতিকমানের করতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একনেক সভায় অভয় দিয়েছেন। এরই অংশহিসেবে বন ও পরিবেশ মন্ত্রানালয়, বন অধিদপ্তর ডুলাহাজারা বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্ককে সাজাতে মাষ্টারপ্ল্যানের আওতায় যুক্ত করেন।
তিনি বলেন, সরকারপ্রধানের সদিচ্ছার ফলশ্র“তিতে ডুলাহাজারা বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্কে চলতি অর্থবছর প্রথমধাপে গৃহিত ৩১টি প্যাকেজের উন্নয়ন কাজ শতভাগ বাস্তবায়নের পথে। ইতোমধ্যে বেশিরভাগ উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ সম্পন্ন হয়ছে। মুলত এসব উন্নয়নযঞ্জে বর্তমানে পার্কের পুরোনো চেহারা বদলে গেছে।
বিভাগীয় বনকর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, আগামী অর্থবছরেও উন্নয়নমূলক আরো কিছু কাজ করা হবে সাফারি পার্কে। আশাকরি মহাপরিকল্পনার উন্নয়নকাজ সমুহ পুরোটাই বাস্তবায়ন হয়ে গেলে ২০২৩ সালের মাঝামাঝি সময়ে আর্ন্তজাতিকমানের শতভাগ প্রকৃত সাফারিতে রূপান্তরিত হবে ডুলাহাজারা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্ক। তখন পার্কের ভেতরে বন্যপ্রাণি থাকবে উন্মুক্ত পরিবেশে আর পর্যটক দর্শনার্থীরা থাকবেন সুরক্ষিত পরিবেশে, মানে গাড়ির ভেতরে। অবশ্য এখন বন্যপ্রাণিগুলো থাকছে নির্ধারিত বেস্টনীতে, খাঁচায়বন্দি। #

পাঠকের মতামত: