আজিজনগর প্রতিনিধি :: বান্দরবানের লামা উপজেলায় পরিবেশ অধিদপ্তরের জব্দ করা ২ লাখ ৮ হাজার ৫ শত ঘনফুট বালু স্কেভেটর লাগিয়ে ট্রাকে করে লুট করে নিয়ে যাচ্ছে লামা উপজেলার সরই ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মোঃ ইদ্রিস কোম্পানী ও লোহাগাড়া উপজেলা শ্রমিকলীগ নেতা নুরুল হক নুনু।
ব্যাপক ভাবে সরই ও আজিজনগর ইউনিয়নে অবৈধ ভাবে বালু উত্তোলনের ফলে গত ২০২১ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর পরিবেশ অধিদপ্তর চট্রগ্রামের পরিচালক মফিদুল ইসলামের নেতৃত্বে সরইয়ের পাঁচটি স্থান থেকে ৪ লাখ ৬২ হাজার আটশত ঘনফুট ও আজিজনগরে ১লাখ ৭১হাজার ঘনফুট বালু জব্দ করে। পরিবেশ অধিদপ্তর লামা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে এ বালু গুলো জিম্মায় দেওয়া হয়।
এদিকে পরিবেশ অধিদপ্তর পাঁচ জনের বিরুদ্ধে দুইটি এনফোর্সমেন্ট মামলা রুজু করে। পরিবেশের দুটি মামলায় চেয়ারম্যান ইদ্রিস কোম্পানী ও নুরুল হক নুনুসহ পাঁচজনকে ৩লাখ ৭৪ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়।
এছাড়া সরই ইউনিয়নে অবৈধ ভাবে বালু উত্তোলন করায় সরই পুলিশ ফাঁড়ির ক্যাম্প ইনচার্জ মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসাইন বাদী হয়ে তিনজনকে আসামী করে লামা থানায় একটি মামলা রুজু করেন।
গত শুক্রবার ও শনিবার সরজমিনে গিয়ে দেখা যায়, গত ২০২১সালের ২৯সেপ্টেম্বর পরিবেশ অধিদপ্তর চট্রগ্রামের পরিচালক মফিদুল ইসলামের নেতৃত্বে সরই ইউনিয়নের যে পাঁচটি স্থান থেকে বালু জব্দ করছিল তার একটি হলো মসজিদ ভিটা হাসান মাষ্টারের বাড়ির পাশে পোলু খাল সংলগ্ন বালুর স্তুপটির একটি। এ বালুর স্তুপ থেকে একটি স্কেভেটর (মাটি কাটা বা তোলার যন্ত্র) দিয়ে বালু ট্রাকে ভরছে। ট্রাকে বালু ভরা শেষ হলে বালু গুলো নিদিষ্ট গন্তব্যে নিয়ে যাচ্ছে। বালু তোলা অবস্থায় উপস্থিত ছিলেন মোঃ শাহাব উদ্দিন নামের ট্রাকের মাঝি।
এ বালু গুলোর মালিক কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ বালুর স্তুপের মালিক হলো সরই ইউপির চেয়ারম্যান ইদ্রীস কোম্পানী। এ বালু গুলো পরিবেশ অধিদপ্তরের জব্দ কৃত বালু। লামার ইউএনও’র কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে বালু বিক্রি করছেন। আমি বালু পরিবহনের ট্রাকের ব্যবসা ছাড়াও আমি নিজেও পোলু খাল থেকে বালু উত্তোলন করে বিক্রি করি। এ বালুর স্তুপের পূর্বের বালুর স্তুপটি আমার।
এদিকে পরিবেশ অধিদপ্তর চট্রগ্রাম এর পরিচালক মফিদুল ইসলাম বলেন, ব্যাপক ভাবে লামা উপজেলা সরই ও আজিনগর ইউনিয়নে অবৈধ ভাবে বালু উত্তোলনের সংবাদ পেয়ে ২০২১সালের ২৯সেপ্টেম্বর মাসে অভিযান পরিচালনা করি। এ দুই ইউনিয়নের ছয়টি স্থান থেকে আমরা ৬লাখ ৩৩ হাজার পাঁচশত ঘনফুট ও আজিজনগর ইউনিয়নের ঘনফুট বালু জব্দ করি। পরে পরিবেশ অধিদপ্তরে অবৈধ বালু উত্তোনকারীদের বিরোদ্ধে দুই এনফোর্সমেন্ট মামলা রুজু করা হয়। জব্দকৃত বালু গুলো রাজস্ব আদায় করে নিলামে দেওয়ার জন্য উপজেলা নির্বাহী অফিসার লামাকে বলে দেওয়া হয়েছে।
পরিবেশের দুইটি মামলায় সরই ইউপির বর্তমান চেয়ারম্যান ইদ্রীস কোম্পানী ও নুরুল হক নুনুসহ পাঁজনকে জরিমানা করা হয়।
বিষয়টি নিয়ে সরই ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মোঃ ইদ্রীস কোম্পানীর সাথে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, মসজিদ ভিটায় পোলু খাল থেকে তুলে আমি ৩৭হাজার পাঁচশত ঘনফুট বালু স্তুপ করেছি। পরিবেশ অধিপ্তর ২০২১ সালে এ বালু গুলো জব্দ করে আমার থেকে ১লাখটাকা জরিমানা করে। সরই ইউনিয়নে জব্দকৃত সকল বালু গুলো আমাকে জিম্মায় দিয়েছে লামার ইউএনও স্যার। এ বালু গুলো ইউএনও লামা যে দিন নিলাম দিবে সে দিন আমি রাজস্ব দিয়ে দিবো। ইউএনও স্যারের সাথে মৌখিক কথা বলে আমি স্কেভেটর দিয়ে ট্রাকে করে বালু গুলো বিক্রি করছি বলে তিনি জানান।
এ ছাড়া তিনি জানান, আমি বর্তমানে লামা উপজেলা আওয়ামীলীগের কৃষি ও সমবায় বিষয়ক সম্পাদক। এ ছাড়া সরই ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের সাবেক সিনিয়র সহ-সভাপতিসহ ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দায়িত্বে ছিলাম।
এদিকে সরই ইউনিয়নে ব্যাপকহারে অবৈধ ভাবে বালু উত্তোলনের ফলে গত মাসের এপ্রিলের ২৩ তারিখ সরই ইউনিয়নের ক্যায়াজুপাড়া পুলিশ ফাঁড়ির ক্যাম্প ইনচার্জ পুলিশ পরিদর্শক(নিরস্ত্র) মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসাইন বাদী হয়ে তিনজনকে আসামী করে লামা থানায় একটি মামলা রুজু করেন। তিনি বালুমহাল ও মাটি ব্যবস্থাপনা আইন ২০১০ এর ১৫(১)। খাল হইতে অবৈধবালু উত্তোলনে ধারায় এ মামলা করেন। লামা থানার মামলা নং ১৫, তারিখ ২৩এ প্রিল২০২২।
পুলিশ পরির্শকের দায়ের করা মামলাটির বর্তমান তদন্তকারী কর্মকর্তার দায়িত্ব আছেন লামা থানার উপ- পরিদর্শক সুধন চন্দ্র দাস। তিনি এ প্রতিবেদককে বলেন, গেলো মাসের এপ্রিলে সরই ইউনিয়নে জব্দকৃত বালু গুলো উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা লামার কার্যালয়ে নিলাম চলাকালে আমি সংবাদ পেয়ে নিলামস্থলে গিয়ে আমি আপত্তি দিই। এ ব্যাপারে পুলিশের একটি মামলা তদন্ত চলমান রয়েছে বলে জানিয়ে ইউএনও স্যারকে মামলার কাগজ পত্র জমা দিই। পরে ইউএনও স্যার সরই ইউনিয়নে জব্দকৃত বালু মামলা নিস্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত নিলাম স্থগিত করে সরই চেয়ারম্যান ইদ্রীস কোম্পানীকে জব্দকৃত বালু গুলো জিম্মায় দেন।
অবৈধ বালু উত্তোলনের দায়ে যারা আসামী হয়েছেন তারা হলো, লোহাগাড়া উপজেলার পুটিবিলা ইউনিয়নের এম চর হাট এলাকার মৃত মৌলভী আব্দুল জব্বারের ছেলে মৌলভী মোঃ মামুন(৪২), লোহাগাড়া উপজেলার সদর ইউনিয়নের রশিদের পাড়ার মৃত মুজাহের এর ছেলে নুরুল হক নুনু ও লামার সরই ইউনিয়নের ২নং ওয়ার্ডের হাসনা পাড়া এলাকার মৃত ফজল করিমের ছেলে নাছির উদ্দিন(৩২)।
মামলার এজাহার সূত্রে জানা গেছে, ২০১৯সাল থেকে ২ ও ৩ নং ওয়ার্ডের হাসনা ভিটা এলাকার হরিখাল, পলু খাল সরই খালের সালাম মেম্বার পাড়া, জোড় মনি পাড়া এলাকা হতে অবৈধ ভাবে বালু ও পাথর উত্তোলন করে পাচার করে নিয়ে যাচ্ছে। এ কারণে খালের পাড় ভেঙ্গে বসত ঘরসহ চলাচলের রাস্তা, ফসলিজমি ভেঙ্গে যায়।
পুলিশের দায়ের করা মামলার আসামী চট্রগ্রাম ট্রাক ও কাভার্টভ্যান মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও লোহাগাড়া উপজেলা শ্রমিকলীগের সাধারণ সম্পাদক নুরুল হক নুনু’র সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, আমি(নুরুল হক নুনু) ও সরই ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান ইদ্রীস কোম্পানী গত দশ বছর ধরে সরইতে বালু ব্যবসা করে আসছি। লামার সরই ইউনিয়নের পোলু খাল, সরই খালসহ বিভিন্ন ছড়া থেকে বালু উত্তোলন করে চট্রগ্রামের উন্নয়ন কাজের চাহিদা পূরণ করে থাকি। এ ব্যবসা সকলকে মেনেজ করে করি। বর্তমানে সরই খাল ও ডলু খাল থেকে কয়েক লক্ষ ঘনফুট বালু উত্তোলন করে রেখেছি। আসতে বিক্রিও করে ফেলছি।
অন্যদিকে আজিজনগরের পূর্ব চাম্বি সরজমিনে গিয়ে দেখা যায়, উপজেলার আজিজ নগর ইউনিয়নের ৪নং ওয়ার্ডের পূর্বচাম্বী মুসলিম পাড়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের উত্তর পাশে ডলু খাল থেকে তোলা ১লাখ ৭১হাজার ঘনফুট বালু জব্দ করে পরিবেশ অধিদপ্তর ২০২১সালের ২৯ সেপ্টেম্বর জব্দ করে। এ জব্দ করা বালু গুলো লুট করে নিয়ে যাচ্ছে লোহাগাড়া উপজেলার শ্রমিকলীগ নেতা নুরুল হক নুনু ও সরই ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মোঃ ইদ্রীস কোম্পানী। গত এক সপ্তাহ ধরে এ বালু পাচার করে নিয়ে যাচ্ছে এ দুই জন । সরজমিন ও এলাকাবাসীর তথ্যমতে গত শনিবার স্কেভেটর লাগিয়ে ২৯ট্রাক বালু তুলে নিয়ে যায়। বালু তুলে নিয়ে যাওয়ার কথা সাংবাদিকদের শিকার করেন সরই ও আজিজ নগর ইউরিয়নের বালু সিন্ডিকেটের প্রধান শ্রমিক লীগ নেতা নুরুল হক নুনু ও চেয়ারম্যান মোঃ ইদ্রীস কোম্পানী।
এ ব্যাপারে লামা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোস্তফা জাবেদ কায়সার বলেন, সরই ইউনিয়নে পাঁচটি বালুর স্তুপে ৪ লাখ ৬২হাজার আটশত ঘনফুট ও আজিজনগর ইউনিয়নের পূর্বচাম্বী মুসলিম পাড়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাশে ডলু খালের পাড়ে ১লাখ ৭১হাজার ঘনফুট বালু স্তুপ আছে। আমরা গত এপ্রিল মাসে নিলাম ডেকেছিলাম। নির্ধারিত সরকারী মূল্য পর্যন্ত কেউ না ডাকায় সেদিন নিলাম বন্ধ করা হয়। পরবর্তিতে পুনঃ নিলামের জন্য তারিখ নিধারন করা হবে। এ বালু গুলো থানার মামলা নিস্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত সরই ইউপি চেয়ারম্যানকে জিম্মায় দেওয়া হয়েছে। জিম্মায় দেওয়া বালুগুলো চেয়ারম্যান ইদ্রীস কোম্পানী ও নুরুল হক নুনু নিজেই ব্রিক্রি করে দিচ্ছে এমন প্রশ্নের জবাবে ইউএনও বলেন, বিষয়টি আমার জানা ছিলোনা। আমি বিষয়টি নিয়ে লামা থানাকে অবহিত করে রাখবো বলে তিনি জানান।
পাঠকের মতামত: