ঢাকা,বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪

তামাকের মরণ থাবা - ৩

বাংলাদেশে বছরে ১ লাখ ৬১ হাজার মানুষের মৃত্যুর জন্য দায়ী তামাক

শামীমুল হক :: বাংলাদেশে বছরে ১ লাখ ৬১ হাজার মানুষের মৃত্যুর জন্য দায়ী তামাক। তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনে এর প্রচারণা নিষিদ্ধ। কিন্তু সামাজিক দায়বদ্ধতা কর্মসূচি বা সিএসআর কার্যক্রম প্রচারণার প্রধান হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে কোম্পানিগুলো। নানা সিএসআর কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে তারা সংশ্লিষ্টদের প্রভাবিত করে ব্যবসার সম্প্রসারণ করছে। যেমন, কোভিড-১৯ মহামারিকালে বিভিন্ন দেশে কোম্পানিগুলোর নজিরবিহীন দাতব্য কার্যক্রম বিশেষভাবে চোখে পড়েছে। তারা অনুদান, চিকিৎসা সরঞ্জামাদি, ব্যক্তিগত সুরক্ষাসামগ্রী (মাস্ক, হ্যান্ড স্যানিটাইজার) ও খাদ্যসামগ্রী প্রদান করেছে। এসব কার্যক্রমকে তারা নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে যোগাযোগ সৃষ্টির প্রধান উপায় হিসেবে ব্যবহার করেছে। পাশাপাশি এসব কার্যক্রম নিজেদের ওয়েবসাইট ও ফেসবুক পেজে প্রচার করেছে।

তামাক নিয়ন্ত্রণ বিষয়ক আন্তর্জাতিক চুক্তি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন টোব্যাকো কন্ট্রোল (এফসিটিসি) এর ধারা ১৩ অনুযায়ী, তামাক কোম্পানির সামাজিক দায়বদ্ধতা কর্মসূচিসহ তামাকের সব ধরনের বিজ্ঞাপন ও প্রচারণা এবং পৃষ্ঠপোষকতা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে।

সাধারণভাবে সিএসআর কার্যক্রম বললেই সবার চোখের সামনে আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ও নৈতিকতার সঙ্গে ব্যবসা পরিচালনাকারী কোনো ভালো করপোরেট সিটিজেন বা কোম্পানির চিত্র ভেসে ওঠে। কিন্তু তামাক কোম্পানির ক্ষেত্রে এটি কোনোভাবেই প্রযোজ্য নয়। তামাক এমন একটি পণ্য যা এর ব্যবহারকারীর প্রায় অর্ধেকেরই মৃত্যু ঘটায়। কাজেই প্রাণঘাতী পণ্য উৎপাদনকারী এসব প্রতিষ্ঠান মানুষের কল্যাণে অর্থ ব্যয় করবে এটি নৈতিকভাবেও সমর্থনযোগ্য নয়।

তামাক কোম্পানিগুলোর দাবি, তারা দায়িত্বশীল করপোরেট সিটিজেন হিসেবে সিএসআর কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করে। কিন্তু তথ্য বলছে, তামাক কোম্পানির পৃষ্ঠপোষকতায় পরিচালিত কার্যক্রমের আসল উদ্দেশ্য মুনাফা বৃদ্ধি ও কোম্পানির স্বার্থ রক্ষা।

তামাক কোম্পানির সিএসআর কার্যক্রমের ফলে জনগণ বিশেষত শিশু-কিশোরদের মধ্যে তামাক পণ্য সম্পর্কে ইতিবাচক মনোভাব তৈরি হয়। তারা তামাক সেবনকে একটি স্বাভাবিক বিষয় হিসেবে মনে করে। প্রজ্ঞার (প্রগতির জন্য জ্ঞান) পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, করোনা মহামারির মধ্যে সামাজিক দায়বদ্ধতা কর্মসূচির নামে মাঠ প্রশাসনকে ব্যক্তিগত সুরক্ষাসামগ্রী প্রদান করে গণমাধ্যমসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপকভাবে নিজেদের ব্র্যান্ড ইমেজ প্রচার করেছে। এভাবে নানা কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে ইতিবাচক ইমেজ তৈরির চেষ্টা করে কোম্পানিগুলো। ‘তামাক কোম্পানির হস্তক্ষেপ সূচক, বাংলাদেশ ২০২০’ প্রতিবেদনে দেখা যায়, অক্টোবর ২০১৯-এ অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে বাংলাদেশ সিগারেট ম্যানুফ্যাকচারার্স এসোসিয়েশন (বিসিএমএ)-এর অনুরোধের প্রেক্ষিতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) খসড়া জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ নীতি, ২০১৯ চূড়ান্তকরণে তামাক কোম্পানির মতামত গ্রহণের অনুরোধ জানিয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেয়। ‘তামাক কোম্পানির হস্তক্ষেপ সূচক, বাংলাদেশ ২০১৯’ গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী, একটি কোম্পানি শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের অধীন বাংলাদেশ শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশনে ৮ কোটি ৮২ লাখ টাকা প্রদান করে। পরবর্তীতে কম পারিশ্রমিক প্রদান, অতিরিক্ত কর্মঘণ্টা কাজ করানো এবং শ্রম আইনে প্রদত্ত সুবিধাদি প্রদান না করেও শ্রমিকদের দিয়ে কাজ করানোর সুবিধা ইত্যাদি মর্মে প্রজ্ঞাপন জারি করাতে সক্ষম হয়। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বিএটিবি জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) থেকে এক বিশেষ আদেশ জারির মাধ্যমে ২ হাজার কোটি টাকার বেশি কর অব্যাহতি সুবিধা আদায় করে। এমনকি কোভিড-১৯ মহামারি শুরু হওয়ার পর দুইটি বহুজাতিক তামাক কোম্পানি শিল্প মন্ত্রণালয় থেকে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য হিসেবে সিগারেট উৎপাদন, বিপণন ও তামাক পাতা ক্রয় অব্যাহত রাখার জন্য অনুমতিপত্র আদায় করে নেয়।

তামাকের নেতিবাচক দিক থেকে জনগণের দৃষ্টি অন্যদিকে সরানোর জন্য তামাক কোম্পানিগুলো নানাবিধ সিএসআর কার্যক্রমের ঘোষণা দেয়। করোনা মহামারির শুরুর দিকে করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন আবিষ্কারের ঘোষণা দিয়ে গণমাধ্যমে ব্যাপকভাবে প্রচার করে একটি কোম্পানি। এর আগে ২০১৪ সালের দিকে ইবোলার ভ্যাকসিন তৈরির দাবি করেছিলো তারা। কিন্তু বাস্তবে তা দেখা যায়নি।

বিদ্যমান ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন, ২০০৫-এ সামগ্রিকভাবে তামাকজাত দ্রব্যের বিজ্ঞাপন ও প্রচারণা নিষিদ্ধ করা হলেও তামাক কোম্পানির ‘সামাজিক দায়বদ্ধতা কর্মসূচি বা সিএসআর কার্যক্রম সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ করা হয়নি। ফলে তামাক কোম্পানিগুলো সিএসআর কার্যক্রমের অজুহাতে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে যোগাযোগ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সার্বিক তামাক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমকে বাধাগ্রস্ত করছে। এ অবস্থায় এফসিটিসি’র আলোকে বিদ্যমান ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন, ২০০৫ সংশোধন করে তামাক কোম্পানির সিএসআর কার্যক্রম সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করার দাবি উঠেছে।

আইনগতভাবে সিএসআর কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা হলে তামাক কোম্পানিগুলো প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নিজেদের প্রচার চালাতে পারে না। ডব্লিউএইচও রিপোর্ট অন গ্লোবাল টোব্যাকো ইপিডেমিক ২০২১ প্রতিবেদন অনুযায়ী নেপাল, ইরান, উরুগুয়ে, নাইজেরিয়া, স্পেন এবং রাশিয়াসহ বিশ্বের ৬২টি দেশ তামাক কোম্পানির সিএসআর কার্যক্রম সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করেছে।

পাঠকের মতামত: