মুক্তিযুদ্ধবিরোধী প্রচারণায় ১৪ বছরের কারাদণ্ড
নিজস্ব প্রতিনিধি ::
বহুল আলোচিত ৩২ ধারা রেখেই জাতীয় সংসদে ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা বিল-২০১৮’ উত্থাপন করা হয়েছে। গতকাল সোমবার রাতে বিলটি উত্থাপন করেন ডাক টেলিযোগাযোগ ও তথ্য-প্রযুক্তি মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার। বিলটি পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে পাঠানো হয়েছে। বিলটি উত্থাপনের আগে জনমত যাচাইয়ের প্রস্তাব করেন বিরোধীদলীয় একজন সদস্য। তাঁর প্রস্তাব কণ্ঠভোটে নাকচ হয়ে যায়। এরপর অধিকতর পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য বিলটি সংশ্লিষ্ট সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে পাঠানো হয়। কমিটিকে চার সপ্তাহের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।
বিলের বিধানে রয়েছে, ‘যদি কোনো ব্যক্তি ডিজিটাল মাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বা জাতির পিতার বিরুদ্ধে কোনো প্রকার প্রোপাগান্ডা ও প্রচারণা চালান বা মদদ দেন তাহলে ওই ব্যক্তি অনধিক ১৪ বছরের কারাদণ্ড বা অনধিক এক কোটি টাকা অর্থদণ্ডে বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। আবার যদি কোনো ব্যক্তি একই অপরাধ দ্বিতীয়বার বা পুনঃ পুনঃ সংগঠিত করেন তাহলে তিনি যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে বা অনধিক তিন কোটি টাকা অর্থদণ্ডে বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।
উল্লেখ্য, গত ২৯ জানুয়ারি খসড়া আইনটির চূড়ান্ত অনুমোদন দেয় মন্ত্রিসভা। ব্যাপক সমালোচিত ৫৭ ধারাসহ কয়েকটি ধারা তথ্য-প্রযুক্তি আইন থেকে সরিয়ে সেগুলো আরো বিশদ আকারে যুক্ত করে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন করা হয়েছে। বিলে আলোচিত ৩২ ধারা সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘যদি কোনো ব্যক্তি বেআইনি প্রবেশের মাধ্যমে কোনো সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত বা সংবিধিবদ্ধ কোনো সংস্থার কোনো ধরনের অতি গোপনীয় বা গোপনীয় তথ্য-উপাত্ত কম্পিউটার, ডিজিটাল ডিভাইস, কম্পিউটার নেটওয়ার্ক, ডিজিটাল নেটওয়ার্ক বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক মাধ্যমে ধারণ, প্রেরণ বা সংরক্ষণ করেন বা করতে সহায়তা করেন তাহা হইলে উক্ত ব্যক্তির অনুরূপ কার্য হইবে কম্পিউটার বা ডিজিটাল গুপ্তচরবৃত্তির অপরাধ।’ এ ধরনের অপরাধের শাস্তির বিধানে বলা হয়েছে, ‘এ ধরনের অপরাধে অনধিক ১৪ বছরের কারাদণ্ড বা অনধিক ২৫ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।’ আরো বলা হয়েছে, ‘উল্লিখিত অপরাধ দ্বিতীয়বার বা পুনঃ পুনঃ সংঘটন করলে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা অনধিক এক কোটি টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।’
এই ধারা নিয়ে বিলটি মন্ত্রিসভায় অনুমোদনের পর থেকে আন্দোলন-সংগ্রাম চলছে। সংসদে উত্থাপনকালেও বিলের ওই ধারার বিরোধিতা করেন জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য মো. ফখরুল ইমাম। তিনি বলেন, ২০০৬ সালের আইসিটি আইনের ৫৭ ধারার অপপ্রয়োগ হয়েছে। সেটা বাতিলের প্রতিশ্রুতিও ছিল। কিন্তু ৫৭ ধারা বাতিল করে যে ৩২ ধারা করা হয়েছে, সেটা সংবিধানবিরোধী। এটা জনগণের মৌলিক অধিকার হরণ করবে। বিলের ৩৯/খ ধারাও সংবিধানবিরোধী। আর কয়েকটি অপরাধে জামিন অযোগ্য বিধান বিচার বিভাগের ওপর হস্তক্ষেপ বলে তিনি দাবি করেন।
বিলটি উত্থাপনের আগে জনমত যাচাইয়ের প্রস্তাব করেন বিরোধীদলীয় এই সদস্য। তবে তাঁর প্রস্তাব কণ্ঠভোটে নাকচ হয়ে যায়। এরপর বিলটি উপস্থাপন করা হয়।
বিলটিতে জাতীয় ডিজিটাল নিরাপত্তা কাউন্সিল গঠনের কথা বলা হয়েছে। ১১ সদস্যবিশিষ্ট ওই কমিটিতে চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করবেন প্রধানমন্ত্রী। সদস্য হিসেবে থাকবেন ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্য-প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী বা প্রতিমন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের সচিব, জননিরাপত্তা বিভাগের সচিব, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব, আইজিপি, বিটিআরসি চেয়ারম্যান ও প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তরের (ডিজিএফআই) মহাপরিচালক। আর সদস্য সচিব থাকবেন জাতীয় ডিজিটাল নিরাপত্তা কাউন্সিলের মহাপরিচালক।
এ ছাড়া বিলে ডিজিটাল নিরাপত্তা এজেন্সি গঠনের প্রস্তাব করা হয়েছে। পাশাপাশি সার্বক্ষণিক দায়িত্ব পালনের জন্য এজেন্সির অধীনে একটি জাতীয় কম্পিউটার ইমার্জেন্সি রেসপন্স টিম গঠনের কথা বলা হয়েছে। বিলে ডিজিটাল ফরেনসিক ল্যাব স্থানেরও বিধান রাখা হয়েছে।
বিলে পরোয়ানা ছাড়া তল্লাশি, জব্দ ও গ্রেপ্তারের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। আর সাইবার সন্ত্রাস কাজের জন্য ১৪ বছর কারাদণ্ডের বিধান করা হয়েছে। একই অপরাধ যদি দ্বিতীয়বার করা হয় তাহলে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া যাবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। আর মানহানিকর তথ্য প্রকাশ, সম্প্রচার ইত্যাদির জন্য তিন বছর কারাদণ্ড ও পাঁচ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন এমন বিধান রাখা হয়েছে। একই অপরাধ দ্বিতীয়বার করলে পাঁচ বছর কারাদণ্ড দেওয়া হবে। হ্যাকিং অপরাধের জন্য ১৪ বছর কারাদণ্ড বা এক কোটি টাকা অর্থদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। একই অপরাধ দ্বিতীয়বার করা হলে যাবজ্জীবন বা পাঁচ কোটি টাকা অর্থদণ্ড দেওয়া যাবে।
বিলের উদ্দেশ্য ও কারণ সম্পর্কে বলা হয়েছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষিত রূপকল্প ২০২১ ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণের লক্ষ্যে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির সর্বোচ্চ ও নিরাপদ ব্যবহার আবশ্যক। বর্তমান বিশ্বে তথ্য-প্রযুক্তির ব্যাপক ব্যবহারের মাধ্যমে এর সুফল ভোগের পাশাপাশি অপপ্রয়োগ উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে সাইবার অপরাধের মাত্রাও দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। জাতীয় ডিজিটাল নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ ও ডিজিটাল অপরাধসমূহের প্রতিকার, প্রতিরোধ, দমন, শনাক্তকরণ, তদন্ত এবং বিচারের উদ্দেশ্যে এ আইন প্রণয়ন অপরিহার্য। সাইবার তথা ডিজিটাল অপরাধের কবল থেকে রাষ্ট্র এবং জনগণের জানমাল ও সম্পদের নিরাপত্তা বিধান এ আইনের অন্যতম লক্ষ্য।
বিলে আরো বলা হয়েছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়নকে প্রকারান্তরে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সোনার বাংলার পুনর্জাগরণ বলা যেতে পারে। এই মহান স্বপ্নদ্রষ্টার সোনার বাংলার স্বপ্ন বাস্তবায়নে তাঁরই যোগ্য উত্তরসূরি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রূপকল্প ২০২১ ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ২০১৮ অন্যতম সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।
পাঠকের মতামত: