ঢাকা,রোববার, ১০ নভেম্বর ২০২৪

সিভিল সার্জন অফিসে দীর্ঘ ১২ বছর বহাল স্বাস্থ্য শিক্ষা কর্মকর্তা উচাপ্রু, প্রতিমাসে অর্ধ কোটি টাকার উৎকোচ বাণিজ্য

ািাাএম.শাহজাহান চৌধুরী শাহীন, কক্সবাজার, ১৫ মার্চ ॥

কক্সবাজার সিভিল সার্জন অফিস। সরকারী এই সেবামুলক প্রতিষ্টানে চলছে অবাধে অনিয়ম, দুর্নীতি আর সরকারী বরাদ্দের কোটি কোটি টাকা লুটপাটের ঘটনা। দীর্ঘ একযুগেরও বেশি সময় সিনিয়র স্বাস্থ্য শিক্ষা কর্মকর্তা পদে কর্মরত উচাপ্রু মারমা এসব অপকর্ম বিনা বাধাঁয় করে যাচ্ছেন। সিভিল সার্জন না থাকায় উচাপ্রুর ক্ষমতার কাছে অনেকটা অসহায় হয়ে আছে খোদ ভারপ্রাপ্ত সিভিল সার্জনও। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে পুরো জেলার চিকিৎসা ব্যবস্থা এই কর্মকর্তা কাছে অনেকটা জিম্মি। এমন কথা জানালেন জেলা শহর ছাড়াও উপজেলায় কর্মরত অনেক মেডিকেল অফিসার এবং স্বাস্থ্য সহকারী। এছাড়া সিভিল সার্জন অফিসে প্রতিমাসে অর্ধ কোটি টাকার উৎকোচ বাণিজ্য চলে আসছে বলেও অভিযোগ।

বিভিন্ন সুত্রে প্রাপ্ত অভিযোগে প্রকাশ, সিনিয়র স্বাস্থ্য শিক্ষা কর্মকর্তা হিসেবে কক্সবাজার সিভিল সার্জন অফিসে গত ২০০৪ সালের ৪ এপ্রিল যোগদান করেন উচাপ্রু মারমা। গত এক যুগেরও বেশি সময় ধরে এখানে কর্মরত থাকায় সরকারী সেবা মুলক এই প্রতিষ্টানটিকে ব্যক্তিগত প্রতিষ্টানে রূপান্তর করেছে। স্বাস্থ্য শিক্ষাখাত নিয়ে চালিয়ে যাচ্ছে সীমাহীন অনিয়ম আর দুর্নীতি। কক্সবাজার জেলার বিভিন্ন অঞ্চলে ডায়রিয়া, নিউমুনিয়া রোগ প্রতিরোধ বিষয়ে জনগণের মাঝে সচেতনতা বৃদ্ধি করাসহ বিভিন্ন টিকা, খাদ্য পুষ্টি গুনাগুনের ব্যাপারে জনগণকে উদ্ভুদ্ধ করাই হচ্ছে তার কাজ। কিন্তু এধরনের কোন কাজই তিনি করেন না। জেলা স্বাস্থ্য শিক্ষা অফিসার উচাপ্রু মারমা মাঠ পর্যায়ে স্বাস্থ্য সহকারী, পরিবার পরিকল্পনা সহকারী ও কমিউনিটি স্বাস্থ্য কর্মীদের সরকারি নির্দেশে স্বাস্থ্য বিষয়ক বিভিন্ন প্রশিক্ষণ ও স্বাস্থ্যকর আচরণে অভ্যস্থ করা এবং স্বাস্থ্য শিক্ষা প্রদান করার বিধান থাকলেও তিনি তা করেন না। ভুয়া বিল ভাউচার তৈরি করে এখাতে সরকারী বরাদ্দের টাকা আত্মসাত করে আসছে।

দুর্যোগ উত্তর উদ্বূত স্বাস্থ্য সমস্যা যেমন আঘাত পাওয়া, পানিতে ডুবে যাওয়া, সাপে কাটা, ডায়রিয়া, নিউমোনিয়া ও অন্যান্য স্বাস্থ্য সমস্যার চিকিৎসা দেয়া। দুর্যোগ উত্তর উদ্বূত স্বাস্থ্য সমস্যার সেবা দেয়া জন্য সংশ্লিষ্ট এলাকায় স্যাটেলাইট ক্যাম্প বা স্বাস্থ্য কেন্দ্র থেকে সেবা প্রদান করার সরকারী স্বাস্থ্য নীতি তিনি কিছুই তোয়াক্কা করেন না। সরকারী কর্মচারী ছাড়াও তার কাছ থেকে সেবা নিতে যাওয়া লোকজনের সাথে অসাধাচারণও করেন তিনি। সিভিল সার্জন অফিসের এই উচাপ্রু মারমা সহ ৬ জনের সিন্ডিকেটকে টাকা দিলেই মিলছে ভুঁয়া স্বাস্থ্য সনদসহ জখমী সনদপত্র, ময়না তদন্ত, বয়স নির্ধারণ প্রতিবেদন, ধর্ষণ হয়েছে কিনা সংক্রান্ত প্রতিবেদন।

এছাড়া চাকুররি জন্য যথাযথ কর্তৃপক্ষের পত্রের প্রেক্ষিতে প্রার্থীদের স্বাস্থ্য সনদ প্রদান করার নিয়ম রয়েছে। চাকুরির জন্য নির্বাচতি প্রার্থী সিভিল সার্জন অফিসে স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে চাকুরি প্রদানকারী কর্তৃপক্ষরে নিকট স্বাস্থ্য সনদ সরবরাহ করার নিয়মও তিনি মানেন না। টাকা দিলেওই সব মিলে।

জেলা স্বাস্থ্য বিভাগের সর্বোচ্চ নিয়ন্ত্রক দপ্তর সিভিল সার্জন অফিস চরম অনিয়ম দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত করেছে সিনিয়র স্বাস্থ্য শিক্ষা কর্মকর্তা উচাপ্রু মারমা। তার নেতৃত্বে হিসাব রক্ষণ কর্মকর্তা, স্টোর কিপারসহ কয়েকজন সিনিয়র কর্মচারী মিলে ভূয়া বিল ভাউচার দেখিয়ে এবং বদলী নিয়োগ, বিশেষ করে টেন্ডার নিয়ে মোটা অংকের টাকা আত্মসাৎ করে আসছে।

অভিযোগ পাওয়া গেছে, কক্সবাজার সিভিল সার্জন অফিসে প্রতিমাসে অর্ধ কোটি টাকার উৎকোচ বাণিজ্য করে যাচ্ছে। এই অফিসের সিনিয়র স্বাস্থ্য শিক্ষা কর্মকর্তা উচাপ্রু মারমার নেতৃত্বে সিন্ডিকেট ভ্রাম্যমান আদালতের হুমকি ও মানব স্বাস্থ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলায় জড়িতদের কাছ থেকে মাসোহারা তুলেই মাসে নগদ অর্ধকোটিরও বেশি টাকা উৎকোচ বাণিজ্যে জড়িত রয়েছে । এই উচাপ্রুর প্রত্যক্ষ ইন্দনে চক্রের অধীনে জেলার আট উপজেলায় রয়েছে উপজেলা ভিত্তিক আরো বেশকিছু চাঁদা উত্তোলনকারী দালাল চক্র। যারা প্রতিনিয়তই কক্সবাজার জেলার উপজেলাগুলোর আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা প্রায় সহস্রাধিক পল্লী চিকিৎসক, অননুমোদিত ঔষুধের দোকান, ইউনানী, হারবাল, আর্য়ুবেদীয়, লতা-পাতার ঔষুধ বিক্রেতা এমনকি ঝাঁড়ফোঁক (বৈদ্য) চক্রের কাছ থেকে দৈনিক-মাসিক ও সাপ্তাহিক চুক্তিতে এসব টাকা তুলে ভাগ-বাটোয়ারায় লিপ্ত রয়েছে। বছরের পর বছর ধরে সিভিল সার্জন অফিস নিজেদের সরকারী দায়িত্বের অন্তরালে এই অপকর্মে লিপ্ত থাকলেও বিষয়টি বরাবরই অদৃশ্য থেকে যাচ্ছে।

আরো জানা যায়, সিভিল সার্জন অফিসের উক্ত দুষ্ট চক্র শুধু চাঁদাবাজিতে জড়িত নয়, তাদের ঘুষ বাণিজ্য আরো বিভিন্ন ভাবে বিস্তৃত। পিলে চমকানো তথ্য হচ্ছে, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ উক্ত সিভিল সার্জন অফিসের দুর্নীতিবাজরা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বরত নিজেদের উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ, জেলা প্রশাসনের অধিনস্থ ভ্রাম্যমান আদালতের ম্যাজিষ্ট্রেট ও পুলিশ বাহিনীর নাম ভাঙ্গিয়েও মাসের শেষে ঘুষের টাকা বেশি পেতে জেলা শহর সহ বিভিন্ন স্থানে অবস্থিত প্রাইভেট হাসপাতাল, ক্লিনিক, প্যাথলজি ও ভূঁইফোড় ঔষুধ কর্তৃপক্ষের কাছ থেকেও গাণিতিক হারে চাঁদাবাজিতে লিপ্ত রয়েছে।

অভিযোগে আরো প্রকাশ, সরকারী ওষুধসহ বিভিন্ন খাতে সরকারী রবাদ্দ নিয়ে অনিয়ম দুর্নীতিতে অভিযুক্ত ও সদ্য ওএসডি করা সিলিভ সার্জন কমরুদ্দিনের প্রধান সহযোগী হচ্ছে এই উচাপ্রু মারমা। ওএসডি হওয়া সাবেক সিভিল সার্জন কমরুদ্দীন তাকে দিয়েই সরকারী কোটি কোটি টাকা লুটপাট করিয়েছেন। এধারা বর্তমানেও অব্যাহত রেখেছে এই দুর্নীতিবাজ উচাপ্রু মারমা।

একটি সুত্র জানিয়েছেন, সিভিল সার্জন অফিস থেকে প্রতি বছর ভুঁয়া চিকিৎসকদের একটি তালিকা করা হয়। এসব ভুঁয়া চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনার জন্য জেলা প্রশাসকের নিকট পৌছানো হয়। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে স্বাস্থ্য বিভাগ থেকে তালিকা করা হলেও অভিযান পরিচালনার জন্য আর জেলা প্রশাসকের কাছে পৌছান না উচাপ্রু। জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলের ভুঁয়া এমবিবিএস চিকিৎসক, কোয়াক ডাক্তার নামে পরিচিত গ্রাম্য কসাইদের কাছ থেকে প্রতি মাসে তালিকা করে মোটা অংকের অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে।

সুত্র জানায়, সিভিল সার্জন অফিসে শিক্ষা স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দকৃত সরকারী গাড়ী ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার করছে প্রায় সময়। অথচ প্রতি মাসে সরকার থেকে বিপুল পরিমাণ জ্বালানী তেলে টাকা বরাদ্দ নিয়ে আসছে। প্রতি বছর জেলা সদর হাসপাতাল সহ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলোর জন্য কোটি কোটি টাকার ওষুধ বরাদ্দ দেয়া হয়। জেলা ও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলো হতে প্রতি মাসে বিনামুল্যের ওষুধ চাহিদাপত্র সিভিল সার্জন অফিসে প্রেরণ করা হয়। পরে এ চাহিদাপত্র পাঠানো হয় ঢাকায়। চাহিদা মোতাবেক ওষুধ সরবরাহ দেয়া হলে সেখান থেকেও নির্দৃষ্ট হারে কমিশন নেন বলেও অভিযোগ রয়েছে। এমনকি তিনি নিজকে সিভিল সার্জন বলেও দাবী করেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে সিভিল সার্জন অফিসের একজন কর্মকর্তা জানান, দুর্নীতিবাজ উচাপ্রুর হর্তাকর্তা হচ্ছে চট্টগ্রাম বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক ডাঃ আলা উদ্দিন। এই ডাঃ আলা উদ্দিনকেই প্রতি মাসে লাখ লাখ টাকা দিয়ে কক্সবাজার সিভিল সার্জন অফিসেই দীর্ঘ ১২ বছর বহাল রয়েছেন। ইতোপূর্বে তার বদলির অর্ডার হয়েছিল ৭ বার। কিন্তু বরাবরই ঘুষের লেনদেন করেই এখানেই পুনঃবহাল রয়েছে। সরকারী চাকুরী বিধি অনুযায়ী ৩ বছরের অধিক একই স্থানে থাকার কোন বিধান নেই বলেও জানান এই কর্মকর্তা।

এব্যাপারে অভিযুক্ত সিনিয়র স্বাস্থ্য শিক্ষা কর্মকর্তা উচাপ্রু মারমার ব্যক্তিগত মুঠোফোনে একাধিবার রিং করা হলেও তিনি মোবাইল রিসিভ করেননি।

কক্সবাজার সিভিল সার্জন ( ভারপ্রাপ্ত) ডাঃ আলমগীর এর সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, সিনিয়র স্বাস্থ্য শিক্ষা কর্মকর্তা উচাপ্রু মারমার বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ শুনে আসছি। আমি এক সপ্তাহ হলো সিভিল সার্জন ( ভারপ্র্প্তা) দায়িত্ব নিয়েছে। তিনি কিভাবে এতোদিন আছেন সেটা উধর্বতন কর্তৃপক্ষ জানেন।

বক্তব্য নেওয়ার জন্য চট্টগ্রাম বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক ডাঃ আলাউদ্দিনের ব্যক্তিগত মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে অপর প্রান্ত থেকে পিএস পরিচয়দানকারী ব্যক্তি বলেন, স্যার জরুরী মিটিংএ আছেন, এখন কথা বলা যাবে না।

পাঠকের মতামত: