ঢাকা,শুক্রবার, ১৫ নভেম্বর ২০২৪

সাবেক কাউন্সিলর নোবেলের ২০ কোটি টাকা জব্দ করলো দুদক

এম.এ আজিজ রাসেল :: কক্সবাজার পৌরসভার সাবেক কাউন্সিলর জাবেদ মুহাম্মদ কায়সার নোবেলের ২০ কোটি টাকা জব্দ করেছে দুদক। কক্সবাজারের চারটি ব্যাংকে তার একাউন্ট থেকে এসব টাকা জব্দ করা হয়। গতকাল মঙ্গলবার (১ সেপ্টম্বর) দুদকের চট্টগ্রাম অঞ্চলের এক কর্মকর্তা এই তথ্য নিশ্চিত করেছেন।

তিনি জানান, ভূমি অধিগ্রহণ সংক্রান্ত একটি মামলার প্রেক্ষিতে জাবেদ কায়সার নোবেলসহ আরো কয়েকজনের ব্যাংক হিসাব অনুসন্ধান করেছে দুদকে। অনুসন্ধানে জাবেদ কায়সার নোবেলের নামীয় বেসিক ব্যাংক, প্রাইম ব্যাংক, মিচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক এবং ট্রাস্ট ব্যাংক কক্সবাজার শাখায় ২০ কোটির বেশি টাকার সন্ধান পাওয়া যায়। ভূমি অধিগ্রহণ শাখায় কথিত মধ্যস্থতার (দালালি) নামে অবৈধ উপায়ে এসব টাকা হাতিয়ে নেয়া হয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়েছে। তাই নোবেলের নামীয় এসব ব্যাংক হিসাব জব্দ বা টাকাগুলো জব্দ দেখানো হয়েছে।

এর আগে কক্সবাজারে কর্মরত সার্ভেয়ার ও সংশ্লিষ্টগণ একে অপরের যোগসাজশে প্রতারণার মাধ্যমে অসৎ উদ্দেশ্যে এবং ক্ষমতার অপব্যবহার করে ঘুষ দুর্নীতির মাধ্যমে সুবিধা গ্রহণের দায়ে মোট দশ জনের ব্যাংক হিসাব বিবরণ চেয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকে দুদকের নোটিশ পাঠানো হয়।

দুর্নীতি দমন কমিশন এর উপ সহকারী পরিচালক মো. শরীফ উদ্দিন স্বাক্ষরিত একটি নোটিশে কক্সবাজার জেলার ভুমি অধিহণের বিভিন্ন প্রকল্প হতে জমির মালিকদের নিকট থেকে ৯৩ লক্ষ ৬০ হাজার ১৫০ টাকা ঘুষ দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জন পূর্বক ভোগ দখলে রেখে মানিল্কারিংয়ের অভিযোগে মোট দশ জনের ব্যাংক হিসাবের বিবরণ চাওয়া হয়।

যাদের হিসাব বিবরণ চাওয়া হয়েছে তারা হলেন কক্সবাজার পৌরসভার সাবেক ১০ নং ওয়ার্ড কাউসিলর জাবেদ মুহাম্মদ কায়সার নোবেল, নুরুল কবীর, আহমদ হোসেন, ইনানী, মোসলেম উদ্দিন ভূঁইয়া, আরিফুর রহমান, মহিবুল্লাহ, মোফিজুর রহমান ও আব্দুছ সাত্তার।

নোটিশে আরও উল্লেখ করা হয়, গত ২৫ আগস্ট এর মধ্যে উক্ত ব্যক্তিদের রেকর্ডপত্র সত্যায়িত অনুলিপি উপ-কমিশনারের কার্যালয়ে প্রেরণের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের প্রয়োজনীয় নির্দেশনা প্রদানের আদেশ দেয়া হয়। নোটিশে আরও বলা হয়, উক্ত ব্যক্তিদের নামে অথবা তাদের পরিবারের কোন সদস্য অথবা তাদের প্রতিষ্ঠানের নামে ব্যাংক হিসাবের কেওয়াইসি, আগামী আগস্ট হতে অদ্যবধি হিসাবে হিসাব বিবরণী এবং ১ লাখ টাকার উর্ধেŸ প্রত্যেকটি লেনদেনের ডেবিট ক্রেডিট ভাউচারসহ সংশ্লিষ্ট রেকর্ডপত্র জমা দিতে বলা হয়। যার প্রেক্ষিতে কক্সবাজার পৌরসভার সাবেক কাউন্সিলর জাবেদ মুহাম্মদ কায়সার নোবেলের ২০ কোটি টাকা জব্দ করেছে দুদক।

জানা যায়, কক্সবাজারে সরকারের বেশ কয়েকটি মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নাধীন। এর মধ্যে রয়েছে রেললাইন, মাতারবাড়ী বিদ্যুৎ প্রকল্প, মেরিন ড্রাইভ, এলএনজি ও কয়লাভিত্তিক তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র, বিমানবন্দর ইত্যাদি। এসব প্রকল্পের ভূমি অধিগ্রহণ কার্যক্রমও চলমান। বিশেষ করে রেললাইন নির্মাণে জমি অধিগ্রহণের কাজ জোরেশোরে চলছে। হাজার হাজার কোটি টাকার এসব প্রকল্প ঘিরে কক্সবাজারে একটি দুর্নীতিবাজ চক্র গড়ে উঠেছে। তারা দুর্নীতি আর অনিয়মের হাট বসিয়েছে। ভূমি অধিগ্রহণের নামে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে ওই চক্র। ১৫ শতাংশ ঘুষ ছাড়া জমি অধিগ্রহণের টাকা হাতে পান না ভূমির মালিকরা। ভূমি অধিগ্রহণ অফিস ঘিরে সেখানে সরকারি কর্মকর্তা থেকে শুরু করে দালালদের পকেট ভারী হচ্ছে। ঘুষের ৯৩ লাখ টাকাসহ গত ১৯ ফেব্রুয়ারি র‌্যাবের একটি অভিযানে সার্ভেয়ার ওয়াসিম খানকে কক্সবাজারের বাহারছড়া বাজার এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। পলাতক রয়েছেন মো. ফরিদ উদ্দিন ও মো. ফেরদৌস খান নামে দুই সার্ভেয়ার। এরপরই ভূমি অধিগ্রহণ ঘিরে কক্সবাজারে একটি বড় ধরনের সিন্ডিকেটের তথ্য সামনে আসে।

তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, গ্রেপ্তার সার্ভেয়ার ওয়াসিমের কাছ থেকে একটি ডায়েরি পাওয়া গেছে। সেখানে কাকে কী পরিমাণ অর্থ দিয়ে ম্যানেজ করার মধ্য দিয়ে ভূমি অধিগ্রহণের নামে কোটি কোটি টাকা ঘুষ আদায় করা হতো তার হিসাব রয়েছে। সাতটি ভাগে কক্সবাজারের প্রশাসনের দায়িত্বশীল পদে যারা রয়েছেন তাদের মধ্যে ওই ঘুষের টাকা বণ্টন করে দেওয়া হতো। স্থানীয় প্রশাসনের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে শুরু করে কয়েকটি ধাপে ঘুষের টাকার ভাগবাটোয়ারার তথ্য ওই ডায়েরিতে রয়েছে। কানুনগো থেকে শুরু করে অন্যান্য পদে কাকে কত টাকা দেওয়া হয়েছে তা লিখে পাশে বলা হয়- ‘নবম ধাপ পর্যন্ত পেইড’।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে কক্সবাজারের ডিসি কামাল হোসেন বলেন, কক্সবাজারে ৭-৮টি প্রকল্প চলমান। ভূমি অধিগ্রহণ শাখায় যাতে কোনো অনিয়ম-দুর্নীতি না হয় তা নিশ্চিত করতে চার এডিসিকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। স্বচ্ছ অভিযোগ বক্স বসানো হয়। চেক নেওয়ার সময় কেউ কখনও অভিযোগ করেনি যে, তাদের কাছ থেকে ঘুষ বা অনিয়ম করে টাকা নেওয়া হচ্ছে। ইতোমধ্যে ভূমি অধিগ্রহণ শাখার প্রায় কর্মকর্তা-কর্মচারিকে বদলি করা হয়েছে।

এতকিছুর পরও কেন দুর্নীতি রোধ করা যায়নি এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, একেকজন সার্ভেয়ার একেক জায়গা থেকে এসেছেন। তাদের কারও কার বিচ্যুতি ঘটেছে। এই দুষ্টু চক্রে নানা শ্রেণিপেশার লোক রয়েছে। যারাই দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত তাদের গ্রেপ্তার করতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে বলা হয়েছে। গ্রেপ্তার ও পলাতক সার্ভেয়ারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তুলনামূলক স্বচ্ছ সার্ভেয়ারকে কক্সবাজারে পদায়ন করতে ভূমি মন্ত্রণালয়কে বলা হয়েছে। ভূমি অধিগ্রহণ শাখায় নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট দিয়ে একটি হেল্প ডেস্ক খোলা হবে।

জানা গেছে, শুধু সার্ভেয়ার নন, ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তা, অতিরিক্ত ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তা, কানুনগো ছাড়াও আরও ওপরের দিকে অর্থের ভাগ যাচ্ছে। স্থানীয় প্রশাসনের কোন কর্মকর্তাকে কত টাকা দেওয়া হয়, তা রেজিস্ট্রার খাতায় হিসাব রাখতেন সার্ভেয়ার ওয়াসিম।

দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, কক্সবাজারে সরকারি হিসাবে জমির দাম বেশি। তাই ভূমি অধিগ্রহণ করলে ক্ষতিগ্রস্তরা মোটা অঙ্কের টাকা পান। এই সুযোগে ভূমি অধিগ্রহণ অফিসে একটি বড় সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। কোনো ভূমির মালিক অধিগ্রহণের টাকা হাতে পাওয়ার আগেই দালালরা তাদের কাছ থেকে খালি চেক রেখে দেয়। এরপর টাকা পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ওই চেকে টাকার অঙ্ক বসিয়ে ঘুষ আদায় করে। এরপর দালালদের হাত ধরে ওই টাকা চলে যায় সরকারি কর্মকর্তাদের কাছে। কোনো ভূমির মালিক এক কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ হিসেবে পেলে তাদের ১৫ শতাংশ ঘুষ হিসেবে ১৫ লাখ টাকা দিতে হয়। ঘুষের ১৫ শতাংশের মধ্যে ১-২ শতাংশ নেয় দালালরা। বাকি ১৩ শতাংশ অর্থ সরকারি কর্মকর্তাদের মধ্যে ভাগ হয়। এরই মধ্যে পাঁচ-ছয় কোটি টাকা ঘুষ হিসেবে বিভিন্ন কর্মকর্তার পকেটে গেছে এমন নথি পাওয়া গেছে।

ভূমি অধিগ্রহণের নামে দুর্নীতি ও অনিয়মের ঘটনায় গোয়েন্দারা আরও বিশদভাবে খোঁজ নিচ্ছেন। তাদের মধ্যে কয়েকজন দালালও রয়েছে। তারা হলো- কালারমারছড়া ইউনিয়নের আব্দুল হান্নান, একই এলাকার আমান উল্লাহ, কালারমারছড়ার নুনাছড়ি এলাকার লকিয়ত উল্লাহ, শাপলাপুর ইউনিয়নের মোহাম্মদ সেলিম, দিদার, মাতারবাড়ীর হেলাল, বাবর চৌধুরী, হোছাইন, সাগর, ধলঘাটা ইউনিয়নের তাজ উদ্দিন, মো. শফিউল আলম, পেশকারপাড়া এলাকার মো. মুবিন ওরফে উত্তরবঙ্গের মুবিন, ঈদগাহ এলাকার মো. তৈয়ব, রশিদনগর ইউনিয়নের মো. শাহজাহান, ঘোনারপাড়ার আলমগীর ও শহরের কলাতলী এলাকার সাজ্জাদ।

কক্সবাজারে এটা অনেক দিন ধরেই প্রচলিত রয়েছে- ভূমি অধিগ্রহণ শাখার ইট-পাথরও ঘুষ খায়। সেখানে যারা ছোটখাটো পদে চাকরি করেন তারাও নিয়মিত ঢাকায় বিমানে যাতায়াত করেন। ভূমি অফিসের দালাল হতে পারলেও যে কারও জীবনে মোড় ঘুরে যায়। অনেকের ভাষ্য- ভূমি অধিগ্রহণের ক্ষেত্রে সার্ভেয়ারের পদটি গুরুত্বপূর্ণ। তার প্রতিবেদনের ওপর কে কত টাকা ক্ষতিপূরণ পাবেন, তা অনেকাংশ নির্ভর করে। তারা এ ক্ষমতার অপব্যবহার করতে থাকেন। এতে অল্প সময়ের মধ্যে কোটি কোটি টাকার মালিক হন তারা।

জানা গেছে, সার্ভেয়ার ওয়াসিম, ফরিদ ও ফেরদৌসের বাসায় অভিযানে বিভিন্ন ব্যাংকের ১৫ লাখ টাকার চেক, লেনদেন রেজিস্টার, হিসাব বিবরণীসহ গুরুত্বপূর্ণ নানা কাগজপত্র জব্দ করা হয়। জেলা প্রশাসনের ভূমি হুকুম শাখার সার্ভেয়ার ওয়াসিমের বাসা থেকে ২৭ লাখ টাকা, একই শাখার সার্ভেয়ার ফেরদৌসের তারাবনিয়ারছড়া বাসা থেকে ২৭ লাখ টাকা ও সার্ভেয়ার ফরিদের বাসা থেকে ঘুষের ৬০ লাখ ৮০ হাজার টাকা জব্দ করা হয়। বিভিন্ন নথিতে সার্ভেয়ার, কর্মচারী ও কর্মকর্তাদের নাম এবং লেনদেন হিসাব বিবরণী রয়েছে। অর্ধশত দালালের নাম উঠে এসেছে। এ ঘটনায় গ্রেপ্তার সার্ভেয়ার ওয়াসিম, পলাতক ফরিদ ও ফেরদৌসের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। মামলাটি তদন্ত করবে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।

জানা গেছে, সার্ভেয়ার ওয়াসিমের বিরুদ্ধে এর আগে মামলা করেছিল দুদক। বছর দেড়েক আগে ঢাকা থেকে বদলি হয়ে তিনি কক্সবাজার যান। ফেরদৌসও বছর দেড়েক আগে বদলি হয়ে চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার যান। মূলত ওই সময় কক্সবাজারে বড় বড় প্রকল্পের অর্থ ছাড় শুরু হয়। টার্গেট করে মোটা অর্থ হাতিয়ে নিতে তারা কক্সবাজারে বদলি হন।

ইতোমধ্যে দুদক এর টিম সার্ভেয়ার ওয়াসিম সিন্ডিকেটের কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করেছে।

পাঠকের মতামত: