বিশেষ প্রতিনিধি :: কোরবানির ঈদকে ঘিরে নগর ও গ্রাম জুড়ে ওঁত পেতে আছে মলম পার্টি,অজ্ঞান পার্টি ও জাল টাকার কারবারীরা। মূলত: পশুর হাটের ক্রেতা বিক্রেতারাই তাদের প্রধান টার্গেট। ইতোমধ্যেই এসব মৌসুমি অপরাধীদের দৌরাত্ম্য প্রতিরোধে র্যাব পুলিশের একাধিক টিম মাঠে নেমেছে। তাদের হাতে ধরা পড়ছে মাঠ পর্যায়ের অপরাধীরা। তবে পালের গোদারা ঠিকই অধরা রয়ে যাচ্ছে। আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাগণ মনে করছেন, মানুষের সচেতনতাই পারে তাদের দৌরাত্ম্য ঠেকাতে। অপরাধ সংঘটনের পরপরই সংশ্লিষ্ট থানা পুলিশকে বিষয়টি অবহিত করলে দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা সম্ভব। নিরাপত্তা প্রদানের পাশাপাশি পুলিশের ঊর্দ্ধতন কর্মকর্তাগণ মৌসুমী অপরাধ ও অপরাধীদের সম্পর্কে সচেতন থাকার আহবান জানান। প্রসঙ্গত: চট্টগ্রাম জেলার ১৫টি উপজেলা ও নগর এলাকায় মোট ১৯৭টি পশুর হাটে এবার কোরবানির পশু কেনাবেচা চলছে। এর মধ্যে স্থায়ী ৫৮টি এবং ১৩৯টি অস্থায়ী হাট।
কোরবানীর ঈদে পশুর হাটগুলোর নিরাপত্তা বিষয়ে সিএমপি কমিশনার মো: মাহবুবর রহমান বলেন, চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের ৮টি ও জেলা প্রশাসনের ২টি সহ মোট ১০টি পশুর হাটে ৩ হাজারের অধিক পুলিশ সদস্য নিরাপত্তায় নিয়োজিত রয়েছে। ব্যবসায়ীরা টাকা আনা নেওয়ার জন্য পুলিশ সদস্যরা সহযোগিতা করবে। সাদা পোশাকে গোয়েন্দা পুলিশ, নগর বিশেষ শাখার সদস্য ছাড়াও র্যাব, আর্মড পুলিশ রয়েছে। প্রত্যেক হাটে সিএমপির কন্ট্রোল রুম আছে। ওয়াচ টাওয়ার আছে। সিসিটিভি আছে। জালনোট সনাক্তকরণের মেশিন ও ভেটেরিনারী ভিজিল্যান্স টিম (পশু চিকিৎসক) দায়িত্ব পালন করছে। এছাড়া অজ্ঞান পার্টি মলম পার্টির কবল থেকে ক্রেতা বিক্রেতাদের রক্ষার জন্য বেশ কিছু সতর্কতা মূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।
অন্যদিকে জেলার পশুর হাটে নিরাপত্তা এবং পশুবাহী পরিবহনে চাঁদাবাজি প্রসঙ্গে জেলা পুলিশ সুপার নুরে আলম মিনা বলেন, প্রত্যেক পশুর হাটে আমাদের লোকজন আছে। হাটে জেলা পুলিশের পক্ষ থেকে জালনোট সনাক্তকরণ মেশিন বসানো হয়েছে। জেলা পুলিশের কেন্দ্রীয় কন্ট্রোল রুম আছে। আমাদের পুলিশ সদস্যদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে যাতে জেলায় কোনো ধরণের ঘটনা না ঘটে। ঈদে সুনির্দিষ্ট তথ্য ছাড়া সড়কে কোনো গাড়ি তল্লাশি করা হবে না বলেও ঘোষণা দেন নুরে আলম মিনা। এ সংক্রান্ত নির্দেশনা থানা পর্যায়ের পুলিশ সদস্যদের কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়েছে বলে জানান তিনি। তিনি বলেন, তিন শিফটে আমাদের তিন হাজার পুলিশ সদস্য চব্বিশ ঘণ্টা দায়িত্ব পালন করবে। হাইওয়ে পুলিশও আমাদের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করবে।
হাইওয়ে পুলিশের সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার মো. ফরহাদ বলেন, ঈদুল আজহা উপলক্ষে হাইওয়ে পুলিশের পক্ষ থেকে বিশেষ পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। ঈদে হাইওয়ে পুলিশ সদস্যদের ছুটি বাতিল করা হয়েছে। সবাই ডিউটিতে থাকবে। থানা ও ফাঁড়ির নিয়মিত ডিউটি ছাড়াও প্রত্যেক থানা ও ফাঁড়ি এলাকায় দুটি করে মোবাইল টিম, পাঁচটি বিশেষ টিম ও চট্টগ্রামে তিনটি কুইক রেসপন্স টিম মাঠে থাকবে।
সিএনজি টেঙি চালক বেশে মলম পার্টি : মলম পার্টি, গামছা পার্টি বা মরিচের গুঁড়া পার্টি – যা–ই বলা হোক না কেন কাজ তাদের এক। সিএনজি অটোরিঙা নিয়ে রাতের আঁধারে ঘুরতে বের হয় ৬/৭ জন। সুবিধেমতো স্থানে টার্গেট করা ব্যক্তিকে জোরপূর্বক সিএনজি অটোরিঙায় তুলে নেয়। চোখে মরিচের গুঁড়া কিংবা মলম লাগিয়ে সর্বস্ব কেড়ে নেয়। আসন্ন কোরবানির ঈদের আগে মাঠে নেমেছে এরা বিপুল বিক্রমে।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, এ চক্রের সদস্যরা নগরীতে ভাসমান। সপ্তাহ দুয়েকের জন্য আসে, উপর্যপুরি কাজ করে চলে যায়। ফিরে আসে কিছু দিন পরে। বছরের পর বছর এভাবেই চলছে। মাঝে মধ্যে ধরা পড়ে, আবার অল্পদিনের মাথায় ছাড়াও পেয়ে যায়। কারাগার থেকে বেরিয়ে ফিরে যায় পুরনো পেশায়। পেশাদারী এই অপরাধী চক্রটির এক সদস্য সিএনজি চালক যাত্রীদের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করে সিএনজি টেঙিতে যাত্রী উঠায়। কিছুদূর যাওয়ার পর চালক গতি কমিয়ে ফেলে। আর তখনই পেছনে ছায়ার মতো অনুসরণ করতে থাকা অন্য একটি সিএনজি টেঙি থেকে দ্রুত তিনজন নেমে প্রথম টেঙিটির যাত্রীর সিটের দুই পাশে দুইজন এবং চালকের পাশে একজন বসে পড়ে। চলন্ত টেঙিতেই যাত্রীর চোখে মলম লাগিয়ে দেয়া হয়। চোখ খুলতে পারে না যাত্রী। এ সুযোগে যাত্রীর সব কিছু কেড়ে নিয়ে নির্জন কোন স্থানে নামিয়ে দেয়া হয়।
নগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত উপ–কমিশনার মো: কামরুজ্জামান জানান, গোয়েন্দা পুলিশের কাছে ২০ জনের অধিক সিএনজি টেঙি চালকের তথ্য আছে যারা অপরাধের সাথে জড়িত। সিএনজি চালানোর ভান করে তারা নগরীতে বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড করে যাচ্ছে।
বাড়ি ফিরতে বাধা অজ্ঞান পার্টি : ক’দিন ধরে উৎকট গরমে অসহ্য জীবন। এমন তপ্তদিনে পথ চলতে গিয়ে তৃষ্ণার্ত হয়ে পড়া খুবই স্বাভাবিক। যানবাহনে বা চলার পথে তৃষ্ণা মেটাতে সহজেই মিলছে ঠাণ্ডা পানি, জুসসহ নানা পানীয়। তবে সাবধান! ফেরিওয়ালার ছদ্মবেশে আপনার আশপাশেই ঘুরঘুর করছে অজ্ঞান পার্টির সদস্যরা। খদ্দের বুঝে তারা চেতনানাশক ওষুধ মেশানো পানীয় বা খাবার বিক্রি করছে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি অচেতন হয়ে পড়লে সঙ্গে থাকা টাকা ও মূল্যবান জিনিসপত্র হাতিয়ে নিয়ে কৌশলে পালিয়ে যাচ্ছে তারা।
মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ সূত্র জানায়, অজ্ঞান পার্টির সদস্যরা সাধারণত তিনটি গ্রুপে ভাগ হয়ে কাজ করে। একটি গ্রুপ ফেরি করে খাবার বিক্রি করে। আরেক গ্রুপ উদ্ধারকর্মী হিসেবে বাসস্ট্যান্ডের আশপাশে ঘোরাঘুরি করতে থাকে। তৃতীয় গ্রুপ রিকশা বা সিএনজি টেঙি নিয়ে বাসস্ট্যান্ড এলাকায় বসে থাকে। টার্গেট ব্যক্তি অচেতন হয়ে পড়লে পরিচিত সহযাত্রী অথবা নিকটাত্মীয় হিসেবে দ্বিতীয় গ্রুপের সদস্যরা এগিয়ে যায়। অচেতন ব্যক্তিকে হাসপাতালে নেওয়ার নাম করে তারা নিজেদের (তৃতীয় গ্রুপ) যানবাহনে তোলে। এরপর সুযোগ বুঝে টাকা–পয়সা ও মূল্যবান জিনিসপত্র হাতিয়ে নিয়ে অচেতন ব্যক্তিকে রাস্তায় ফেলে দেয়। কখনও হাসপাতালে ভর্তিও করে দেয় তারা। কিছু ক্ষেত্রে প্রথম গ্রুপ অর্থাৎ ফেরিওয়ালাই অচেতন ব্যক্তির সর্বস্ব হাতিয়ে নিয়ে পালায়। এজন্য যানবাহনে চলার পথে অপরিচিত কারো কাছ থেকে কিছু না খাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন পুলিশ কর্মকর্তাগণ।
ভিড়ের মধ্যে সক্রিয় জালিয়াত চক্র : ঈদ সামনে রেখে ব্যস্ত সময় কাটছে ‘জোব্বা‘, ‘পাঞ্জাবি‘ আর ‘গেঞ্জি‘র কারিগরদের। এগুলোর একটিও কিন্তু পরিধেয় বস্ত্র নয়। এক হাজার টাকার জাল নোটকে বলা হয় জোব্বা, পাঁচশ‘ টাকার নোট পাঞ্জাবি, আর গেঞ্জি হলো একশ‘ টাকার নোট। জাল নোট তৈরি ও বিপণনে জড়িত চক্রের সদস্যরা নিজেদের মধ্যে কথোপকথনের সময় এ রকম ছদ্মনাম ব্যবহার করে। এতে আইন–শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের চোখ ফাঁকি দেওয়া সহজ হয়। গোয়েন্দা তথ্য অনুযায়ী, ঈদকে টার্গেট করে প্রচুর জাল নোট তৈরি করে কৌশলে বাজারে ছড়িয়ে দিচ্ছে প্রতারক চক্র। আসলের মতোই প্রায় ‘নিখুঁত‘ হওয়ায় সাধারণ মানুষের পক্ষে জাল নোট চেনাও মুশকিল। মূলত: তাদের ঘাঁটি ঢাকায়। তবে চট্টগ্রামে কাজ করছে তাদের শাখা ও উপশাখাগুলো, যারা কমিশনের ভিত্তিতে জালনোট ছড়িয়ে দিচ্ছে ঈদ বাজারে।
পাঠকের মতামত: