ঢাকা,শনিবার, ১৬ নভেম্বর ২০২৪

লোনা পানির ঝিনুকে মুক্তা: চাষে সম্ভাবনা

নিজস্ব প্রতিবেদক, কক্সবাজার ॥
কক্সবাজার শহরের বাঁকখালী নদীর মোহনা থেকে সেন্টমার্টিন পর্যন্ত বিস্তৃত সামুদ্রিক উপকুলে প্রাকৃতিকভাবে গড়ে ওঠা ঝিনুকের আবাসস্থল রয়েছে। এসব অঞ্চলের ঝিনুকে মুক্তা পাওয়া যায়। তবে লোনা পানির ঘেরে বাণিজ্যিকভাবে ঝিনুক চাষ করা যায় কীনা তা নিয়ে দেশে প্রথমবারের মতো গবেষণা শুরু হয়েছে।

প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ আগ্রহে কক্সবাজারস্থ সামুদ্রিক মৎস্য প্রযুক্তি কেন্দ্রের বিজ্ঞানীরা এই গবেষণা শুরু করেছেন। এবিষয়ে সংশ্লিষ্টদের প্রশিক্ষণও গতকাল বুধবার থেকে শুরু হয়েছে। লোনা পানির ঝিনুক চাষের সম্ভাবনা নিয়ে দেশে ইত:পর্বে কোন গবেষণা হয়নি। তবে সমুদ্র থেকে বাণিজ্যিকভাবে মুক্তা আহরণের সম্ভাবনা নিয়ে একটি জরীপ হয়েছিল। একযুগ আগের সেই জরীপে দেখা গেছে, বাঁকখালী নদী মোহনা, মহেশখালী,
সোনাদিয়া ও ঘটিভাঙ্গায় প্রাকৃতিকভাবে মুক্তা উৎপাদনকারী পাঁচ প্রকারের ঝিনুকের সন্ধান পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা। এরমধ্যে করতাল নামক এক প্রকার ঝিনুকে মুক্তার সন্ধানও তারা পান। পানির ১ মিটার হতে ২ মিটার গভীরতায় বালুকাময় তলদেশে ও ১৮ হতে ২২ পিপিটি লবণাক্ততায় একটি ঝিনুক বা করতালে গড়ে ৫টি হতে সর্বোচ্চ ১২টি মুক্তাও জরীপে পাওয়া গেছে। তবে পরিবেশ দুষণ, আবাসস্থলের পরিবর্তন, নির্বিচারে ঝিনুক আহরণ ইত্যাদি নানাবিদ কারণে বর্তমানে প্রাকৃতিক উৎস থেকে ঝিনুক ও মুক্তার প্রাপ্যতা অনেকাংশে কমে গেছে বলে জানান বিজ্ঞানীরা।

কক্সবাজারস্থ সামুদ্রিক মৎস্য প্রযুক্তি কেন্দ্রের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. জুলফিকার আলী বলেন, এদেশের উপকূলীয় এলাকায় মুক্তা বহনকারী
ঝিনুকের আবাসস্থল কক্সবাজার, মহেশখালী, সোনাদিয়া, মাতারবাড়ি, কুতুবদিয়া, উখিয়া, টেকনাফ, সেন্টমার্টিন দ্বীপ, শাহপরীর দ্বীপ প্রায় সমগ্র
সমুদ্র-উপকূল। যুগ যুগ ধরে উপকূলীয় জনসাধারণ এসব এলাকা থেকে শামুক-ঝিনুক সংগ্রহ করে। জোয়ারের সময় শামুক-ঝিনুকগুলো উপকূলে ভেসে আসে। এসময় স্থানীয় লোকজন সেখান থেকে মুক্ত সংগ্রহ করে। তিনি জানান, দেশে ১৯৯৯ সালে স্বাদুপানিতে পরীক্ষামূলক ভাবে মুক্তাচাষ শুরু হলেও লোনাপানিতে মুক্তা চাষের গবেষণা কার্যক্রম এটাই প্রথম। এদেশে স্বাদুপানির ঝিনুকের ৬টি প্রজাতি এবং সামুদ্রিক লোনাপানির ঝিনুকের ১৪২টি প্রজাতি রয়েছে। উপকুলীয় এলাকার এসব ঝিনুক বিভিন্ন কাজে ব্যবহ্নত হলেও মুক্তা তৈরিই সবচেয়ে গুরুত্বপুর্ণ ব্যবহার বলে তিনি জানান। তিনি আরো জানান, বিশ্বের প্রায় স্বল্প উষ্ণপ্রধান ও উষ্ণপ্রধান সামুদ্রিক জলাশয় ঝিনুকের আবাসস্থল। এরা সমুদ্রের স্বল্প গভীর হতে ৮০ মিটার গভীর
এলাকায় বিচরণ করে। প্রায় ৩০টি সামুদ্রিক ঝিনুক প্রজাতির মধ্যে ৩টি সামুদ্রিক প্রজাতির ঝিনুক বাণিজ্যিক মুক্তা উৎপাদনে ভূমিকা পালন করে।
ঝিনুকের খোলস থেকে চুন, অলংকার, গৃহ সাজসজ্জাকরণ উপকরণ তৈরি ও পোল্ট্রিও ফিশ ফিড মিলে ক্যালসিয়ামের উৎস হিসেবে ব্যবহার করা হয় এবং ঝিনুকের মাংসল অংশ চিংড়ি, মাছ ও হাঁস-মুরগীর খাবার হিসেবেও ব্যবহ্নত হয়। বিশ্বের অনেক দেশে ঝিনুকের মাংসল অংশ প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার হিসেবে ব্যবহ্নত হয়।

বাংলাদেশে সাধারনতঃ ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ঝিনুকের মাংস খেয়ে থাকে। ড. জুলফিকার আলী জানান, বিশ্বের অনেক দেশে সামুদ্রিক ঝিনুক (ওয়েষ্টার)
একটি দামী সীফুড হিসেবে ব্যবহ্নত হয় এবং এর উপর ভিত্তি করে নানা খামারও গড়ে উঠেছে। তিনি জানান, ১৯৯০ এর দশকে প্রতিবেশী ভারতে সামুদ্রিক ঝিনুকের বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন শুরু হয়েছে। অথচ আমরা এখনও গবেষণার পর্যায়ে রয়েছি। বাণিজ্যিকভাবে ঝিনুক চাষের আরো গুরুত্ব তুলে ধরে বিজ্ঞানী জুলফিকার আলী বলেন, মানুষ ও জলজ পরিবেশে উভয়ের জন্য ঝিনুক খুবই গুরুত্বপুর্ন। জলাশয় থেকে শৈবাল, জৈব পদার্থ এবং দ্রবীভুত ক্ষতিকারক উপাদান যেমনঃ ভারী ধাতু দুরীকরণে ঝিনুকের ভুমিকা রয়েছে। তাই ঝিনুক প্রাকৃতিক পানি পরিস্কারক হিসেবে কাজ করে। জলজ খাদ্য শৃঙ্খলের ক্ষেত্রেও ঝিনুক একটি গুরুত্বপুর্ণ উপাদান এবং এরা জলজ খাদ্য শিকলের বিভিন্ন স্তরের সাথে সংযোগ স্থাপন করে। তাই প্রাকৃতিক পরিবেশ থেকে ঝিনুক সংগ্রহ করলে পরিবেশের ক্ষতি হয়। ঘেরে ঝিনুক চাষের মাধ্যমে পরিবেশ সংরক্ষণ ও দেশের মানুষের জীবন জীবিকার উন্নয়ন সম্ভব।

পাঠকের মতামত: