ঢাকা,সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪

বাড়ছে এন্টিবায়োটিকের অপব্যবহার –হুমকির মুখে জনস্বাস্থ্য

dr.-mohammad-lokmanডাঃ মোহাম্মদ লোকমান :

স্বাস্থ্য সচেতনতার এই যুগে শিক্ষিত-অশিক্ষিত সবার কাছে একটি বহুল পরিচিত শব্দ এন্টিবায়োটিক। ১৯২৮ সালে স্যার আলেকজান্ডার ফ্লেমিং কর্তৃক পেনিসিলিন আবিষ্কারের মাধ্যমে জীবনঘাতী জীবানুর বিরুদ্ধে এই এন্টিবায়োটিকের জয়যাত্রা শুরু।আল্লাহ্‌ প্রদত্ত এক বড় নিয়ামত এবং মানবজাতির জন্য আশীর্বাদ এই এন্টিবায়োটিকের অপব্যবহারের ফলে জনস্বাস্থ্য আজ হুমকির মুখে।

সহজ কথায় এন্টিবায়োটিক মানে হচ্ছে জীবানু প্রতিরোধক বা জীবানু নাশক। এখানে জীবানু মানে আবার সকল ধরনের জীবনু নয়, শুধুমাত্র ব্যাকটেরিয়াকে প্রতিরোধ বা ধ্বংস করতে পারে এই এন্টিবায়োটিক। ভাইরাসের বিরুদ্ধে এন্টিবায়োটিকের কোন ভুমিকা নেই। অথচ ভাইরাসজনিত সর্দিকাশি বা ভাইরাস জ্বরেও উচ্চক্ষমতা সম্পন্ন এন্টিবায়োটিকের যথেচ্ছা ব্যবহার হচ্ছে।

সামান্য জ্বর এমনকি মাথাব্যথার জন্যেও মানুষ ডাক্তারের কাছে না গিয়ে ফার্মেসী হতে মুড়ির মত এন্টিবায়োটিক খাচ্ছে, কোন নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে।
আগেই বলেছি এন্টিবায়োটিক মানবজাতির জন্যে আশীর্বাদ স্বরূপ। এমন একসময় ছিল যখন জীবানুঘটিত মহামারিতে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষ মারা যেত অথবা জীবানুসংক্রমণ জনিত সমস্যায় দিনের পর দিন কষ্ট পেত। এন্টিবায়োটিক আবিষ্কারের পর সেই বিভীষিকাময় দিনের অবসান হয়েছে, চিকিৎসা ক্ষেত্রে এসেছে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। যেমন একসময় বলা হত “যার হয়েছে যক্ষ্মা তার নেই রক্ষা”। সেইদিন এখন আর নেই।

এই যক্ষ্মার ওষুধও কিন্তু একধরনের এন্টিবায়োটিক। যে এন্টিবায়োটিক জীবানু প্রতিরোধের মাধ্যমে মানুষের জীবন রক্ষায় যুগান্তকারী ভুমিকা রাখছে, যথেচ্ছা অপব্যবহারের কারনে সেই একই এন্টিবায়োটিক আবার জীবন বিনাশের কারনও হতে পারে।
“এন্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স” বর্তমান সময়ের বহুল আলোচিত একটি বিষয়। এন্টিবায়োটিক ব্যবহারের সুনির্দিষ্ট নীতিমালা অনুসরণ না করে যথেচ্ছা ব্যবহারের কারনে, বেশীরভাগ এন্টিবায়োটিক দিনদিন ভোঁতা অস্ত্রে পরিনত হচ্ছে। জীবানুগুলো নিজেদের মধ্যে এন্টিবায়োটিক নামক অস্ত্রের বিরুদ্ধে শক্তিশালী প্রতিরোধ ব্যবস্থা তৈরি করছে, যার কারনে অনেক ধরনের এন্টিবায়োটিক অকার্যকর হয়ে গেছে বা হয়ে যাচ্ছে, যা জনস্বাস্থ্যের জন্যে নিঃসন্দেহে উদ্বেগজনক।

এন্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্সের কারন ও প্রতিকার:
সংক্রমিত ব্যাক্টেরিয়াকে মেরে ফেলার বা তাদের বংশবিস্তারকে প্রতিরোধ করাই হচ্ছে এন্টিবায়োটিকের কাজ। একাজটি সফল করতে হলে নির্দিষ্ট মাত্রার এন্টিবায়োটিক একটি নির্দিষ্ট সময় পরপর,একটি নির্দিষ্ট সময়কাল ধরে সেবন করতে হয়। যেমন ধরুন, টাইফয়েড জীবানুকে সম্পূর্ণরূপে বিনাশ করার জন্যে নির্দিষ্ট একটি এন্টিবায়োটিক দিনে ২ বার করে আপনাকে ১৪ দিন খেতে হবে, ৫ দিন ওষুধ খাওয়ার
পর দেখা গেল জ্বর কমে গেছে, তাই আপনি ওষুধ সেবন বন্ধ করে দিলেন। ৫ দিন এন্টিবায়োটিক সেবনের পর কিছু জীবানু মরে গেলেও কিছু জীবানু আধমরা অবস্থায় নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখে। পরে এই আধমরা ব্যাক্টেরিয়াগুলো নিজস্ব গবেষণার মাধ্যমে তাদের শত্রুর(এন্টিবায়োটিক) বিরুদ্ধে একটি কার্যকর প্রতিরোধক তৈরি করতে সমর্থ হয় এবং নতুনভাবে বংশবিস্তার শুরু করে দেয়। এরপর যখন পূর্বেকার এন্টিবায়োটিক আবার প্রয়োগ করা হয়, তখন তা আর কাজ করেনা। এভাবে সবধরনের এন্টিবায়োটিক দিনদিন অকার্যকর অস্ত্রে পরিনত হচ্ছে এবং এর জন্যে আমরাই দায়ী। যুদ্ধ করতে নামলে শত্রুপক্ষ পুরোপুরি বিতাড়িত হওয়া পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হয়,অন্যতায় শত্রুপক্ষ নতুন শক্তি সঞ্চার করে পুনরায় আক্রমনের সুযোগ পায়। এন্টিবায়োটিক দিয়ে চিকিৎসা করাটাও জীবানুর বিরুদ্ধে যুদ্ধের মত।
এই যুদ্ধে জয়লাভ করতে হলে
-ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া এন্টিবায়োটিক সেবন বন্ধ করতে হবে।
-ডাক্তারি প্রেসক্রিপশনের নির্দেশনা অনুযায়ী নির্দিষ্ট মাত্রার এন্টিবায়োটিক নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত সেবন করতে হবে।
-রোগের উপসর্গ সমুহ কমে গেলেও চিকিৎসকের নির্দেশনা অনুযায়ী এন্টিবায়োটিকের কোর্স পুরোপুরি শেষ করতে হবে।
-রেজিস্টার্ড ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন ছাড়া এন্টিবায়োটিক বিক্রি বন্ধ করতে হবে।
-এন্টিবায়োটিক প্রেসক্রাইব করার ক্ষেত্রে ডাক্তারদেরও সচেতন হতে হবে।
-রোগী বা রোগীর অভিভাবকদেরকে এন্টিবায়োটিকের ডোজ এবং কোর্স কমপ্লিট করার ব্যাপারে কাউন্সিলিং করতে হবে।
-এন্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স বিষয়ে জনসচেতনতা বাড়ানো উদ্যোগ নিতে হবে।

যেভাবে এন্টিবায়োটিকগুলো অকার্যকর হয়ে যাচ্ছে, তা কিন্তু এক বড় উৎকণ্ঠার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছ। এন্টিবায়োটিকগুলো রেজিস্ট্যান্স হয়ে যাওয়ার এধারা অব্যাহত থাকলে হয়তো এমন দিন আসবে যখন জীবানু সংক্রমণ প্রতিরোধ করার জন্যে কার্যকর কোন এন্টিবায়োটিক আর অবশিষ্ট থাকবেনা। তখন দেখা যাবে বিভিন্ন জীবানুঘটিত রোগে চিকিৎসকদের চোখের সামনেই রোগী মারা যাচ্ছে অথচ ইনফেকশন কন্ট্রোল করার মত তাদের হাতে কার্যকর কোন অস্ত্র নেই। আরেকটি আশংকার বিষয় হচ্ছে,নতুন নতুন এন্টিবায়োটিক বাজারে আগমনের হার কিন্ত আগের চেয়ে অনেক কমে গেছে। তাই এখন হতেই আমাদেরকে সজাগ হতে হবে, বর্তমান এন্টিবায়োটিক সমুহকে যেকোন মূল্যে রক্ষা করতে হবে। আল্লাহ্‌ যেন স্বাস্থ্যসম্মত জীবনযাপনের তাওফিক দানের মাধ্যমে সম্ভাব্য সংক্রমণ জনিত মহামারি হতে সবাইকে হেফাজত করেন।

লেখক : মেডিক্যাল অফিসার, চকরিয়া, পৌরসভা, কক্সবাজার

 

পাঠকের মতামত: