ঢাকা,রোববার, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪

ধর্মের অপব্যাখ্যায় রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বাড়ছে বাল্য বিবাহ

এম.এ আজিজ রাসেল ::  সরকার বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছে। এ জন্য সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। বাল্যবিবাহের কুফল সম্পর্কে প্রচারণায় সরকারকে সহযোগিতা করছে জাতিসংঘের নারী বিষয়ক সংস্থা ইউএন উইমেন। সংস্থাটি উখিয়ার ১৩টি ক্যাম্পে নারী-পুরুষ সমতা, নারীর ক্ষমতায়ন, নারীর প্রতি সহিংসতা রোধ ও বাল্য বিবাহ প্রতিরোধে কাজ করছে। এছাড়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পে রয়েছে তাদের পাঁচটি এবং হোস্ট কমিউনিটিতে তিনটি মাল্টিপারপাস উইমেন সেন্টার। এই সব সেন্টারে রোহিঙ্গা নারীদের দক্ষতা উন্নয়নে বিভিন্ন প্রশিক্ষণ দেওয়ার পাশাপাশি নানা রকমের সামাজিক সচেতনতামুলক সেবা প্রদান করা হয়। পাশাপাশি ক্যাম্পে রোহিঙ্গাদের মাঝে নারীর প্রতি সহিংসতা রোধ ও বাল্য বিয়ের কুফল নিয়ে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য কাজ করছে ইউএন উইমেন এর স্বেচ্ছাসেবকরা। এছাড়াও হোস্ট কমিউনিটিতে নারীদে সেকেন্ড চান্স এডুকেশন নিয়ে কাজ করছে প্রতিষ্ঠানটি।

সোমবার (২২ মার্চ) সকালে ১৮ নং ক্যাম্প ইনচার্জের অফিসের হলরুমে বাল্য বিবাহ প্রতিরোধে সচেতনতামুলক আলোচনা সভার আয়োজন করে জাতিসংঘের নারী বিষয়ক সংস্থা উইএন উইমেন। সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন ক্যাম্প আঠারো’র ইনচার্জ কাজী শামীম।

প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি বলেন, বর্তমান সরকারের কঠোর অবস্থানের কারণে বাল্যবিবাহ অনেক কমেছে সত্যি। তবে এখনো সেটা সর্বত্র একই হারে নয়। বিশেষ করে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে এখনো বাল্য বিয়ে নিয়ে অসচেতন অভিভাকেরা। এই মাসে ৩টি বাল্য বিয়ে বন্ধ করা হয়েছে। এখানে মেয়ে-ছেলেরা ১২-১৩ বছর হলেই বিয়ের জন্য তোড়জোড় করেন মা-বাবা। এছাড়া ধর্মের অপব্যাখ্যায় রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বাড়ছে বাল্য বিবাহ। এখানে অনেকে মৌলভী-মুরব্বীদের ফতোয়ার অপব্যাখ্যা শুনে বাল্য বিবাহের প্রতি আগ্রহী হচ্ছে।

তিনি আরও বলেন, ইসলামে মেয়েদের সর্বোচ্চ সম্মান দেয়া হয়েছে। তাই মেয়েদের ১৮ ও ছেলেদের ২১ বয়স না হলে বিয়ে দেয়া যাবে না। এই আইন যারা মানবে না তাদের কঠোরভাবে দমন করা হবে।

সভার উদ্বোধন করেন ইউএন উইমেনের হেড অফ সাব অফিস ফ্লোরা ম্যাকুলা। উদ্বোধনী বক্তব্যে তিনি বলেন, বাল্যবিয়ের কারণে মাতৃমৃত্যু কিংবা শিশুমৃত্যুর ঝুঁকি অনেক বেশি হয়ে থাকে। অনেক ক্ষেত্রে নাবালিকা মেয়ে মা হওয়ায় কীভাবে শিশুকে পরিচর্যা করবে সে সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান থাকে না। এর ফলে মা ও শিশুর মৃত্যু ঘটতে পারে। বাল্যবিয়ের কারণে নারীর প্রতি সহিংসতা, মাতৃমৃত্যু ঝুঁকি, অপরিণত গর্ভধারণ, প্রসবকালীন শিশুর মৃত্যুঝুঁকি, প্রজনন স্বাস্থ্য সমস্যা, নারীশিক্ষার হার হ্রাস, স্কুল থেকে ঝরে পড়ার হার বৃদ্ধি, নারীদের অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়ার ক্ষমতা ও সুযোগ কমে যাওয়াসহ নানারকম নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা থাকে। বাল্যবিয়ের অভিশাপ থেকে রক্ষা পেতে সমন্বিত পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরী। এ জন্য তিনি সিআইসি, পুলিশ কর্মকর্তা, এনজিও কর্মী এবং সকল রোহিঙ্গা প্রতিনিধিদের একযোগে কাজ করা আহবান জানান।

সভায় বিশেষ অতিথির বক্তব্যে পুলিশ ক্যাম্প-৮ এর ইন্সপেক্টর অফ পুলিশ মো. ফারুকুল ইসলাম বলেন, বাল্য বিবাহ একটি সামাজিক ব্যাধি এবং এটি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। এর সাথে জড়িত ব্যক্তিদের আইনের আওতায় আনা হবে। বাল্য বিবাহের কোন তথ্য পেলে সাথে সাথে এপিবিএন এর কর্মকর্তাদের জানান। অভিযোগ পেলে এপিবিএনের সকল টহল গার্ড সেবা প্রদানের জন্য ২৪ ঘন্টা প্রস্তুত রয়েছে।

সভায় রাইটস্ অফ উইমেন ওয়েলফেয়ার সোসাইটির চেয়ারপার্সন রিজিয়া সুলতানা বলেন, আমি সম্প্রতি নারী সংগঠক হিসেবে সাহসিকতার সাথে নারীদের নিয়ে কাজ করার জন্য সাহসী নারী পদকে ভূষিত হই। কখনো স্বামী, কখনো পিতামাতার দ্বারা নারীরা নিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকে। একজন কিশোরী অল্প বয়সে বিবাহ হলে সে তার কর্তব্যগুলো সঠিকভাবে পালন করতে পারে না। তাই এ বিষয়ে সবাইকে সচেতন হতে হবে।

সচেতনতামুলক এই সভায় বাল্য বিয়ের কুফল নিয়ে আলোচনা করেন ইউএন উইমেন প্রতিনিধি সুলতানা নাসরিন। এতে বাল্য বিবাহের আইন ও কুফল নিয়ে সচিত্র প্রতিবেদন পেশ করেন ব্লাস্টের লিগ্যাল অফিসার অ্যাডভোকেট তামান্না শরীফ উর্মি।

এতে আরও বক্তব্য দেন, হেড মাঝি সাহাবুদ্দিন, মো. নজরুল ইসলাম, সিনিয়র সাইট ম্যানেজমেন্ট অ্যাসিসট্যান্ট, আইওএম।

সভায় রোহিঙ্গারা জানান, অধিকাংশ রোহিঙ্গাদের ঘরে ঘরে ৩ থেকে ৫টি পর্যন্ত মেয়ে থাকে। তারা ১২-১৩ বছরে পা রাখলেই বিয়ে দেয়ার জন্য তোড়জোড় শুরু করেন পরিবার। অনেক অভিভাবকের ধারণা তাদের বয়স ১৫ এর উর্ধ্বে হলেই অধিক যৌতুক দিয়ে বিয়ে দিতে হবে। তাছাড়া কোন মেয়ে ১৮তে পা দিলেই তার বয়স বেশি হয়েছে বলে পরিবারকে নানা নেতিবাচক কথা শুনতে হয়। এছাড়া অনেকে মৌলভী-মুরব্বীদের ফতোয়ার অপব্যাখ্যা বলে বাল্য বিবাহ দিতে চাপ প্রয়োগ করেন। যার ফলে রোহিঙ্গা পরিবারগুলো নিরূপায় হয়েই অপ্রাপ্ত বয়সে মেয়েদের বিয়ে দেন। এমতাবস্থায় ইউএন উইমেন বাল্য বিয়ের কুফল এবং আইন নিয়ে আমাদের যে ধারণা দিয়েছে তা থেকে শিক্ষা নিয়ে আমরা বাস্তবজীবনে প্রতিফলন করবো। প্রতিবেশীসহ সকল রোহিঙ্গাদের বুঝাবো বাল্য বিবাহের ভয়াবহতা।

ইউএন উইমেন রোহিঙ্গা ক্যাম্পে কাজের পাশাপাশি জেলাব্যাপী স্থানীয় নারী পুরুষের সমতা আনায়ন, নারীদের শিক্ষা, অধিকার, সহিংসতা ও বাল্য বিয়ে রোধে কাজ করছে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে উইমেন হেল্প ডেস্ক স্থাপনে পুলিশকে সহায়তা করে ব্যাপক সুনাম অর্জন করে এই জাতিসংঘের নারী বিষয়ক সংস্থাটি। সংস্থাটি হোস্ট কমিউনিটি এবং রোহিঙ্গা নারী নিরাপদে জীবন যাপন, সহিংসতা ও বাল্য বিয়ে রোধে কাজ করছে। এছাড়া ক্যাম্পে কাজে নিয়োজিত নারী পুলিশ সদস্যদের জেন্ডার রেসপন্সিভ পুলিশিং নিয়ে নিয়মিত প্রশিক্ষণ দিয়ে আসছে।

ইউএন উইমেনের কমিউনিকেশন কর্মকর্তা মাহমুদুল করিম জানান, গণমাধ্যমে নারী ও পুরুষের ভারসাম্য রক্ষা, নারীকে সংবেদনশীলভাবে উপস্থাপন, নারীর প্রতি সহিংসতা বিষয়ক প্রতিবেদনে সংবেদনশীল শব্দের ব্যবহার এবং নির্ভরযোগ্য তথ্যের উৎস সম্পর্কে স্থানীয় সাংবাদিকদের সাম্যক ধারণা দেওয়া, গণমাধ্যমে সংবাদ এবং অনুষ্ঠানে নারীপুরুষের ভারসাম্যমুলক উপস্থাপনের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে ইউএন উইমেন নিয়মিত কাজ করে যাচ্ছে। জেন্ডার সংবেদশীল রিপোর্টিয়ের উপর প্রতিষ্ঠানটি স্থানীয় সাংবাদিকদের দক্ষতা উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছে।

অনুষ্ঠানে পুলিশের প্রতিনিধি, সিআইসি, সাংবাদিক, এনজিও প্রতিনিধি, ইউএন উইমেন এর প্রতিনিধি, রোহিঙ্গা ক্যাম্পের কিশোর-কিশোরী এবং অভিভাবকসহ মোট ১৫টি পরিবার অংশ নেয়। এই পরিবারের সদস্যরা বাল্যবিবাহ রোধে কাজ করার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন।

 

পাঠকের মতামত: