ঢাকা,শুক্রবার, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪

দোহাজারী-কক্সবাজার-ঘুমঘুম রেললাইন নির্মাণে ২১ স্থানে বন্যহাতির চলাচলের মরণ ফাঁদ

জনবসতিতে আক্রমনের সম্ভবনা

চকরিয়া (কক্সবাজার) প্রতিনিধি ::

দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত রেললাইন নির্মাণ প্রকল্পে চুনতি অভয়ারণ্যের ভেতর দিয়ে প্রস্তাবিত এই রেললাইনের উপরেই রয়েছে হাতি চলাচলের সক্রিয় করিডোর ও মৌসুমী করিডোর। একইভাবে চকরিয়া উপজেলার ফাঁসিয়াখালী এবং খুটাখালী ইউনিয়নের মেধাকচ্ছপিয়া জাতীয় উদ্যানের হাতি চলাচলের-করিডোরের উপর দিয়ে কক্সবাজার যাবে রেললাইন। চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত রেললাইন নির্মাণ প্রকল্পের প্রায় ২৭ কিলোমিটার পাহাড়ি এলাকা বন্যহাতির জন্য মরণফাঁদে পরিণত হবে ধারণা করছেন বনকর্মকর্তারা। ওই রেললাইনের অধীনে পাহাড়ের ভেতরে অন্তত ২১টি স্থানে রয়েছে হাতির বসতি ও চলাচলের পথ।

দোহাজারী-কক্সবাজার রেললাইন প্রকল্পে ১২৮ কিলোমিটারের মধ্যে ২৭ কিলোমিটারের মতো পড়েছে চুনতি বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য, চকরিয়া উপজেলার ফাঁসিয়াখালী বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য এবং খুটাখালী ইউনিয়নের মেধাকচ্ছপিয়া জাতীয় উদ্যানের (প্রস্তাবিত ন্যাশনাল পার্কের) ভেতর। এই ২৭ কিলোমিটার এলাকায় রেললাইন বন্যপ্রাণী চলাচলের জন্য ‘আন্ডারপার’ ও ‘বক্স-কালভার্টে’র মতো বিকল্প ব্যবস্থা না রাখায় শুধু হাতি নয়, বিপন্ন হবে জীববৈচিত্র।

২০১৭ সালে চালানো পৃথক ক্যামেরা ট্রাকিংয়ে তিন বনাঞ্চলের ২১টি পয়েন্টে হাতি চলাচলের করিডোরের সন্ধান পাওয়া গেছে। এসব করিডোর দিয়ে চলাচলের সুযোগ না রেখে রেললাইন স্থাপন করা হলে বিপদাপন্ন হাতি ক্ষুব্ধ হয়ে লোকালয়ে নেমে আসতে পারে এবং এতে হাতির সঙ্গে মানুষের সংঘাত বাড়বে।

চট্টগ্রামের দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত রেললাইন নির্মাণ প্রকল্পের ১৪৫ দশমিক ৮ কিলোমিটার পড়বে চুনতি বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যে। চকরিয়া উপজেলার ফাঁসিয়াখালী বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যে ১০ দশমিক ৩ কিলোমিটার এবং একই উপজেলার খুটাখালী ইউনিয়নের মেধাকচ্ছপিয়া জাতীয় উদ্যানের পড়বে দশমিক ৯ কিলোমিটার রেললাইন।

এই তিন অভয়ারণ্যে হাতির চলাচলের পথ শনাক্ত করার জন্য ২০১৭ সালের ৮ থেকে ১৫ এপ্রিল প্রথম এবং পরে আবার ৩১ অক্টোবর থেকে ৭ নভেম্বরে পর্যন্ত সমীক্ষা পরিচালনা করা হয়।

তথ্যসূত্রে জানা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াইল্ড লাইফ কনসালট্যান্স নরিস এল. ডোড এবং একই সংস্থার বাংলাদেশের ন্যাশনাল এনভায়রনমেন্টাল কনসালট্যান্ট আসিফ ইমরান অভয়ারণ্যে হাতির চলাচলের পথ শনাক্ত করতে যৌথভাবে গবেষণা পরিচালনা করেন। ক্যামেরা ট্রাকিংয়ের মাধ্যমে এই গবেষণা পরিচালনা করা হয়। গবেষণায় তিনটি বনাঞ্চলে ২১টি স্থানে হাতির চলাচলের পথ এবং আবাসস্থলও পাওয়া যায়।

এর মধ্যে ১৩টি স্থান চুনতি বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যে, সাতটি চকরিয়া উপজেলার ফাঁসিয়াখালী বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যে ও একটি মেধাকচ্ছপিয়া জাতীয় উদ্যানে (ন্যাশনাল পার্কে)। চুনতিতে ১৩টির মধ্যে নয়টিতে উভয় মৌসুমে হাতির আনাগোনা দেখা যায়। ক্যামেরা ট্রাকিংয়ের জন্য চুনতিতে ১১টি, ফাঁসিয়াখালীতে সাতটি ও মেধাকচ্ছপিয়াতে দুটি ক্যামেরা বসানো হয়েছিল।

পাহাড়ের গহীন অরণ্যে প্রায় সাত মাস পর্যবেক্ষণে রাখা হয় এসব ক্যামেরা। ক্যামেরা ট্রাকে হাতির পাশাপাশি নয় প্রজাতির স্থন্যপায়ী প্রাণীর ২৩২ গ্রুপ ও ৩২০ প্রজাতির অন্যান্য প্রাণী শনাক্ত করা হয়। তিনটি বনাঞ্চলেই এশিয়ান হাতির অস্তিত্ব পাওয়া যায়। চুনতিতে ছয় প্রজাতির স্থন্যপায়ীর ১৬৮ গ্রুপ ও ২৩৪ প্রজাতির প্রাণী, ফাঁসিয়াখালীতে ৫৯ গ্রুপ ও চার প্রজাতির ৬৬ প্রাণী।

এখানে রয়েছে দুটি বিরল প্রজাতির বিড়াল, যার মধ্যে একটি ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচারের (আইইউসিএন) বিপন্ন প্রাণীর তালিকায়ও রয়েছে। এখানে দেখা গেছে, সর্বোচ্চ ৪৭টি হাতি। মোট হাতির ৫৭ শতাংশের দেখা মেলে এই বনে।

সমীক্ষায় দেখা যায়, সবেচেয়ে বেশি জীববৈচিত্র রয়েছে চুনতিতে। এখানে সবচেয়ে বেশি হুমকিতে রয়েছে বিপন্ন প্রজাতির হাতি। রেললাইন নির্মাণের ফলে এসব হাতি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ফাঁসিয়াখালী এলাকায় রেললাইন নির্মাণের ফলে হাতি লোকালয়ে নেমে জনবসতিতে আক্রমণ করতে পারে।

পরিবেশ বিজ্ঞানীদের মতে, ‘হাতি তাদের চলাচলের পথে কোনো ধরনের বাধা সহ্য করে না। প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়লে তারা সেটা উপড়ে ফেলার চেষ্টা করে। নয়তো লোকালয়ে চড়াও হয়।

রেললাইন নির্মাণের ফলে সংরক্ষিত বন যেমন ভাগ হবে এবং তেমনি হাতিও তাদের আবাসস্থল ছেড়ে লোকালয়ে নেমে আসবে। ঘটবে প্রাণহানিও। তাই বন্যপ্রাণী চলাচলের ব্যবস্থা ও জীববৈচিত্র সুরক্ষা করেই রেললাইন নির্মাণ করতে হবে।’

একই সমীক্ষায় পাখি জরিপে দেখা যায়, ৯৯ প্রজাতির পাখির দেখা মেলে এ তিনটি সংরক্ষিত বনে। সমীক্ষায় চার হাজার ১৮১টি পাখির দেখা মিলেছে। চুনতিতে সাতটি সাইটে বনের কোর জোনে বিভিন্ন গাছপালা জরিপে প্রায় ১১ প্রজাতির গাছের সন্ধান পাওয়া গেছে। ফাঁসিয়াখালী বাফার বনের কমিউনিটি অংশে পাঁচ প্রজাতির মধ্যে গর্জন গাছের সংখ্যা সর্বাধিক পাওয়া গেছে। এ বনের মোট গাছের মধ্যে প্রায় ৫৮ শতাংশই গর্জন। মেধাকচ্ছপিয়ায়ও পাওয়া গেছে গর্জন গাছ।

চুনতিতে ৪৫ প্রজাতির গুল্ম ও ঔষুধি বৃক্ষ রয়েছে, ফাঁসিয়াখালীতে ৩০ প্রজাতি ও মেধাকচ্ছপিয়াতে ১৯ প্রজাতি রয়েছে। এসব উদ্ভিদ ও গুল্ম বন্যপ্রাণী, বিশেষ করে হাতির বসবাসের জন্য উপযুক্ত।

সংরক্ষিত বনাঞ্চল নিয়ে কাজ করার অভিজ্ঞতা রয়েছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মনিরুল হাসান খানের। তিনি গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যের যেসব স্থান দিয়ে রেললাইন যাবে, সেসব স্থানে হাতিসহ বন্যপ্রাণী চলাচলের অনেক পথ রয়েছে। এসব পথ আগে থেকেই চিহ্নিত করা হয়েছে। তাহলে রেললাইনের কারণে বন্যপ্রাণীর নির্বিঘ্ন চলাচলের পথ রুদ্ধ হবে না।

চট্টগ্রাম-কক্সবাজার সড়কের লোহাগাড়া উপজেলার চুনতি এলাকায় পড়েছে চুনতি অভয়ারণ্য। এখানে রয়েছে হাতিসহ বন্যপ্রাণী চলাচলের বড় একটি করিডোর। সড়কের ১০ গজের মধ্যেই রয়েছে অভয়ারণ্যের বিট অফিস। সেখানে ছাত্রদের ডরমিটরিও রয়েছে। পাশেই স্কুলের সাইনবোর্ড।

সরেজমিনে দেখা গেছে, কক্সবাজার-চট্টগ্রাম মহাসড়কের হোটেল ফোর সিজন ও সুফিনগর প্রাইমারি স্কুলের মাঝখানে পড়েছে এই করিডোর। করিডোরের একপাশে সিমেন্টের পিলারের ওপর প্লাইউডের তৈরি সাইনবোর্ড। সেখানে লেখা রয়েছে-‘হাতি চলাচলের করিডোর’। পাশে রয়েছে বিভিন্ন নির্দেশ সংবলিত পৃথক একটি ডিজিটাল সাইনবোর্ড।

করিডোর দিয়ে হাতিসহ বিভিন্ন বন্যপ্রাণী চলাচলের চমকপ্রদ তথ্য দিলেন লোহাগাড়া চুনতি অভয়ারণ্যের বিট অফিসার এ টি এম গোলাম কিবরিয়া। তিনি জানালেন, চুনতি অভয়ারণ্যে রয়েছে ৪২টি হাতি। হাতিগুলোর মধ্যে ৩৬টি বয়স্ক ও ছয়টি বাচ্চা। এগুলো তিন থেকে চারটি দলে বিভক্ত হয়ে চলাচল করে থাকে। বেপরোয়া ধরনের একটি হাতিকে আলাদা চলাচল করতে দেখা যায়। কখনও কখনও সব হাতিকে একসঙ্গেও দেখা যায়।

চট্টগ্রাম-কক্সবাজার সড়কের চকরিয়া উপজেলার ফাঁসিয়াখালী লামা-আলীকদম সড়ক ঘেঁষেই রয়েছে কক্সবাজার উত্তর বনবিভাগের আওতাধীন ফাঁসিয়াখালী ফরেস্ট অফিস এবং আনুমানিক আট কিলোমিটারের ব্যবধানে সাফারি পার্কের কিছু আগে পড়েছে মেধাকচ্ছপিয়া ফরেস্ট অফিস। দুটি স্থানে রয়েছে হাতি চলাচলের পৃথক করিডোর।

চট্টগ্রাম বিভাগীয় বন্যপ্রাণী ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের কার্যালয় থেকে রেলওয়েকে দেওয়া প্রস্তাবনায় অভয়ারণ্যের যেসব স্থানে রেললাইন নির্মাণ করা হবে, সেখানে নির্বিঘ্নে হাতি চলাচলের জন্য আট মিটার উঁচু ও ১০০ মিটার দৈর্ঘ্যেরে ‘আন্ডারপাস’ নির্মাণ, হরিণ ও ছোট ছোট প্রাণী চলাচলের জন্য এক কিলোমিটার পর পর কমপক্ষে দুটি মিটারের ‘আন্ডারপার’ নির্মাণ, সরীসৃপ ও উভয়চর প্রাণীর যাতায়াতের জন্য প্রাকৃতিক জলাধারের ওপর বক্স-কালভার্ট নিমার্ণ, বক্স-কালভার্ট বা আন্ডারপাসগুলোর দেয়ালে প্রাকৃতিক উদ্ভিদে ঢেকে দেওয়া বনাঞ্চলের মধ্যে ট্রেনের গতি ২০ কিলোমিটারে কমিয়ে আনা এভং এলিফ্যান্ট ট্র্যাকিং কমিটি গঠন করার কথা বলা হয়।

বন্যপ্রাণী ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ চট্টগ্রাম বিভাগীয় বনকর্মকর্তা (ডিএফও) এসএম গোলাম মাওলা বলেন, অভয়ারাণ্য দিয়ে রেললাইন হলে কী ধরনের ক্ষতি ও সমস্যা হবে, সেই ব্যাপারে আমরা রেলওয়েকে জানিয়েছি। তাদের কাছে বিষয়টি নিয়ে লিখিত আকারে কিছু প্রস্তাবনাও দেওয়া হয়েছে।

দোহাজারী-কক্সবাজার রেললাইন প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী মফিজুর রহমান বলেন, ‘রেললাইন স্থাপনের ফলে বনাঞ্চল ও বন্যপ্রাণীর যাতে ক্ষতি না হয়, সে জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এডিবি ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ থেকে আমাদের কিছু প্রস্তাবনা দেওয়া হয়েছে। সে অনুযায়ী আমরা কাজ করার চেষ্টা করছি।

প্রকল্প বাস্তবায়নে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার এক হাজার ৩৮৭ একর ভূমি প্রয়োজন হলেও এখন পর্যন্ত তিন দফায় পাওয়া গেছে মাত্র ২৪৮ একর জায়গা। আর যেখানেই জায়গা পাওয়া যাচ্ছে, সেখানেই নির্মাণ কাজ শুরু করা হচ্ছে। দুই ভাগে ভাগ করে চলছে দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত রেললাইন স্থাপন।

পাঠকের মতামত: