ঢাকা,রোববার, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪

তামাকের মরণ থাবা ৬

তামাক কোম্পানীগুলো সুযোগ দিচ্ছে আইনের ফাঁক

শামীমুল হক :: বর্তমানে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের ফাঁককে কাজে লাগানো হচ্ছে। এতে করে আইনের সুফল ঘরে উঠছে না। সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবার্তার বাস্তবায়ন তামাক নিরুৎসাহিতকরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বড় আকারের সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবার্তা নতুনদের মধ্যে তামাক ব্যবহার শুরু নিরুৎসাহিত করে। পাশাপাশি বর্তমান ব্যবহারকারীদের তামাক ছাড়তে উৎসাহিত করে। কিন্তু দেশে তামাকজাত দ্রব্যের মোড়কে সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবার্তা চালু থাকলেও তামাকের ব্যবহার নিরুৎসাহিতকরণে তা যথেষ্ট কার্যকরী নয়। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে তামাকপণ্যের প্যাকেটে ৮৫ ভাগ জায়গাজুড়ে সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবার্তা মুদ্রণ করা হয়। নেপালে এটি ৯০ ভাগ।

অথচ বাংলাদেশে তা মাত্র ৫০ ভাগ। তাছাড়া তামাকজাত দ্রব্যের প্যাকেট, মোড়ক, কার্টন বা কৌটার আকার, আয়তন কেমন হবে এবং এরমধ্যে ন্যূনতম কী পরিমাণ তামাকজাত দ্রব্য, শলাকা থাকবে তা আইনে উল্লেখ নেই। অন্যদিকে আইনের ১০নং ধারা অনুযায়ী তামাকজাত দ্রব্যের মোড়কে ওপরের ৫০ শতাংশ জায়গাজুড়ে সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবার্তা মুদ্রণ বাধ্যতামূলক। কিন্তু কোম্পানিগুলো তা নিচের ৫০ শতাংশে মুদ্রণ করছে। যা অপেক্ষাকৃত কম কার্যকরী।

বিশ্বে প্রতি বছর ৮০ লাখ মানুষের প্রাণ কেড়ে নেয় তামাক। বৈশ্বিক অর্থনীতিতে তামাকজনিত ক্ষতির পরিমাণ বছরে ১.৪ ট্রিলিয়ন ডলার। তামাকের মারাত্মক স্বাস্থ্য ক্ষতি থেকে জনস্বাস্থ্যকে সুরক্ষার জন্য পৃথিবীর অনেক দেশ শক্তিশালী তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন প্রণয়ন এবং বাস্তবায়ন করছে। বিশেষত, শিশু-কিশোরদের তামাকপণ্যের ছোবল থেকে রক্ষায় অনেক দেশ তামাকপণ্যের বিজ্ঞাপন ও প্রচার বন্ধ করতে কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে। তবে তামাক কোম্পানিও বসে নেই। বিজ্ঞাপন প্রচারের অন্যতম কৌশল হিসেবে তারা তামাকপণ্যের প্যাকেটকে বেছে নিয়েছে। আকর্ষণীয় ডিজাইন, রং এবং বিভ্রান্তিকর তথ্য সম্বলিত প্যাকেট তৈরি করে তরুণদের তামাকপণ্যে আকৃষ্ট করার কাজ অব্যাহত রেখেছে।

তামাক কোম্পানির এই কূটকৌশল মোকাবিলায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন টোব্যাকো কন্ট্রোল (এফসিটিসি) এর ধারা ১১, ধারা ১৩ এবং এ সংক্রান্ত গাইডলাইন অনুযায়ী সরকারসমূহের জন্য তামাকজাত দ্রব্য মোড়কজাতকরণে কঠোর বিধিনিষেধ যেমন, বৃহদাকার সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবাণী প্রচলন, প্লেইন প্যাকেজিং যেমন- কোনো প্রকার লোগো, রং ও প্রচারণামূলক তথ্য ছাড়া শুধুমাত্র ব্রান্ড ও পণ্যের নাম উল্লেখ করার প্রথা প্রচলন সংক্রান্ত আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবার্তার আয়তন বড় হলে ব্যবহারকারীরা তামাক ছাড়তে উৎসাহিত হয় এবং তামাকপণ্যের প্যাকেট প্রদর্শনের প্রবণতা হ্রাস পায়। সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবার্তার আকার ৫০ ভাগ থেকে বাড়িয়ে ৯০ ভাগ করার দাবি জানিয়েছে তামাক বিরোধী সংগঠনগুলো। একইসঙ্গে তাদের দাবি সব ধরনের তামাকজাত দ্রব্যের প্যাকেট, মোড়ক, কার্টন বা কৌটার আকার, আয়তন এবং এগুলোর মধ্যে ন্যূনতম কী পরিমাণ তামাকজাত দ্রব্য থাকবে তা নির্ধারণ করে দিতে হবে।

উরুগুয়ে ও অস্ট্রেলিয়ায় পরিচালিত গবেষণায় দেখা গেছে, সচিত্র সতর্কবার্তার আকার বাড়ানো হলে ব্যবহারকারী স্বাস্থ্যক্ষতির বিষয়ে ভাবতে বাধ্য হয়। তারা তামাক ছাড়তে উৎসাহিত হয়। মেক্সিকোতে এক গবেষণায় দেখা গেছে, বৃহদাকার সচিত্র সতর্কবার্তা অল্প বয়সীদের মধ্যে সিগারেটের প্রতি আকর্ষণ কমায়। তামাক কোম্পানি নির্দিষ্ট আকারের মোড়কে তামাকপণ্য বাজারজাতকরণে বাধ্য হলে মোড়কে মুদ্রিত সচিত্র সতর্কবার্তার কার্যকারিতা বৃদ্ধি পায়।

বিশ্বের ৮৩টি দেশ তামাকজাত দ্রব্যের মোড়কে ৫০ শতাংশের অধিক জায়গাজুড়ে সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবাণী মুদ্রণ করছে। যার মধ্যে নেপাল ৯০ ভাগ, ভারত ৮৫ ভাগ, থাইল্যান্ড ৮৫ ভাগ, মালদ্বীপ ৯০ ভাগ, শ্রীলংকা ৮০ ভাগ, অস্ট্রেলিয়া ৮২.৫ ভাগ, উরুগুয়ে ৮০ ভগা ও তুরস্ক ৯২.৫ ভাগ। অন্যদিকে, বিশ্বের ১৮টি দেশে প্লেইন প্যাকেজিং প্রথা বাস্তবায়ন করেছে যার মধ্যে রয়েছে অস্ট্রেলিয়া, ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য, নরওয়ে, আয়ারল্যান্ড, নিউজিল্যান্ড, হাঙ্গেরী, সৌদি আরব, তুরস্ক, থাইল্যান্ড, উরুগুয়ে, স্লোভেনিয়া, ইসরাইল, সিঙ্গাপুর, কানাডা, বেলজিয়াম, নেদারল্যান্ডস এবং ডেনমার্ক। এছাড়া আরও ২০টি দেশ নেপাল, শ্রীলঙ্কা, জর্জিয়া, মরিশাস, সাউথ আফ্রিকা, রোমানিয়া, তাইওয়ান, ব্রাজিল, চিলি, গুয়েরন্সে, জার্সি, ইকুয়েডর, পানামা, জাম্বিয়া, বোতসোয়ানা, কেনিয়া, মালয়েশিয়া, ইউনাইটেড আরব আমিরাত, ফিনল্যান্ড ও সুইডেন প্লেইন প্যাকেজিং প্রবর্তনে উল্লেখযোগ্য প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে।

সার্বিক বিষয়ে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব এবং জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ সেলের সমন্বয়কারী হোসেন আলী খোন্দকার বলেন, তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের সংশোধন নিয়ে কাজ চলছে। প্রক্রিয়ায় রয়েছে যেসব দাবি উঠেছে সেগুলো সংশোধন করা হবে। তবে চূড়ান্ত না হওয়া পর্যন্ত বলা যাচ্ছে না। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে এ নিয়ে দফায় দফায় অনেক বৈঠকও হয়েছে। আইন নিয়ে মন্ত্রণালয়ে দু’টি বৈঠক করেছি। সবাই শতভাগ ধূমপানমুক্ত আইন করার প্রস্তাব দিয়েছে। অর্থাৎ ডেজিগনেটেড স্মোকিং জোন বিলুপ্ত করার কথা বলেছেন। এখন বিষয়গুলো সচিবের সামনে উপস্থাপন করা হবে।

পাঠকের মতামত: