ঢাকা,বৃহস্পতিবার, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪

জয়ের জন্য মরিয়া আ. লীগ, বিএনপি চায় পুনরুদ্ধার

ছোটন কান্তি নাথ, চকরিয়া :: 

কক্সবাজার-১ (চকরিয়া-পেকুয়া) আসনে ১৯৭৩ সালের পর আর আওয়ামী লীগ জয় পায়নি। এই সময়ে বিএনপি পাঁচবার, জাতীয় পার্টি তিনবার ও জামায়াতে ইসলামী একবার এই আসনে জয় পায়। দশম সংসদ নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সংসদ সদস্য হন জাতীয় পার্টির মোহাম্মদ ইলিয়াছ।

নির্বাচনে দীর্ঘদিনের ব্যর্থতার এই ‘গ্লানি’ ভুলতে একাদশ সংসদ নির্বাচনে জয়ের জন্য মরিয়া আওয়ামী লীগ। সে জন্য তৃণমূলের নেতাকর্মীরা নব উদ্যমে মাঠে কাজ করছে। একসময় যেখানে কেউ আওয়ামী লীগের কর্মী বলে পরিচয় দিতেও সাহস পেত না সেখানে এখন নেতাকর্মীরা মাঠ দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। ভোটারদের দ্বারে দ্বারে গিয়ে সরকারের উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের বার্তা পৌঁছে দিচ্ছে তারা।

অন্যদিকে বিএনপি চায় আসনটি পুনরুদ্ধার করতে। জাতীয় পার্টি চায় আসনটি ধরে রাখতে। এরই মধ্যে প্রার্থী ঘোষণা করেছে জামায়াতও।

আওয়ামী লীগ : নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, চকরিয়া উপজেলা পরিষদের বর্তমান চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি জাফর আলমের নেতৃত্বে দলের নেতাকর্মীরা এখন আগের চেয়েও বেশি ঐক্যবদ্ধ। মানবতাবিরোধী অপরাধে জামায়াত নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর সাজা হওয়ার পর বিএনপি ও জামায়াত-শিবিরের সন্ত্রাস মোকাবেলায় তাঁর নেতৃত্বেই নেতাকর্মীরা মাঠে ছিল।

নেতাকর্মীরা বলছে, বিএনপির দুর্গ হিসেবে পরিচিত চকরিয়া ও পেকুয়া উপজেলার প্রতিটি ইউনিয়নে জাফর আলমের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের শক্ত ভিত তৈরি হয়েছে। তারা মনে করছে, আওয়ামী লীগের জন্য সামনে সুদিন অপেক্ষা করছে।

এই আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন আলোচনায় স্বাভাবিকভাবেই জাফর আলমের নাম আগে আসছে। এ ছাড়া আলোচনায় আছেন বিএনপি প্রার্থীর কাছে পর পর তিনবার পরাজিত হওয়া কক্সবাজার জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সালাহউদ্দিন আহমদ (সিআইপি), দলের জেলা শাখার সহসভাপতি ও চকরিয়া উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান রেজাউল করিম, জেলা শাখার বন ও পরিবেশ বিষয়ক সম্পাদক কমরুদ্দীন আহমদ (সালাহউদ্দিন আহমদের ছোট ভাই), শিক্ষা ও মানবসম্পদ বিষয়ক সম্পাদক মো. আশরাফুল ইসলাম সজিব ও সদস্য এ টি এম জিয়াউদ্দিন চৌধুরী জিয়া।

নেতাকর্মীরা বলছে, এক যুগ ধরে দলীয় সভা-সমাবেশসহ নানা কর্মকাণ্ডে ওতপ্রোতভাবে জড়িত থেকে এলাকায় আওয়ামী লীগের রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করছেন দলের চকরিয়া উপজেলা শাখার সভাপতি জাফর আলম।

চকরিয়া পৌরসভা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও কক্সবাজার জেলা পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যান জাহেদুল ইসলাম লিটু মনে করেন, চকরিয়া-পেকুয়া আসনের নির্বাচন খুবই কঠিন। যেহেতু এই আসনে সালাহ উদ্দিন আহমদের মতো বিএনপির একজন শক্ত প্রার্থী রয়েছেন, তাঁর সঙ্গে লড়াই করে নির্বাচনে জয়ী হয়ে আসাটা সহজ হবে না। সে জন্য আওয়ামী লীগে জাফর আলমের মতো প্রার্থীর বিকল্প নেই। চকরিয়ার মানুষ, দলের নেতাকর্মীরাও চায় যাঁর নেতৃত্বে বিগত আন্দোলন-সংগ্রামে আওয়ামী লীগ রাজপথ দখলে রেখেছিল তাঁকেই যেন মনোনয়ন দেওয়া হয়। তিনি বলেন, ‘নৌকা

র বিজয় সুনিশ্চিত করতে আমরা জাফর আলমের নেতৃত্বে তৃণমূল নেতাকর্মীরা ইস্পাত-কঠিন ঐক্যবদ্ধ রয়েছি।’

চকরিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও ফাঁসিয়াখালী ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান গিয়াস উদ্দিন চৌধুরী বলেন, ‘বিএনপি-জামায়াতের আগুন-সন্ত্রাস ও নাশকতার বিরুদ্ধে আন্দোলন-সংগ্রামে নেতৃত্ব দেওয়া জাফর আলমকে সামনে রেখে আমরা স্বাধীনতার ৪৪ বছর পর এই আসনটি জিততে চাই। এ জন্য তাঁকে মনোনয়ন দেওয়া ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। কারণ তিনিই একমাত্র আওয়ামী লীগের রাজনীতির হাল ধরে রেখেছেন চকরিয়া ও পেকুয়ায়।’ তাঁর দাবি, আসনটি আর মহাজোটকে ছেড়ে না দিয়ে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে জাফর আলমকেই মনোনয়ন দেওয়া হোক।

চকরিয়া পৌরসভার মেয়র উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক আলমগীর চৌধুরী বলেন, ‘দলের মধ্যে যাঁর অবদান ও ত্যাগ রয়েছে এবং যাঁর নেতৃত্বে রাজনীতির মাঠ আওয়ামী লীগের দখলে রয়েছে তাঁকেই আগামী সংসদ নির্বাচনে দল মনোনয়ন দেবেন বলে আশা করছি। কারণ প্রার্থী নির্ধারণের ক্ষেত্রে যদি কোনো ভুল হয় তাহলে পরাজয়ের গ্লানিই বয়ে যেতে হবে আমাদের। অবশ্য এই আসনে দল যাঁকেই মনোনয়ন দেবে তাঁর পক্ষেই কাজ করব আমরা।’

পেকুয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবুল কাশেম বলেন, ‘এই আসনে বিএনপি প্রার্থীর সঙ্গে যুদ্ধ করে জয়ী হতে হলে জাফর আলমের কোনো বিকল্প নেই। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য দীর্ঘদিন ধরে আমরা জাফর আলমের নেতৃত্বে মানুষের দ্বারে দ্বারে যাচ্ছি।’

জাফর আলম বলেন, ‘আমি আওয়ামী লীগের রাজনীতির হাল ধরার পর থেকেই দলের জন্য নিবেদিত হয়েই কাজ করেছি। যুদ্ধাপরাধী দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর রায়কে কেন্দ্র করে সারা দেশের মতোই চকরিয়া-পেকুয়াতে ব্যাপক নাশকতার পরিকল্পনা নিয়ে বিএনপি ও জামায়াত-শিবির যে অপতৎপরতা শুরু করেছিল, তা নেতাকর্মীদের নিয়ে কঠোরভাবে দমন করেছি।’ তিনি আরো বলেন, ‘আমি আশা করি, একাদশ সংসদ নির্বাচনে কক্সবাজার-১ আসনে দল আমাকে মনোনয়ন দেবে। আমাকে মনোনয়ন দেওয়া হলে চকরিয়া-পেকুয়ার আপামর জনতা দেখিয়ে দেবে আসলে এই আসনটি কোনো দিনই বিএনপির দুর্গ ছিল না। শুধু প্রার্থীর কারণেই বারবার হোঁচট খেতে হয়েছে দলকে।’

দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মনোনয়ন পাওয়ার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে জাফর আলম বলেন, ‘মমতাময়ী নেত্রী শেখ হাসিনা যখন আমাকে এই আসনে মনোনয়ন দেন তখনই আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন মনোনয়নবঞ্চিত কিছু সিনিয়র নেতা। যাঁদের সঙ্গে বিএনপি নেতা সালাহ উদ্দিনের সঙ্গে গাঁটছড়া রয়েছে। মূলত গুটিকয়েক সিনিয়র নেতার ষড়যন্ত্রের কারণেই আমাকে দেওয়া মনোনয়ন বাগিয়ে নেন জাতীয় পার্টির মোহাম্মদ ইলিয়াছ। তখন দলের প্রধান আমাকে ডেকে আশ্বস্ত করেছিলেন, একাদশ সংসদ নির্বাচনে আমাকেই মনোনয়ন দেবেন। তাই আমার বিশ্বাস, দলের সভানেত্রী এবারও আমাকে মনোনয়ন দেবেন।’

দলের আরেক মনোনয়নপ্রত্যাশী সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, ‘দলের দুঃসময়ে আমিই হাল ধরে রেখেছিলাম। দলের মনোনয়ন পেয়ে বিগত কয়েকটি নির্বাচনে আমি নৌকা প্রতীক নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলাম। কিন্তু দলেরই একটা অংশ বিএনপি-জামায়াতের মতোই আমার বিরুদ্ধে নির্বাচনে কাজ করেছে। এর পরও আমি দল ছেড়ে চলে যাইনি। এখন যাঁরা বলে বেড়াচ্ছেন, মনোনয়ন না দিলে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে নির্বাচন করবেন, আমি তাঁদের মতো নই। আমাকে এবারও দলের মনোনয়ন দেওয়া হবে বলে আমি আশাবাদী। তবে আমাকে ছাড়া অন্য কাউকে দল মনোনয়ন দিলে তাঁর পক্ষেই আমি কাজ করব।’

বিএনপি : দীর্ঘদিন ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপির স্থানীয় নেতাকর্মীরা মনে করছে, বর্তমানে ভারতের শিলংয়ে অবস্থানরত বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা ও সাবেক প্রতিমন্ত্রী সালাহ উদ্দিন আহমদের জনপ্রিয়তাকে পুঁজি করে এই আসনটি আবারও পুনরুদ্ধার হবে। তাদের বিশ্বাস, সালাহ উদ্দিন নির্বাচনের আগে দেশে ফিরবেন এবং নির্বাচন করবেন। সেটা যদি সম্ভব না হয় তাহলে তাঁর সহধর্মিণী সাবেক সংসদ সদস্য হাসিনা আহমেদ প্রার্থী হবেন। এরই মধ্যে দলের চূড়ান্ত প্রার্থী তালিকায় তাঁর নামও রয়েছে বলে তারা জানায়।

হাসিনা আহমেদ বলেন, ‘আমার স্বামী সালাহ উদ্দিন আহমদ চকরিয়া-পেকুয়ার গণমানুষের হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছেন। এলাকায় তিনি বেশ জনপ্রিয়। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি প্রার্থী হবেন—এমনটাই প্রত্যাশা করে সাধারণ ভোটাররা। তবে কোনো কারণে যদি তিনি নির্বাচনে অংশ নিতে না পারেন দল যাঁকেই মনোনয়ন দেবে তাঁর পক্ষেই নির্বাচনী কর্মকাণ্ডে অংশ নেবে নেতাকর্মীরা।’

কক্সবাজার জেলা বিএনপির সভাপতি শাহজাহান চৌধুরী জানান, দলের কেন্দ্রীয় নেতা সালাহ উদ্দিন আহমদের পছন্দের ব্যক্তিই এই আসনে দলের মনোনয়ন পাবেন। এতে কোনো সন্দেহ নেই।

জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক শামীম আরা স্বপ্না জানান, ভারতের শিলংয়ে অবস্থানরত সালাহ উদ্দিন আহমদের মামলা সেই দেশের উচ্চ আদালতে বিচারাধীন। বর্তমানে মামলার কার্যক্রমও অনেকটা শেষ পর্যায়ে। তাই আগামী নির্বাচনে তাঁর প্রার্থী হওয়ার ক্ষেত্রে সমস্যা হবে না। যদিও কোনো কারণে সালাহ উদ্দিন আহমদ প্রার্থী হতে না পারেন তাহলে তাঁর সহধর্মিণীই নির্বাচন করবেন।

জাতীয় পার্টি : বর্তমান সংসদ সদস্য জাতীয় পার্টির কক্সবাজার জেলা শাখার সভাপতি মোহাম্মদ ইলিয়াছের আশা এবারও তাঁকে ‘মহাজোটের’ প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন দেওয়া হবে। তিনি বলেন, ‘আমি এমপি নির্বাচিত হওয়ায় এলাকার মানুষ স্বস্তি পেয়েছিল। নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে এলাকায় ব্যাপক উন্নয়ন কর্মকাণ্ড বাস্তবায়ন করেছি। যার সুফল মানুষ ভোগ করছে। একই সঙ্গে সাংগঠনিকভাবে দলকে বেশ চাঙ্গা করেছি গত সাড়ে চার বছরে। অতএব চকরিয়া ও পেকুয়ায় জাতীয় পার্টি অনেকটা শক্তিশালী।’

জেপি : আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে আবার মহাজোট হলে মনোনয়ন প্রত্যাশা করছেন আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টির (জেপি) প্রেসিডিয়াম সদস্য এ এইচ সালাহ্উদ্দিন মাহমুদ। তিনি কক্সবাজার জেলা পরিষদ ও চকরিয়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলেন। ছিলেন সংসদ সদস্যও।

সালাহ্উদ্দিন মাহমুদ বলেন, ‘দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এই আসনে মহাজোটের প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন দেওয়ার জন্য আমাকে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল কেন্দ্রীয়ভাবে। কিন্তু সেই প্রস্তাব আমি নাকচ করেছিলাম। তবে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যদি দল চায় তাহলে অবশ্যই মহাজোটের প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করব।’

জামায়াত : বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের অন্যতম শরিক জামায়াতে ইসলামীও আগামী নির্বাচনে এই আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য দলের প্রার্থী ঘোষণা করেছে। এই প্রার্থী হলেন চকরিয়া ও পেকুয়া উন্নয়ন ফোরামের চেয়ারম্যান মো. আরিফুর রহমান চৌধুরী মানিক। স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মানিক আগামী নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন বলে জানিয়েছেন জেলা জামায়াতের আমির মোস্তাফিজুর রহমান। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আগামী সংসদ নির্বাচন জোটগতভাবে করা হবে কি না, তা এখনই বলার সময় আসেনি। তাই জামায়াত কেন্দ্রীয়ভাবে এই আসনে আরিফুর রহমান চৌধুরী মানিকের নাম ঘোষণা করে রেখেছে।’

দলটির নেতাকর্মীরা জানায়, আরিফুর রহমান চৌধুরী মানিক এলাকায় বেশ জনপ্রিয়। তিনি চকরিয়া উপজেলা পরিষদের বিগত দুটি নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। কিন্তু মানিকের বিজয় ঠেকাতে বিএনপি দলীয় প্রার্থী দেয়। পরাজিত হলেও রেকর্ডসংখ্যক ভোট পান তিনি। এ কারণে জামায়াত আগেভাগে দলের প্রার্থী হিসেবে মানিকের নাম ঘোষণা করেছে।

পাঠকের মতামত: