ঢাকা,রোববার, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪

চকরিয়ায় জাফরকে হারিয়ে চমক সৃষ্টি করলেন সাঈদী

নিজস্ব প্রতিবেদক, চকরিয়া ::  বৃহত্তর চকরিয়ায় দ্বিতীয় দফা উপজেলা নির্বাচনে কক্সবাজার-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য জাফর আলমকে পরাজিত করে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হলেন ফজলুল করিম সাঈদী। তিনি দ্বিতীয়বারের মতো চকরিয়া উপজেলায় চেয়ারম্যান নির্বাচিত হলেন। এবারেও নির্বাচনের শুরুতে নানা আলোচনা সমালোচনার জম্ম দেন জাফর আলম। শেষ পর্যন্ত ফজলুল করিম সাঈদীর কাছে ধরাশয়ী হলেন চকরিয়ার প্রতাপশালী এ নেতা।

গত ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও বিতর্কিতও কম হননি তিনি। ওই নির্বাচনে কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অবসরপ্রাপ্ত) সৈয়দ মোহাম্মদ ইবরাহিমের কাছে বিপুল ভোটের ব্যবধানে পরাজিত হন।

জানা যায়, জাফর আলম একাদশ সংসদ নির্বাচনে নৌকা প্রতীক নিয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এরআগে পৌরসভার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। পরবর্তীতে উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছিলেন জাফর আলম। একেরপরএক জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হয়ে চকরিয়া-পেকুয়া উপজেলায় অপ্রতিদ্ব›দ্বী হয়ে উঠেন তিনি। জাফর আলম অনেকটা এমপি হওয়ার পর বেপরোয়া হয়ে উঠেন। টানা পাঁচবছর ধরাকে সরা জ্ঞান করেন তিনি। এই আসনে নিজের বলয় তৈরী করে যা ইচ্ছা তাই করেছেন। গত ১৫ বছর ক্ষমতা থাকাকালিন সময়ে তার প্রতিপক্ষ বিএনপি-জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধ করেছিলেন। শুধু বিএনপি-জামায়াত নয় তার হাত থেকে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীও রেহাই পাননি। কোন নেতাকর্মী অন্যায়ের প্রতিবাদ করলেও সাবেক সাংসদ জাফরের হয়রানীর মুখে পড়তেন। জাফর আলম রাজনীতির বলয়ের মধ্যে বেড়ে উঠলেও পরবর্তীতে তিনি অস্ত্রধারী নির্ভর হয়ে পড়েন।

শতাধিক অস্ত্রধারী নিয়ে গড়ে তুলেন জাফর বাহিনী। এই বাহিনী দিয়ে চকরিয়ার চিংড়িজোনে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছেন। তার বাহিনীর নেতৃত্বে চিংড়িঘের দখল, জায়গা জমি দখল, চাঁদাবাজি, গরুচুরি, খাস জমি দখল, চুরি-ডাকাতি নিয়মিত ব্যাপার হয়ে দাড়িয়ে ছিলো। একসময় জাফর অর্থের অভাবে সংসার চালাতে হিমশিম খেতেন। বর্তমানে তিনি শতশত কোটি টাকার মালিক। তার রয়েছে গাড়ি বাড়ি। জাফর একাধিক জমি ও মার্কেটের মালিক। জাফর আলম নির্বাচন আসলে প্রতিদ্ব›দ্বীতার সাহস দেখাতেন। ২০০৪ সালে চকরিয়া পৌরসভার প্রভাবশালী চেয়ারম্যান আনোয়ারুল হাকিম দুলালকে পরাজিত করে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন তিনি। এরপর থেকে নানাভাবে আলোচিত হতে থাকেন জাফর আলম। পরবর্তীতে উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন তিনি। এরপর ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এমপি নির্বাচিত হন। এভাবে একেরপর এক রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে অভাবনীয় উত্থান ঘটে জাফর আলমের।

ফলে কাউকে তোয়াক্কা করতেন না। এমনকী তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে কেউ কাজ করলে তাকে ছাড় দিতেন না। কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের নেতাদের নিয়েও প্রকাশ্যে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য ও গালিগালাজ করতেন। কারও সাথে টানা স্থায়ী সম্পর্কও টিকতো না।

জাফর আলম এমপি নির্বাচিত হওয়ার পর চকরিয়া ও পেকুয়া উপজেলায় আওয়ামী লীগ বাদ দিয়ে গড়ে তুলেন “জাফর লীগ”। গত পাঁচটি বছর এই জাফর লীগ দিয়ে চকরিয়া-পেকুয়ায় আওয়ামী লীগ নিধন, সাধারণ মানুষের জমি দখল, চিংড়িঘের দখল ও সরকারি জমি দখল খুন খারাবিসহ নানা অপকর্ম করতেন। তার ভাতিজা জিয়াবুল ও ভাগিনা মিজানের নেতৃত্বে শতাধিক ক্যাডার নিয়ে বাহিনী গড়ে তুলেন। এই বাহিনীর হাতে চকরিয়ার রাজপথে ৫টি বিএনপি-জামাতের কর্মী নিহত হয়েছে। চিংড়িজোনের চাষীরা থাকতেন আতঙ্কে। তার বাহিনীকে প্রতি মৎস্য জো’য়ে মাছ ও চাঁদা না দিলে দখল হয়ে যেতো চিংড়ি ঘের। এভাবে চাষীরা চাঁদা দিয়ে মাছ চাষ করেছেন। তার অপকের্মর মধ্যে সবচেয়ে বেশি আলোচিত ছিলো “গরুচুরি”। এই বাহিনীর হাতে নিরাপদ ছিলো না চকরিয়ার খামারীরা।

সাবেক এমপি জাফর আলমের ডান হাত হিসেবে পরিচিত বৃহত্তম গরুচোর সিন্ডিকেটের প্রধান সাহারবিল ইউপি চেয়ারমান নবী হোছাইন। নবী হোছাইনের নেতৃত্বে এ অঞ্চলে গরু চুরি স্বাভাবিক ঘটনা হয়ে উঠে। তাকে দিয়ে উপকূলী এলাকায় চিংড়িঘেরে ডাকাতি ও গরুচুরি করানো হতো বলে অভিযোগ রয়েছে জাফর আলমের বিরুদ্ধে। নবী হোছাইন একাধিকবার গ্রেফতার বা তার বিরুদ্ধে মামলা হলেও এমপি জাফর আলমের সহযোগিতায় পার পেয়ে যেতো। তার ক্যাডার জিয়াবুল, মিজান, শওকত, আজিম, ও রুবেলের হাতে হামলা ও নির্যাতনের শিকার হয়েছেন মাতামুহুরী থানা আওয়ামী লীগের বর্তমান সভাপতি মহসিন বাবুল, সাংগঠনিক সম্পাদক ইকবাল দরবেশী ও উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি মারুফ হোসেন। সর্বশেষ হামলার শিকার হন চকরিয়া প্রেসক্লাবের যুগ্ম সধারণ সম্পাদক সাংবাদিক মোহাম্মদ উল্লাহ। সাংবাদিক মোহাম্মদ উল্লাহকে সহযোগিতা করার অপরাধে জাফর আলম সরাসরি প্রাণনাশের হুমকি দেন প্রেসক্লাবের সভাপতি জাহেদ চৌধুরীকে। ওইসময় সাংবাদিক জাহেদ চৌধুরী চকরিয়া সাধারণ ডায়েরিও করেছেন।

গত পাঁচটি বছর পরিক্ষিত ও ত্যাগী নেতাদের বাদ দিয়ে গড়ে তুলেন একটি হাইব্রিড জাফর লীগ। এই জাফর লীগ দিয়ে দল চালাতেন তিনি। তার সিদ্ধান্তের বাইরে গেলেই মৌখিক নির্দেশে কমিটি ভেঙ্গে দেয়া হতো। সেখানে জাফর আলমের অনুসারী বা স্বজনদের পদে বসিয়ে দল চালাতেন। এভাবে একেরপরএক অপরাধের কারণে মুখ ফিরিয়ে নেন ত্যাগী আওয়ামী লীগ, অঙ্গ ও সহযোগি সংগঠনের নেতাকর্মীরা। ক্ষমতার দাম্ভিকতায় এসবের কিছুই পাত্তা দেননি তিনি। টাকা ছাড়া কোন কথাই বলতেন না জাফর আলম। জাফর আলমের আশ্রয় প্রশ্রয়ে ভয়ঙ্কর হয়ে উঠে তার পুত্র তানভির আহমদ সিদ্দিকী তুহিনও। এমপি পুত্র হওয়ায় আলাদা বাহিনী গড়ে তুলে নানা অপকর্ম চালিয়ে যেতেন। তুহিন স্বাধীন মঞ্চ নামে একটি সংগঠন করে। সেই সংগঠনে জামায়াত শিবির, ছাত্রদল ও কিছু অছাত্র দিয়ে এই সংগঠটনির কার্যক্রম চালাতো সে। তার পিতার মতের বিরুদ্ধে গেলে এই সংগঠনের সদস্য দিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অপপ্রচার চালাতেন। এক ধরণের জিম্মী করে জাফর আলমের পক্ষে কাজ করার জন্য বাধ্য করতেন। সিনিয়র আওয়ামী লীগ নেতাদের বিরুদ্ধে ফেসবুকে সমালোচনা করা যেন নিয়মিত ব্যাপার ছিলো। তার অপকর্মে সহযোগিতা করতেন জাফর আলম। পুত্র তুহিনের এসব কাজকে আরও উৎসাহ দিতেন তিনি। এরফলে তুহিন দিনদিন বেপরোয়া হয়ে উঠেন। এভাবে সাধারণ জনগণ মুখ ফিরিয়ে নেয় জাফর আলমের কাছ থেকে। নানা বির্তকিত কর্মকান্ডে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চক্ষুসুল হয়ে উঠেন তিনি।

এবারের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন থেকে ছিড়কে পড়েন তিনি। প্রধানমন্ত্রী নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর নির্দেশ দিলেও তা মানেননি। শেষপর্যন্ত জাফর স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে বর্তমান সংসদ সদস্য সৈয়দ মোহাম্মদ ইবরাহিমের কাছে বিপুল ভোটে হেরে যান। সর্বশেষ ২১ মে চকরিয়া উপজেলা পরিষদ নির্বাচনেও প্রতিদ্ব›দ্বীতা করে জাফর আলম। সেখানেও বিপুল ভোটের ব্যবধানে দ্বিতীয় বারোর মতো উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন ফজলুল করিম সাঈদী। ফলাফলে ফজলুল করিম সাঈদী (দোয়াত কলম) প্রতীকে ৫৯৯৫৩ ভোট পেয়ে পুনরায় উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন। তাঁর নিকটতম হয়েছেন সাবেক এমপি জাফর আলম। তিনি ঘোড়া প্রতীকে পেয়েছেন ৫৮২৮২ ভোট।

পাঠকের মতামত: