ঢাকা,রোববার, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪

ক্যাম্প থেকে উধাও লক্ষাধিক রোহিঙ্গা

অনলাইন ডেস্ক ::
গত তিন বছরে জন্মেছে ৭৬ হাজার শিশু। তবুও, উখিয়া ও টেকনাফের রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্পগুলোতে শরণার্থীর সংখ্যা এ বছরের জুলাই পর্যন্ত কমে দাঁড়িয়েছে ৮ লাখ ৬০ হাজারে মতো।

আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সমন্বিত ইন্টার সেক্টর কো-অর্ডিনেশন গ্রুপের (আইএসসিজি) প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৮ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত সেখানকার জনসংখ্যা ছিল প্রায় নয় লাখ ৫৭ হাজার।

সচেতন নাগরিক, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও শরণার্থীদের নিয়ে কাজ করা স্থানীয় বেসরকারি সংস্থাগুলো বলছে, অনেকেই চিরদিনের জন্য ক্যাম্প ছেড়ে চলে গেছেন। অনেকেই আবার নির্দিষ্ট সময়ের জন্য ক্যাম্পের বাইরে গিয়ে থাকেন।

রোহিঙ্গাদের বড় অংশ উধাও হয়ে যাওয়া নিয়ে জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর প্রতিনিধিরা নীরব। অন্যদিকে, সরকারি কর্মকর্তারা রোহিঙ্গাদের ক্যাম্প ছেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনাকেই অস্বীকার করেছেন।

শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) মোহাম্মদ মাহবুব আলম তালুকদার দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘ক্যাম্প থেকে রোহিঙ্গাদের পালানোর কোনো সুযোগ নেই।’

তিনি আরও বলেন, ‘এখানকার পরিবেশ সেরকম না। এখানে শরণার্থীরা যথাযথ খাদ্য ও চিকিত্সা সুবিধা পেয়ে থাকেন।’

এমনকি আইন প্রয়োগকারী কর্মকর্তাদের অজান্তে কোনোভাবে ক্যাম্প ছেড়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করতে পারলেও তারা কয়েক দিন পরই ফিরে আসেন বলেও জানান তিনি।

তিনি বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের মধ্যে কেউ যদি বিনা অনুমতিতে ক্যাম্পের বাইরে চলে যান, তবে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা তাদের আটক করে শিবিরে ফিরিয়ে আনেন।’

‘তালিকাভুক্ত রোহিঙ্গারা ক্যাম্প থেকে নিখোঁজ হয়ে গেছে এমন কোনো তথ্য আমার কাছে নেই’, বলেন মোহাম্মদ মাহবুব আলম তালুকদার।

সংখ্যার পার্থক্য

কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শিবিরে কর্মরত জাতীয় ও আন্তর্জাতিক এনজিও ও জাতিসংঘের সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয়কারী প্ল্যাটফর্ম আইএসসিজি প্রতিমাসে তাদের কাজ সম্পর্কে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে থাকে।

২০২০ সালের জুলাই মাসের প্রতিবেদনে দেখা গেছে যে, সবগুলো ক্যাম্প মিলিয়ে মোট রোহিঙ্গা শরণার্থীর সংখ্যা আট লাখ ৬০ হাজার ৪৯৪ জন।

২০১৭ সালের আগস্ট মাসে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে নৃশংসতা ও শরণার্থীদের আগমনের পরে ২০১৭ সালে ১৬ সেপ্টেম্বর তারা একটি প্রাথমিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল। ওই প্রাথমিক প্রতিবেদন বলছে, এক মাসে চার লাখ ৮০ হাজারের মতো রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এসেছিলেন এবং এর আগেই কক্সবাজার এলাকায় দুই লাখ ১২ হাজারের মতো রোহিঙ্গা বাস করছিলেন।

২০১৮ সালের ডিসেম্বরে প্রকাশিত ‘রোহিঙ্গা মানবিক সংকটের জন্য যৌথ প্রতিক্রিয়া পরিকল্পনা ২০১৯’ শিরোনামে আইএসসিজি প্রকাশিত এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর সাত লাখ ৪৫ হাজার রোহিঙ্গা কক্সবাজারে আসেন।

সুতরাং, এ সংখ্যা থেকে অনুমাণ করা যায় যে, দেশে মোট রোহিঙ্গার সংখ্যা ২০১৮ সালের শেষ নাগাদ বেড়ে প্রায় নয় লাখ ৫৭ হাজারে পৌঁছে।

২০১৯ সালের যৌথ প্রতিক্রিয়া পরিকল্পনা ও এপ্রিল মাসে প্রকাশিত আইএসসিজির রিপোর্টের মূল্যায়নে মোট রোহিঙ্গা শরণার্থীর সংখ্যা নয় লাখ নয় হাজার হিসেবে দেখানো হয়েছিল।

শরণার্থীদের নিয়ে কাজ করা এক এনজিও কর্মকর্তা বলেন, ‘ক্যাম্পগুলোতে নবজাতক শিশুসহ মোট শরণার্থীর সংখ্যা ১০ লাখের বেশি হওয়া উচিত।’

২০১৮ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের ৭৩তম সাধারণ পরিষদে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জানিয়েছিলেন, বাংলাদেশে এক দশমিক এক মিলিয়ন (১১ লাখ) রোহিঙ্গা শরণার্থী আছে।

আইএসসিজির রিপোর্টে দেখা গেছে, উখিয়া উপজেলার রাজাপালং ইউনিয়নের কুতুপালং ওয়ার্ডে অবস্থিত সবচেয়ে বড় রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বর্তমানে পাঁচ লাখ ৯৮ হাজার শরণার্থী আছেন।

তবে, ২০১৮ সালের ডিসেম্বর মাসে ছয় লাখ ২৮ হাজার রোহিঙ্গা সেখানে বাস করত।

২০১৮ সালের ডিসেম্বরে লেদা রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ৩৩ হাজার ৫৪০ জন শরণার্থী ছিল; এ বছর জুলাই মাসে সংখ্যাটি কমে ২৫ হাজার ৯৬৬ জনে দাঁড়িয়েছে। নয়াপাড়ার ক্যাম্পেও নিবন্ধিত ২৬ হাজার ৯৩০ জন শরণার্থীর সংখ্যা কমে গিয়ে ২২ হাজার ৩৩৫ জনে দাঁড়িয়েছে। আলিখালী, আনচিপ্রাং, বাগঘোনা ও পটিবুনিয়া এবং শ্যামলাপুর রোহিঙ্গা ক্যাম্পেও শরণার্থীর সংখ্যা কমেছে।

কিছু ক্ষেত্রে বিভিন্ন ক্যাম্পজুড়ে শরণার্থীদের পুনর্বাসনের কারণে সংখ্যার পার্থক্য হলেও, তাতেও এখানে ৪০ হাজারেরও বেশি শরণার্থীর পার্থক্য থেকে যাচ্ছে। এর বাইরে, সেভ দ্য চিলড্রেনের তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালের মে পর্যন্ত গত তিন বছরে ক্যাম্পগুলোতে জন্মানো ৭৬ হাজার নবজাতক তো আছেই।

‘ক্যাম্পগুলো সুরক্ষিত নয়’

আইএসসিজির সঙ্গে কর্মরত এক কর্মকর্তা পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘২০১৭ সালে রোহিঙ্গাদের প্রবেশের পরে প্রথম আদমশুমারির সময় অতিরিক্ত ত্রাণ পাওয়ার আশায় শরণার্থীদের মধ্যে অনেকেই তাদের নাম একাধিকবার তালিকাভুক্ত করেছেন। পরে বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে নিবন্ধনের পর সংখ্যাটি কমে আসে।’

ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘অনেক রোহিঙ্গাই ক্যাম্প ছেড়ে গেছে। যাদের আর্থিক অবস্থা কিছুটা ভালো, তারা কক্সবাজারে বাসা ভাড়া নিয়ে সেখানে থাকছেন। যারা সক্ষম ছিলেন তারা বিদেশে গেছেন। তবে, এরকম শরণার্থীর সংখ্যা কেবল কয়েক হাজার পর্যন্ত হতে পারে।’

তবে, এ বিষয়ে স্থানীয় প্রতিনিধি ও শরণার্থীদের জন্য কর্মরত এনজিও’র কর্মকর্তারা ভিন্ন তথ্য দিয়েছেন। তারা জানান, রোহিঙ্গারা প্রায় এক বা দুই মাস পর্যন্ত টানা ক্যাম্পের বাইরে ঘুরতে যান। কয়েকজন রোহিঙ্গা স্থানীয়দের বিয়েও করেছেন এবং চট্টগ্রাম, কক্সবাজারের অন্যান্য অংশ ও বান্দরবানে থাকতে শুরু করেছেন।

ক্যাম্প ছেড়ে আসা শরণার্থীদের মধ্যে অধিকাংশই মাছ ধরার ট্রলার ও নির্মাণ সাইটে শ্রমিক হিসেবে কাজ করছেন বলে জানা গেছে।

কক্সবাজার সিভিল সোসাইটি ও এনজিও প্ল্যাটফর্মের (সিসিএনএফ) কো-চেয়ারম্যান আবু মোর্শেদ চৌধুরী খোকা জানান, কাজের জন্য রোহিঙ্গাদের ক্যাম্পের বাইরে চলে যাওয়া একটি ‘ওপেন সিক্রেট’।

২০১৭ সালে রোহিঙ্গাদের আগমনের পর থেকে তাদের নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন কোস্ট ট্রাস্টের নির্বাহী পরিচালক রেজাউল করিম চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় বিলম্ব হওয়ার কারণে রোহিঙ্গারা ক্যাম্প ছাড়তে ও বাংলাদেশি সমাজের সঙ্গে মিশে যেতে মরিয়া হয়ে পড়েছেন।’

কক্সবাজার-টেকনাফ সড়কে কয়েকটি চেকপোস্ট রয়েছে বলে জানান তিনি। তবে, ক্যাম্পগুলোর আশেপাশের পাহাড়ে কোনো নজরদারি নেই।

‘তারা যদি এই পাহাড়ের ওপর দিয়ে ক্যাম্প থেকে বের হতে চান, তবে তাদেরকে আটকানোর কেউ নেই’, বলেন তিনি।

রেজাউল করিম চৌধুরী জানান, আরও দেরি হওয়ার আগেই প্রশাসনের এ বিষয়ে সর্তক হওয়া উচিত।

রাজাপালং ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর কবির চৌধুরী বলেন, ‘চারদিকে সীমানা প্রাচীর না থাকায় রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্পগুলো সুরক্ষিত না। সুতরাং, কয়েক হাজার রোহিঙ্গার ওপর নজর রাখা মুষ্টিমেয় পুলিশ বাহিনীর পক্ষে অসম্ভব।’

তিনি জানান, কেউ কেউ ক্যাম্পের বাইরে কিছু দিন কাটানোর পর ফিরে আসেন। আবার কেউ কেউ সেটা করেন না।

স্থানীয় কয়েকটি সূত্র দ্য ডেইলি স্টারের স্থানীয় সংবাদদাতাকে জানায়, বান্দরবানে প্রায় তিন হাজার রোহিঙ্গা পরিবার বসতি স্থাপন করেছে।

বান্দরবানের আলীকদম উপজেলার ভাইস চেয়ারম্যান কফিল উদ্দিন বলেন, ‘গত সাত থেকে আট বছর ধরে প্রায় চার শ পরিবার আলীকদম উপজেলায় বসতি স্থাপন করেছে। এমনকি আলীকদমে বার্মাইয়া (বার্মিজ) পাড়া নামে একটি গ্রামও আছে।’

বান্দরবান সদর উপজেলার সুয়ালক ইউনিয়নের চেয়ারম্যান উক্যনু মারমা বলেন, ‘২০০৭-০৮ সালের আগে এখানে কোনো রোহিঙ্গা পরিবার ছিল না। তবে, এখন এই ইউনিয়নে দুই শটিরও বেশি রোহিঙ্গা পরিবার বসবাস করছে।’

‘তাদের মধ্যে প্রায় ৫০টি রোহিঙ্গা পরিবার ভোটার তালিকায়ও নিবন্ধিত আছে’, বলেন তিনি।

বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তের নিকটবর্তী ইউনিয়ন পালংখালীতেও প্রচুর সংখ্যক রোহিঙ্গা বসবাস করেন।

পালংখালী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান এম গফুর উদ্দিন চৌধুরী বলেছেন, ‘রোহিঙ্গারা নির্দ্বিধায় এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় চলে যায়। অনেকেই বাংলাদেশি পাসপোর্ট নিয়ে বিদেশেও চলে গেছে।’

গত বছর ৩ সেপ্টেম্বর পাসপোর্ট পাওয়ার চেষ্টা করতে গিয়ে ২৫ বছর বয়সী এক রোহিঙ্গা শরণার্থীকে চট্টগ্রাম পাঁচলাইশ পাসপোর্ট অফিস থেকে আটক করা হয়েছিল। তার কাছে একটি নিবন্ধিত বাংলাদেশি জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) পাওয়া যায়।

গত বছর চট্টগ্রাম পুলিশ ও পাসপোর্ট কর্মকর্তারা জানান, বেশ কয়েকজন রোহিঙ্গা শরণার্থী কিছু স্থানীয় ও রোহিঙ্গা দালালদের সহায়তায় জাল এনআইডি কার্ড ব্যবহার করে বাংলাদেশি পাসপোর্ট তৈরি করছে।

তারা আরও জানান, নির্বাচন কমিশনের কয়েকজন দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তারাও টাকার বিনিময়ে রোহিঙ্গাদের কাছে ভুয়া এনআইডি কার্ড সরবরাহ করার সিন্ডিকেটে জড়িত।

সিসিএনএফ’র আবু মোর্শেদ জানান, রোহিঙ্গা ক্যাম্পের নারী ও শিশুরা প্রায়ই পাচারকারীদের সহায়তায় সমুদ্রপথে মালয়েশিয়া যাওয়ার চেষ্টা করে।

চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে সেন্টমার্টিন দ্বীপের কাছে অবৈধ পথে বিদেশ যাওয়ার সময় এমনই একটি নৌকা কমপক্ষে ১৪ জন রোহিঙ্গাসহ ডুবে যায়। নৌকাটিতে সবাই নারী ও শিশু ছিলেন বলে জানা গেছে।

মে মাসে রোহিঙ্গাদের বহনকারী একটি নৌকা মালয়েশিয়ায় প্রবেশ করতে না পেরে বাংলাদেশে ফিরেছিল। এই বছরের শুরুর দিকে কয়েক সপ্তাহ ধরে সমুদ্রে আটকে থাকা এমন বেশ কয়েকটি জাহাজের একটিকে নৌবাহিনীর সদস্যরা উদ্ধার করেন।

পাঠকের মতামত: