ফাইল ছবি…..
মহেশখালী প্রতিনিধি :::
উপকূলীয় দ্বীপাঞ্চল মহেশখালীর দুর্গম পাহাড়ে অবৈধ অস্ত্র তৈরী ও বেচা–কেনা যেন থেমে নেই। ২০০৬ সালে জরুরি অবস্থায় সারা দেশে পরিচালিত ‘অপারেশন ক্লিনহার্ট’–এ উপজেলাভিত্তিক সব চেয়ে বেশী পরিমাণ দেশিয় তৈরী অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারের তকমা লেগেছিল এই উপজেলার গায়ে। সেই থেকে অস্ত্র তৈরী ও সন্ত্রাসের জনপদ হিসেবে পরিচিতি রয়েছে এই উপজেলার। অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহার, হত্যা, চিংড়ি ঘের দখল, সাগরে জলদস্যুতা ও প্যারাবন নিধন এখানা কার নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা।
জনপ্রতিনিধিরা জানান, গত ১০ বছরে আইন–শৃঙ্খলা বাহিনী এ দ্বীপের দুর্গম পাহাড়ে বহুবার অভিযান চালিয়েছে। এতে শত শত অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার ও বেশ কয়েকজন অস্ত্র তৈরির কারিগরকে গ্রেপ্তার করলেও পাহাড়ে অস্ত্র তৈরী কিন্তু থেমে নেই। নতুন নতুন ভাবে গড়ে উঠছে অস্ত্র তৈরির কারখানা। এছাড়া গ্রেপ্তার
হওয়া অস্ত্র কারিগররা মামলা থেকে জামিনে বেরিয়ে এসে পুনরায় শুরু করছেন এ অবৈধ পেশা। ফলে এখনো পাহাড়ে সক্রিয় রয়েছে অন্তত ১০টিরও বেশি অস্ত্র তৈরির কারখানা। এসব কারখানায় অস্ত্র তৈরির কাজে জড়িত রয়েছেন অন্তত অর্ধশত কারিগর। সেখানে হাত বাড়ালেই পাওয়া যায় অস্ত্র। স্থানীয়ভাবে নারী– পুরুষের সমন্বয়ে গড়ে উঠা বেশ কয়েকটি অস্ত্র ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট দেশের বিভিন্ন স্থানে এ অস্ত্র বেচা–কেনার চালান পৌঁছে দেয়ার কাজে জড়িত বলে অভিযোগ সচেতন মহলের।
মহেশখালীর বিভিন্ন ইউনিয়নে সরেজমিনে ঘুরে এলাকার নির্ভরযোগ্য একাধিক সূত্র থেকে পাওয়া খবরে জানা যায়, মহেশখালীর গহীন পাহাড়ি দুর্গম এলাকা উপজেলার ছোট মহেশখালী ইউনিয়নের আওতাধীন মুরিছড়ী, বত্তাতলী, বড়মহেশখালী ইউনিয়নের চৌচলা, পাহাড়তলী, ফুটের ঝিরি, হোয়ানক ইউনিয়নের পানির ছড়া বাজারের সংলগ্ন পূর্ব পাশের পাহাড়, কেরুণতলীর পূর্ব পাশে তোতার ঝিরি, করইবন্যা ঘোনা, পূর্ব কালাগাজীর পাড়ার পূর্বপাশে তেরশলবইন্যা ও কালারমার ছড়া ইউনিয়নের নোনাছড়ির পূর্ব পাশের পাহাড়সহ অন্তত ১০টি পাহাড়ি স্পটে অবৈধ অস্ত্র তৈরির কারখানায় রাতদিন অস্ত্র তৈরির কাজ করছে স্থানীয় অর্ধশতাধিক কারিগর।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এসব এলাকার সচেতন কিছু নাগরিক জানান, ওই সব কারখানায় দো–নলা বন্দুক ও পিস্তল ছাড়াও দেশিয় ভাবে রাইফেল তৈরিতে কারিগররা দক্ষ। এসব কারখানায় মাত্র দেড় হাজার টাকায় অস্ত্র মিলে বলে জানায় এলাকাবাসী। এছাড়া প্রকারভেদে কিছু অস্ত্রের দাম ১০/১৫ হাজার টাকারও বেশি। পুলিশ, র্যাব ও বিভিন্ন সংস্থা থেকে প্রাপ্ত তথ্য মতে, এ দ্বীপে গত ১০ বছরে বিভিন্ন অভিযানে অন্তত ১২টি অস্ত্রের কারখানার সন্ধান পেয়েছে আইন–শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। গ্রেফতারও হয়েছেন কমপক্ষে ৩০ জন অস্ত্র কারিগর। তবুও থামেনি অস্ত্র তৈরি ও বেচা–কেনার জমজমাট এই ব্যবসা।
জানা যায়, বড় মহেশখালী ইউনিয়নের পাহাড়তলী এলাকার গহিন জঙ্গলে গত বুধবার সকালে একটি অস্ত্রের কারখানায় অভিযান চালায় র্যাব। সেখান থেকে দু’জন কারিগরকে আটক করা হয়। এতে জব্দ করা হয়েছে ২২টি দেশিয় তৈরী বন্দুকসহ বিপুল পরিমাণ অস্ত্র তৈরির সরঞ্জাম। গ্রেপ্তার করা হয় ওই এলাকার আবদুল মাবুদ ও ছোট মহেশখালীর আবু তাহের নামক দুই কারিগরকে। র্যাব সূত্র জানায়, এদের মধ্যে আবদুল মাবুদ ইতঃপূর্বেও অস্ত্র তৈরির কারখানা থেকে গ্রেপ্তার হয়ে জেল খেটে জামিনে বেরিয়ে এসে পুনরায় অস্ত্র তৈরিতে জড়িয়ে পড়েছেন।
র্যাব–৭ কক্সবাজার ক্যাম্পের কমান্ডার আশেকুর রহমান বলেন, মহেশখালীর পাহাড়ে সংঘবদ্ধ অস্ত্র ব্যবসায়ীরা কারখানা গড়ে তুলে দেশিয় অস্ত্র তৈরি করছেন। সেসব অস্ত্র স্থানীয় সন্ত্রাসী, অস্ত্র ব্যবসায়ী, রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী, জলদস্যু ও ডাকাতরা কিনছে। নিবিড় পর্যবেক্ষণ ও গোয়েন্দা তৎপরতার ভিত্তিতে র্যাব অভিযান শুরু করেছে। তিনি আরও বলেন, ইতোমধ্যে অস্ত্র ব্যবসার সঙ্গে জড়িত অনেকের নাম–পরিচয় পাওয়া গেছে। সিন্ডিকেট সদস্যদেরও গ্রেফতারে চেষ্টা চলছে। পুলিশের সহযোগিতা নেওয়া হচ্ছে। পাশাপাশি স্থানীয়দের কাছে সহযোগিতা চাওয়া হয়েছে।
দীর্ঘ ১৮ কি.মি. উত্তর–দক্ষিণ লম্বা এই দ্বীপকে বিভক্ত করেছে পাহাড়। এ সুযোগে দুর্গম পাহাড়কে নিরাপদ আশ্রয় হিসেবে ব্যবহার করছে সন্ত্রাসী ও অস্ত্র কারিগররা। মহেশখালীর হোয়ানকের কালাগাজীর পাড়া এলাকার বাসিন্দারা জানান, দুর্গম পাহাড়ি এলাকা আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যদের জন্যও নিরাপদ নয়। ইতঃপূর্বে পাহাড়ে অস্ত্র কারখানায় অভিযানে গিয়ে সন্ত্রাসীদের গুলিতে পুলিশের এসআই পরেশ কুমার কারবারি নিহত হয়েছেন। এছাড়া অস্ত্র ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের হাতে খুন হয়েছে আরও অনেকই। এ দ্বীপের সব চেয়ে বেশী খুনোখুনির ঘটনা ঘটে হোয়ানকের কালাগাজীর পাড়া ও কালারমার ছড়া ইউনিয়নের মোহাম্মদ শাহ ঘোনায়।
কালারমারছড়ার একাধিক ব্যক্তি জানান, গত ২ বছরে শুধু এ ইউনিয়নে খুন হয়েছেন ১৩ জন। এলাকায় রয়েছে বেশ কয়েকটি সন্ত্রাসী বাহিনী। তাদের মধ্যে প্রতিনিয়ত বন্দুকযুদ্ধের ঘটনা ঘটে। স্থানীয়রা জানান, এ ইউনিয়নে দুই বছরে ছয়টি অস্ত্রের কারখানার সন্ধান পাওয়া গেছে।
মহেশখালী থানার অফিসার ইনচার্জ বাবুল চন্দ্র বনিক জানান, দুর্গম পাহাড়ি এলাকা হওয়ায় পুলিশ অভিযানে যাওয়ার আগেই অস্ত্র ব্যবসায়ী ও কারিগররা নিরাপদে সরে পড়েন। তার পরেও গত ৮/৯ মাসে মহেশখালীতে প্রায় ৩৮টি অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে এবং বেশ কয়েকজন অস্ত্র কারিগরকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আগামীতেও অস্ত্র উদ্ধার অভিযান অব্যাহত থাকবে।
পাঠকের মতামত: