ঢাকা,শনিবার, ১৬ নভেম্বর ২০২৪

বন্যা-বৃষ্টি থেকে বাঁচতে সমতল ছেড়ে পাহাড়ে সবজি চাষ

নিজস্ব প্রতিবেদক, চকরিয়া ::

বন্যা-বৃষ্টি থেকে বাঁচতে গ্রাম ছেড়ে পাহাড়ি এলাকায় গিয়ে সবজি চাষ করছেন তরুণ কৃষকরা। ব্যবসা, ব্যাংকার, চাকরি ও অন্য পেশার পাশাপাশি এই সবজিচাষে দারুণভাবে সফল হয়েছেন এবং আর্থিকভাবে লাভবানও হচ্ছেন তাঁরা। দুই বছর ধরে তাঁদের সফলতা দেখে নতুন অনেকে আগ্রহী হয়েছেন এই সবজিচাষে।

মূলত সমতল এলাকার তুলনায় পাহাড়ের সড়ক যোগাযোগ অনেক উন্নত হওয়া, পাহাড়ে কৃষিজমির আবাদে খরচ কম, তুলনামূলক সস্তা শ্রম এবং ভালো দাম পাওয়ায় সবজি চাষ বাড়ছে লামা-আলীকদমের পাহাড়ি এলাকায়।

তবে উৎপাদিত সবজি পরিবহন করতে গিয়ে লামা এলাকায় পথে পথে বিভিন্ন নামে ইচ্ছেমতো টোল আদায় হচ্ছে কোনো জমা রসিদ ছাড়াই। ইউনিয়ন পরিষদ, জেলা পরিষদের নামে এসব টোল আদায় হচ্ছে। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে উঠছেন কৃষকরা।

সমতল এলাকা চকরিয়ার কাকারা ইউনিয়ন ছেড়ে পার্বত্য লামার রূপসিপাড়ায় গিয়ে প্রথম সবজি চাষ করেন আল মদিনা হার্ডওয়্যারের মালিক আমজাদ হোসেন। তিনি বলেন, ‘গতবছর এলাকার বন্ধু-বান্ধবদের অনেকের সবজি ক্ষেত দেখে আমি অনুপ্রাণিত হই। বন্ধু-ছোটভাইদের সাথে জোট বেঁধে এই প্রথম সবজি চাষ করছি, ফলন ভালো হয়েছে দামও পাচ্ছি। এতে করে খাবারের সবজি পেলাম, বাড়তি কিছু আয়ও হলো।’

আরএফএল সাইকেলের চকরিয়ার ডিলার মোদাচ্ছেরুল হক সোহাগ গতবার ছোট পরিসরে লামার পাহাড়ে সবজি চাষ করে ভালোই সফল হয়েছিলেন। এবার বড় পরিসরে সবজি চাষে নেমেছেন। তিনি বলেন, ‘বর্ষাকালে ব্যবসার চাপ বেশি থাকে না। আগে ব্যবসার ফাঁকে সবজি চাষে সময় দিতাম, এখন সময় বের করেই সবজি চাষে সময় দিচ্ছি। লাভ তো আছেই মানসিক শান্তিও খুঁজে পাচ্ছি।’

তরুণ কৃষক আবু তাহের শসা-চিচিঙ্গা-ঢেঁড়স চাষে কাকারায় ব্যাপক সফলতা দেখালেও বিগত বেশ কয় বছর বর্ষায় কোনো সবজিই চাষ করতে পারেননি। একের পর এক বন্যায় সব তলিয়ে যাওয়ায় পুঁজি হারিয়ে পথে বসেছিলেন। তিনি বলেন, ‘বর্ষায় সমতল এলাকায় সবজি আবাদ অসম্ভব একটা বিষয়। অথচ পাহাড়ে নিশ্চিন্তভাবে সবজি আবাদ করছি। আড়তদাররা সবজি ক্ষেতের সামনে থেকে ট্রাকভর্তি হয়ে চট্টগ্রাম, কক্সবাজার এমনকি কুমিল্লার নিমসা পর্যন্ত নিয়ে যাচ্ছেন। বর্ষা শেষে আবার গ্রামে ফিরে সবজি আবাদ করব।’

আবদুর রাজ্জাক পেশায় চকরিয়ার ইলেকট্রিক সামগ্রী ব্যবসায়ী ও বিসমিল্লাহ ইলেকট্রিক স্টোরের মালিক। এলাকার তরুণদের সাথে তিনিও এবার ১২ কানি জমিতে চিচিঙ্গা ও খিরা ক্ষেতে বড় অঙ্কের বিনিয়োগ করেছেন। ক্ষেতের পাশে অস্থায়ী খামার বাড়ি তৈরি করে দিয়েছেন শ্রমিকদের থাকা-খাওয়ার জন্য, সপ্তাহে দুদিন গিয়ে সেখানে থেকে সবজি উৎপাদন-বিপণন তদারকি করছেন। তিনি বলেন, ‘বর্ষার এই সময়ে সবজির আকাল থাকে। চাহিদার বিপরীতে সংকট থাকে প্রচুর। আবাদ-উৎপাদন বাড়ানোর পরও সরবরাহ দিতে পারি সামান্যই।’

বর্তমানে লামার রূপসিপাড়া গ্রামের ছোট ছোট পাহাড়ি টিলায় বেশি উৎপাদন হচ্ছে চিচিঙা ও শসার। এছাড়া তিতকরলা, কাঁকরোল, লাউ ও ঝিঙা উৎপাদন হচ্ছে। এবার সেখানে গত বছরের দ্বিগুণ অর্থাৎ ৪০০ কানি জমিতে সবজি আবাদ হয়েছে জানিয়ে সবজি ও বীজ ব্যবসায়ী আবু বকর বলেন, ‘আবাদ ও উৎপাদন এত বেশি বেড়েছে গতবছরের তুলনায় দাম কম পাচ্ছে কৃষক। তবে বন্যা শুরু হলে দাম আবারও বেড়ে যাবে।’

প্রথমবার সবজি চাষ করতে আসা ব্যাংকার মোরশেদ কামাল বলেন, ‘সবজি ক্ষেত করতে গিয়ে দেখেছি স্থানীয় কৃষি অফিসের কোনো যোগাযোগ নেই। রোগ-বালাই দমন, সার প্রয়োগ বিভিন্ন ও বীজের মান নির্ধারণে তাদের কোনো ভূমিকা নেই। কৃষকরা নিজ অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে এই সবজি চাষে সফলতা দেখাচ্ছে। তাদের কার্যকর সহযোগিতা পেলে আমরা বিষমুক্ত ও দেশিয় এই সবজি বিদেশে রপ্তানি করতে পারতাম।’

মালয়েশিয়া থেকে দেশে ফিরে সবজি চাষ করছেন কাকারার বাসিন্দা আবদুল মতলব। তিনি বলছেন, ‘বিদেশে যে পরিমান শ্রম দিয়েছি সে পরিমাণ পরিশ্রম এখানে দিলে দশগুণ বেশি লাভ করা যায় এবং সুখেও থাকা যায়। প্রথমবার সবজি ক্ষেত করেই ভালোই লাগছে।’

অন্য চাষিদের চেয়ে ব্যতিক্রমী বেগুন ও মিষ্টিকুমড়া চাষ করছেন আবু সায়েম ও আবদুল হামিদ। তিনি বলছেন, ‘সবজি চাষ করেন ও বৃষ্টি যত বাড়ে ততই সবজির চাহিদা বেড়ে যায় আর দামও বাড়ে। প্রতিদিন এই এলাকা থেকে দুই হাজার কেজি সবজি যাচ্ছে চট্টগ্রামের আড়তে। আড়তদারদের অনেকেই এখানে এসেই সবজি কিনছেন আবার অনেক কৃষক নিজ উদ্যোগে সবজি নিয়ে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার নিচ্ছেন। সবজি চাষে সফলতা দেখে স্থানীয় পাহাড়িরাও উৎসাহিত হচ্ছেন।’

কৃষকরা জানান, সেখানে সবচেয়ে বেশি চাষ হচ্ছে চিচিঙার। প্রতিকেজি বিক্রি হচ্ছে এখন ১০ টাকা। প্রথমদিকে এই সবজি ছিল ১৮ টাকা, এরপর কমতে কমতে ১০ টাকা আট টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়েছিল। শসা বিক্রি হচ্ছে কেজি ১৮ টাকা, খিরা ১১ টাকা, কাঁকরোল ১৫ টাকা, তিতকরলা ১২ টাকা এবং লাউ ৮ টাকা কেজিদরে বিক্রি হচ্ছে।

সবজি চাষে আবাদ ও উৎপাদন বাড়ায় সড়কে চলতে গিয়ে ইচ্ছেমতো টোল আরোপ করেছে ইজারাদাররা। কৃষকরা বলছেন, রূপসিপাড়া থেকে বের হওয়ার সময় প্রথমে ইউনিয়ন পরিষদের পক্ষ থেকে টোল আদায় করা হচ্ছে ছোট ট্রাকে ৫০০ টাকা, আর ২ থেকে ৩ টনের ট্রাকে ৮০০ টাকা। আর জেলা পরিষদের পক্ষ থেকে কুমারিপাড়া মোড়ে প্রতি ট্রাকে নেয়া হচ্ছে ৭০০ টাকা এবং দুই থেকে তিন টনের ট্রাকে নেওয়া হচ্ছে ১১০০ টাকা। কোনো স্লিপ ছাড়াই এই টাকা আদায় করা হচ্ছে অভিযোগ করে আড়তদার আহমদ নবী বলেন, ‘সবজি উৎপাদন বাড়ায় বিভিন্ন নামে এসব টোল আদায় করা হচ্ছে। এখন লামা পৌরসভার পক্ষ থেকে লাইনঝিরি এলাকায় নতুন করে টোল আদায় করতে চাইছে। টোল আদায় বেড়ে যাওয়ায় কেজিতে বাড়তি খরচ গুনতে হচ্ছে। এরকম হলে তো সবজি চাষে আগ্রহ হারাবে কৃষকরা।’

আরেক আড়তদার মোহাম্মদ রিদওয়ান বলে, ‘সমতল থেকে কৃষকরা লামার পাহাড়ি এলাকায় এসে সবজি চাষ করায় এখানকার বিপুল শ্রমিকের নিয়মিত কর্মসংস্থান নিশ্চিত হয়েছে। বর্গাচাষে জমির মালিকরা বেশি দাম পাচ্ছেন। এলাকার মানুষগুলো কৃষিক্ষেত করতে উদ্বুদ্ধ হচ্ছেন। অথচ উল্টো একের পর এক টোল আদায় করা হচ্ছে, যা অন্যায়। এরকম হলে গত দুই তিনবছরে যে হারে সবজি আবাদ হচ্ছে তাতে নিরুৎসাহিত হবেন কৃষকরা।’

পাঠকের মতামত: