ঢাকা,বুধবার, ১১ ডিসেম্বর ২০২৪

কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের

‘প্লাস্টিক দানব’ রাখবে দূষণ রোধে ভূমিকা

জহিরুল ইসলাম, কক্সবাজার :: বর্তমান বিশ্বের দীর্ঘতম কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের জনাকীর্ণ সুগন্ধ্যা সী–গাল পয়েন্ট। সেখানে ভয়ংকর ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে এক ‘দানব’! সাথে আছে দুটি দানব ছানাও! তবে ভয় পাচ্ছেন না পর্যটকরা। কিন্তু কেন? কারণ নানা রকমের প্লাস্টিক বর্জ্য দিয়ে বানানো হয়েছে প্রাণহীন এই দানব।

মূলত সমুদ্রে প্লাস্টিক দূষণের ভয়াবহতা সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করতে ৬২ ফুট উঁচু বিশালাকার রোবট আকৃতির এই ‘দানব’ তৈরি করা হয়েছে। একদল স্বেচ্ছাসেবীর নিপূণ হাতে কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে নির্মিত হয়েছে এই প্লাস্টিক দানব। জেলা প্রশাসন কক্সবাজার ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে নির্মিত হয় এ দানব ভাস্কর্য। নির্মাতারা বলছেন, এই দানব প্লাস্টিক দূষণে প্রাণ–প্রকৃতির বিরূপতার সাক্ষ্য দিচ্ছে।

পরিপূর্ণ রূপ দেয়ার পর গতকাল বুধবার সকাল ১০টায় এই রোবট ভাস্কর্যের উদ্বোধন করেন জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সালাহউদ্দিন। এ সময় আরও উপস্থিত ছিলেন কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) ইয়ামিন হোসেন, অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মুহাম্মদ নিজাম উদ্দিন, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোহাম্মদ জসিম উদ্দিন, ট্যুরিস্ট পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আবুল কালাম।

উদ্বোধনকালে জেলা প্রশাসক বলেন, প্লাস্টিক দানবের মতো সমুদ্র ও জনজীবন ধ্বংস করছে। ক্রমাগত বৃদ্ধি পেতে থাকা এই ভয়াবহতা রুখে দিতে হবে। এই সচেতনতা সবার মধ্যে ছড়িয়ে দেয়ার জন্যই ভাস্কর্য প্রদর্শনীর এই উদ্যোগটি নেয়া হয়েছে। আশা করছি এই প্রদর্শনীর মাধ্যমে মানুষ প্লাস্টিক ব্যবহারের আরও সতর্ক হবে।

বিশেষ অথিতির বক্তব্যে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মুহম্মদ নিজাম উদ্দিন আহমেদ জানান, প্রাণ–প্রকৃতি রক্ষায় যে কোন মহৎ উদ্যোগে প্রশাসনের সার্বিক সহযোগিতা অব্যাহত রয়েছে এবং থাকবে। বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনকে সাথে নিয়ে জেলা প্রশাসনের এই উদ্যোগে স্থানীয় জনগণ এবং পর্যটকরা সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছে এবং সমুদ্র সৈকতে প্লাস্টিক না ফেলে এক্সচেঞ্জ স্টোরে জমা করেছে, যা প্লাস্টিক দূষণ রোধে কার্যকর ভূমিকা রেখেছে।

আয়োজকরা বলছেন, দানবটি রক্ত–মাংসহীন প্রতীকী হলেও যার হিংস্র থাবায় প্রতিনিয়ত ক্ষত–বিক্ষত মানবদেহ, প্রকৃতি ও প্রাণবৈচিত্র্য। সৈকতে ঘুরতে আসা যে কেউ এটি প্রথম দর্শনে মনে ভয় বিরাজ করলেও কাছে যেতেই সে ভয় কেটে যাবে। আর জানবে দানবটির দেহে বয়ে বেড়ানো প্লাস্টিক দূষণে প্রাণ–প্রকৃতির ক্ষতির মাত্রা।

আয়োজক সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, প্রবালদ্বীপ সেন্টমার্টিন ও কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের অপার সৌন্দর্য উপভোগ করতে প্রতিদিনই সমাগম ঘটে লাখো পর্যটকের। যারা সৈকতের বালিয়াড়ি ও সাগরের পানিতে ফেলছে প্লাস্টিক পণ্য সামগ্রীর বর্জ্য। এতে উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে দূষণ এবং হুমকির মুখে পড়ছে সামুদ্রিক জীব ও মানবজীবন। আর প্রাণ–প্রকৃতির দূষণ রোধে এবং সচেতনতা সৃষ্টিতে কক্সবাজার জেলা প্রশাসন ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন নিয়েছে প্লাস্টিক বর্জ্যে তৈরি দানব ভাস্কর্যের প্রদর্শনীর মত ভিন্নধর্মী এ উদ্যোগ।

বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনের গভর্নিং বডির সদস্য জামাল উদ্দিন বলেন, বর্তমান সরকারের পরিবেশ মন্ত্রণালয় প্লাস্টিক দূষণের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিয়েছে। সরকারের পলিসির সাথে সমন্বয় করে আমরা সারাদেশ থেকে স্বেচ্ছাশ্রমে ৫০০ মেট্রিক টন পরিত্যক্ত প্লাস্টিক রিসাইকেল করার উদ্যোগ নিয়েছি। এতে করে প্লাস্টিক বর্জ্য ম্যানেজমেন্টে সরকারি খরচ যেমন কমবে তেমনি মানুষও জানতে পারবে কীভাবে রিসাইকেলের মাধ্যমে বর্জ্যকে সম্পদে রূপান্তর করা যায়। দেশব্যাপী এই উদ্যোগের অংশ হিসেবে কক্সবাজারে আমরা জেলা প্রশাসনের সহযোগিতায় ৪ মাসব্যাপী প্লাস্টিক দূষণ প্রতিরোধে কাজ করে যাব। প্লাস্টিক বর্জ্য রিসাইকেলের পাশাপাশি এখানে সচেতনতামূলক ভাস্কর্য প্রদর্শনীর আয়োজনও করছি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের ভাস্কর ও শিল্পী আবীর কর্মকার জানান, বিদ্যানন্দের ভিন্নধর্মী উদ্যোগ প্লাস্টিক দানবটি তৈরি করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের একদল শিল্পী। এতে তারা প্লাস্টিক বর্জ্যের পাশাপাশি ব্যবহার করেছেন কাঠ, পেরেক ও আঁটাসহ আরও কয়েকটি উপকরণ। ভাস্কর্য শিল্পীদের দাবি, এটি ওসান প্লাস্টিক দিয়ে তৈরি বিশ্বের সর্ব বৃহৎ ‘রোবট দানব’। এটির উচ্চতা ৬২ ফুট। এটি বানাতে প্রায় ১০ মেট্রিক টন প্লাস্টিক ব্যবহৃত হয়েছে।

বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনের দায়িত্বরত স্বেচ্ছাসেবক মুহাম্মদ মুবারক জানান, প্রায় ১ মাস ধরে কক্সবাজার, ইনানী ও টেকনাফের সমুদ্র সৈকত থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে অন্তত ১০ মেট্রিক টন সামুদ্রিক প্লাস্টিক বর্জ্য। এসব বর্জ্য দিয়ে কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে নির্মাণ করা হয়েছে এ ‘প্লাস্টিক দানব’। বিশ্বের দীর্ঘতম সৈকতে ঘুরতে আসা পর্যটক ও স্থানীয়দের মাঝে প্লাস্টিক বর্জ্যের দূষণ সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টিতে ভিন্নধর্মী এ উদ্যোগ। আর এটি পুরো পর্যটন মৌসুম সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত থাকবে। এটাকে কেন্দ্র করে এখানে প্লাস্টিক দূষণবিরোধী সচেতনতামূলক পথনাটক ও সংগীতানুষ্ঠানের আয়োজন করা হবে।

প্লাস্টিক বর্জ্যে নির্মিত এ দানবটি দেখতে ভিড় করছেন সৈকতে ঘুরতে আসা পর্যটকরা। তারা বলছেন, এটি দেখতে এসে মানুষ দৈত্য–দানবের ভয়ংকর রূপের মত প্লাস্টিক বর্জ্যের ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে সচেতন হবেন। পাশাপাশি নিজেরাও প্লাস্টিক পণ্য ব্যবহারে সজাগ থাকবেন।

পরিবেশবাদীসহ সচেতন মহল বলছেন, বিদ্যানন্দের ভিন্নধর্মী এ উদ্যোগ প্রশংসনীয়। এতে মানুষ প্লাস্টিক দূষণের ভয়াবহতা সম্পর্কে অবহিত হবেন। বিদ্যানন্দের মত অন্যান্য সংগঠন ও সংস্থাগুলোকে এ ধরনের কর্মকাণ্ডে এগিয়ে আসার আহ্বান তাদের।

উল্লেখ্য, ২০২২ সালে সর্বপ্রথম কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে প্লাস্টিক দানব নির্মাণ করে কক্সবাজার জেলা প্রশাসন ও বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন। এবার সেই দানবের সাথে যোগ হলো দুইটি ছানা দানবও!

পাঠকের মতামত: