ঢাকা,রোববার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪

সড়ক পরিবহন ব্যবস্থায় বিশৃঙ্খলা, ফিটনেসবিহীন গাড়ি, বিআরটিএর দুর্নীতি-সড়কে মরণখেলা

janzot

জ্যামিতিক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে চলতি পথে মৃত্যুর মিছিল। এক মৃত্যুর শোক কাটতে না কাটতেই আরেক মৃত্যু এসে দরোজায় কড়া নাড়ছে। প্রতিকারে নেই কার্যকর ব্যবস্থা। দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে পরিকল্পনা হয় অনেক, কার্যকর হয় গুটি কয়েক। সড়ক দুর্ঘটনায় আগে সর্বাধিক তালিকায় নাম ছিল নেপালের। নেপাল সড়ক দুর্ঘটনা রোধকল্পে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করে এখন দ্বিতীয় স্থানে চলে আসায় বাংলাদেশই প্রথম স্থানে চলে গেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধ করা না গেলে আগামী ১০ বছরে দুর্ঘটনার পরিমাণ হবে দ্বিগুণ। জাতিসংঘে বাংলাদেশসহ সদস্যদেশগুলো অঙ্গীকার করেছিল ২০১১ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনা অর্ধেকে নামিয়ে আনার। কিন্তু বাংলাদেশে উল্টো দুর্ঘটনা ও হতাহতের সংখ্যা বাড়ছে। বাংলাদেশে সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিতের দায়িত্ব সড়ক পরিবহন, স্বরাষ্ট্র, স্বাস্থ্য, স্থানীয় সরকারসহ কয়েকটি মন্ত্রণালয়ের। এসব মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, কোন বছর কত সড়ক দুর্ঘটনা কমানো হবে, এর কোনো কর্মপরিকল্পনা এখনো হয়নি। কিছু সড়কের বাঁক সোজা করা এবং মাঝেমধ্যে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা ছাড়া সরকারের দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগ নেই। চট্টগ্রাম তথা সারা দেশে সড়ক দুর্ঘটনা যে বাড়ছে, এ বিষয়ে দ্বিমত নেই বিআরটিএ কর্মকর্তা, পরিবহন নেতৃবৃন্দ কিংবা পুলিশ কারোরই। সচেতনতার যে বিকল্প নেই, সে বিষয়েও একমত তারা। তবে দায় কার কতোটা সে বিষয়ে স্বপক্ষে যুক্তি তুলে ধরেছেন প্রত্যেকেই। পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্যানুযায়ী সারাদেশে বছরে সড়ক দুর্ঘটনায় সাড়ে তিন থেকে চার হাজার মানুষ মারা যাচ্ছে। অপরদিকে সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ বা বিআরটিএ’র হিসাবে প্রতিদিন সারাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় কমপক্ষে ৩০ জন নিহত হয়। সে অনুযায়ী বছরে নিহতের সংখ্যা ১০ হাজার ৮০০ জন। বুয়েটের এক্সিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউট (এআরআই) এবং নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতিবছর ১২ হাজার মানুষ নিহত হচ্ছে। নিহতের ৮০ শতাংশের বয়স পাঁচ থেকে ৪৫ বছর। নিহতদের মধ্যে ৫৩ শতাংশ পথচারী। যাদের ২১ শতাংশের বয়স ১৬ বছরের নিচে।

এআরআইয়ের গবেষণায়, বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনার নেপথ্যে হাইওয়ে পরিকল্পনা না থাকা, দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধি, অপরিকল্পিত নগরায়ন, মোটরযানের সংখ্যা দ্রুত বেড়ে যাওয়া, সড়ক নিরাপত্তা বিষয়ে অতি সামান্য বিনিয়োগ, অপর্যাপ্ত সচেতনতামূলক কর্মসূচি, চালকদের প্রশিক্ষণ ও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার অভাব, মোটরযান, সড়ক নির্মাণ ও মেরামতে ত্রুটি, ওভারটেকিং, ওভারলোডিং, ওভারস্পিড ইত্যাদিকে উল্লেখ করা হয়।

অভিযোগ রয়েছে দায়িত্ব পালনে পুলিশের অবহেলা এবং হয়রানির কারণে বাংলাদেশে দুর্ঘটনার প্রকৃত সংখ্যা জানা যায় না। সঠিক প্রতিবেদনের অভাব এবং ভুল ব্যাখ্যার কারণে সড়ক দুর্ঘটনার প্রকৃত চিত্র উঠে আসছে না। দুর্ঘটনার পর পুলিশকে ৬৭ ধরনের প্রশ্ন সংগ্রহ করে একটি প্রতিবেদন জমা দিতে হয়। এই ঝামেলা এড়াতে অনেক সময় তারা অনেক দুর্ঘটনা রেকর্ডভুক্ত করে না বলে জানা যায়।

দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের গবেষকরা বলছেন, জাতীয় মহাসড়কের চার শতাংশ এলাকায় শতকরা ৩৫ ভাগ দুর্ঘটনা ঘটছে। এই চার শতাংশ সড়কে রয়েছে হাটবাজার, বাস স্টেশনসহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। সড়ক দুর্ঘটনার কারণে বছরে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ সাত হাজার কোটি টাকার বেশি। এ ছাড়া হাইওয়েসহ সকল সড়কগুলোতে সড়ক নিরাপত্তার যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে। মহাসড়কগুলোতে নেই পর্যাপ্ত সিগন্যালের ব্যবস্থা। নেই রোড ডিভাইডারসহ ট্রাফিক সাইন। যেখানে সেখানে বসেছে হাটবাজার। প্রয়োজনীয় স্পিড ব্রেকারের অপ্রতুলতাসহ রাতে আলোর স্বল্পতা তো রয়েছেই। এ ছাড়া চালকদের অনেকের রোড সিগন্যাল, ট্রাফিক সাইন সম্পর্কে কোন ধারণা নেই। আদালতের নির্দেশ থাকা সত্ত্বেও পরিবহনে লাগানো হয়নি গতি নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র। জনবল সঙ্কটসহ নানা সমস্যা নিয়ে খুঁড়িয়ে চলছে হাইওয়ে পুলিশ। সড়ক দুর্ঘটনায় অভিযুক্ত ৮৩ শতাংশ আসামি থাকছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। বিশেষজ্ঞদের অভিমত, সংস্কার আনতে হবে পুরো যোগাযোগ ব্যবস্থায়। আর বিআরটিএ বলছে, দুর্ঘটনায় মৃত্যুর রাশ টানতে ১৯৮৩ সালের মোটরযান অধ্যাদেশ বাতিল করে এ বছরই হচ্ছে নতুন সড়ক পরিবহন আইন।

সড়ক দুর্ঘটনাগুলোর মূল কারণ হিসেবে বাসট্রাক চালকদের বেপরোয়াভাবে যানবাহন চালানোকে দায়ী করা হয়। অভিযোগ স্বীকার করে নিলেন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশন, চট্টগ্রাম আঞ্চলিক কমিটির সভাপতি মো: মুছা। গতকাল তিনি বলেন, চালকের দায় আমি অস্বীকার করি না। কিন্তু চালকের দায় ২০ পারসেন্ট। বাকি ৮০ পারসেন্ট দায় অন্যের। তিনি বলেন, সড়ক দুর্ঘটনায় কি শুধু যাত্রী কিংবা পথচারি মারা যাচ্ছে; চালক বা হেলপারওতো মরছে। তাহলে নিজে নিজেকে মারার জন্য কেউ কি বেপরোয়া গাড়ি চালায়? মহাসড়কে চলার কথা বাস, চেয়ারকোচ কিংবা ট্রাক। চলার কথা কাভার্ড ভ্যান, পণ্যবাহী গাড়ি। মন্ত্রী মহোদয় নির্দেশ দিয়েছেন, মহাসড়কে সিএনজি টেক্সি, ব্যাটারি রিকশা, করিমন, নছিমন, টমটমের মতো হালকা যানবাহন চলাচল বন্ধ রাখার। কিন্তু নির্দেশ কতোটা বাস্তবায়িত হচ্ছে? দক্ষিণ চট্টগ্রামের এক এমপি নির্দেশ দিয়েছেন, তার এলাকায় জনসাধারণের সুবিধার্থে সিএনজি টেক্সি, ব্যাটারি রিকশা, নছিমন চলবে। এসব গাড়ি চলছেতো মহাসড়কেই? সেগুলো চালাচ্ছেও লাইসেন্সবিহীন, অদক্ষ, অপ্রাপ্তবয়স্ক চালক। এখন সেই গাড়িগুলো যদি দুর্ঘটনা ঘটায়, তার দায় কার হবে? তাছাড়া এসব গাড়ি যে চলছে তা দেখার দায়িত্ব হাইওয়ে পুলিশের। তাদের চোখের সামনে দিয়ে এসব গাড়ি চলছে। এর দায়ও কি চালকের? ফুটপাত দখল করে আছে হকার। পথচারী হিসেবে আমার চলতে হচ্ছে রাস্তায়। দ্রুত বেগে আসা কোন ভারী যানবাহন যদি আমায় চাপা দেয়, দায় কি আমার বা চালকের? নাকি অন্য কেউ এর জন্য দায়ী? রাস্তার উপর বসছে হাটবাজার। এর পরের অংশে দাঁড়ায় হকারদের ভ্যানগাড়ি। এরপর যানবাহন চলাচলের জন্য আর কতটুকু জায়গা থাকে? চট্টগ্রামে গত ২০ বছর ধরে আমরা পরিবহনের জন্য স্থায়ী টার্মিনাল তৈরির দাবি তুলে আসছি। আজো বাস্তবায়ন হয় নি। ফলে রাস্তা দখল করেই যানবাহনগুলো রাখা হচ্ছে। তিনি বিআরটিএর দায়িত্ব প্রসঙ্গে বলেন, দেশে গাড়ি চলছে ৩৪ লাখ। আর লাইসেন্স আছে ১৭ লাখ চালকের। তাহলে বাকি ১৭ লাখ চালকতো লাইসেন্স বিহীন। ফিটনেস আছে কিনা দেখার দায়িত্ব বিআরটিএর। অথচ আর্থিক লাভের বিনিময়ে পরীক্ষা না করেই ফিটনেস সার্টিফিকেট দেওয়া হচ্ছে। ছোট পণ্যবাহী গাড়ি বডি পালটে হয়ে যাচ্ছে মিনিবাস। এ ধরনের বিষয়গুলো নিয়ে প্রশাসনকে বারবার বলার চেষ্টা করি আমরা। বিআরটিএর মিটিংয়ে আমরা যখন এসব সমস্যা তুলে ধরি, উপস্থিত কর্মকর্তারা নিজেদের মধ্যে হাসাহাসি করে, যেন এসব কথা তাদের গা সওয়া হয়ে গেছে।

মো: মুছা বলেন, সড়ক দুর্ঘটনায় চালকের একটা দোষ প্রায়শ: দেখা যায়, যে চলন্ত অবস্থায় মোবাইল ফোনে কথা বলে বা গান শুনে। এতে দুর্ঘটনা ঘটে। এটা বন্ধে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে, সমাবেশ করে আমরা চালকদের সচেতন করার চেষ্টা করে যাচ্ছি। কিন্তু আরো কিছু কারণ রয়েছে। যেমন চালকের প্রশিক্ষণের অভাব, চালকের অতিরিক্ত খাটুনি চালকের স্থায়ী নিয়োগের বদলে যাত্রার ওপর মজুরি নির্ধারণ সহ বিভিন্ন কারণ রয়েছে। আইনে আছে ড্রাইভার আট ঘন্টা গাড়ি চালাবে। সিলেট থেকে বা ঢাকা থেকে একটা গাড়ি টেকনাফ যাবে। দেখা যায় দুই একটি চেয়ারকোচ কোম্পানি ছাড়া বাকি সবগুলোই পুরো রাস্তা এক চালকের উপর নির্ভর করে। আমি যে কারণগুলো বললাম, কাল থেকে যদি এগুলো বাস্তবায়িত হয় তবে ৫০ ভাগ সড়ক দুর্ঘটনা কমে যাবে।

বিআরটিএ, চট্টগ্রামের উপ পরিচালক মো: শহীদুল্লাহ গতকাল বলেন, সড়ক দুর্ঘটনা কখন হবে, কী হবে, তা আগেভাগে কে বলতে পারে? এককভাবে কাউকে দায়ী করা যাবে না। পরিবহন নেতৃবৃন্দ যেটা বলছেন যে, গাড়ি না দেখেই আমরা ফিটনেস সার্টিফিকেট দিয়ে দিই, তা সত্য নয়। বর্তমানে ফিটনেস সার্টিফিকেট দেওয়ার হার কমে গেছে। কারণ আমরা মালিক চালকদের বলে দিয়েছি, গাড়ির বাম্পার এ্যাঙ্গেলসহ অতিরিক্ত অংশগুলো খুলে আসতে হবে, তা না হলে ফিটনেস সার্টিফিকেট দেওয়া হবে না। তারা সে অংশগুলো খুলেও না, সার্টিফিকেটের জন্যও আসে না। তিনি বলেন, সচেতন হতে হবে সকলকে। যে ড্রাইভার গাড়ি নিয়ে বের হবেন, তাকে সব কিছু চেক করে তবেই রাস্তায় নামা উচিত। নয়তো মালিককে বলা উচিত কোথায় সমস্যা। আনফিট গাড়ি নিয়ে কেন রাস্তায় বের হবে? হ্যাঁ বিআরটিএর যে দায় একেবারেই নেই তা বলছি না। মন্ত্রী মহোদয়ের নির্দেশে আমরা সড়ক দুর্ঘটনা রোধে বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছি। যেমন মোটর সাইকেল তিন জন বসা যাবে না, হেলমেট ছাড়া মোটরসাইকেল চালানো যাবে না ইত্যাদি। এর ফলে মোটরসাইকেলে দুর্ঘটনা অনেক হ্রাস পেয়েছে। আনফিট গাড়ির বিরুদ্ধে আমরা মাঝে মধ্যে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করছি। জরিমানা আদায় করছি। তবে যাই করি না কেন, সকলের সচেতনতার মাধ্যমে সম্মিলিত ভাবে এ সমস্যার মোকাবেলা করতে হবে।

সড়ক দুর্ঘটনার দায় এবং প্রতিকারে করণীয় প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সিএমপির উপ কমিশনার (যানবাহন উত্তর) মো: সুজায়েতউল্লাহ  বলেন, চালকের দক্ষতার অভাব, যানবাহনের যান্ত্রিক ত্রুটি, জনসাধারণের ও চালকের ট্রাফিক আইন না মানা, রাস্তাঘাটের পর্যাপ্ত পরিচর্যার অভাব, চালকের গতিসীমা না মানা, যত্রতত্র গাড়ি পার্কিং করা, জনসাধারণের যত্রতত্র রাস্তা পার হওয়াসহ বিভিন্ন কারণ রয়েছে সড়ক দুর্ঘটনার জন্য। শুধু চালকের দায় আছে, আমরা যারা রাস্তায় চলাচল করি, তাদের দায় নেই সেটাতো হতে পারে না। ট্রাফিক পুলিশ হিসেবে আমারো দায় রয়েছে। পরস্পরের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে দায়িত্ব শেষ করলে হবে না। সমন্বিত উদ্যোগ নিতে হবে। সীমাবদ্ধতাগুলো কাটিয়ে উঠতে পারলে আমার বিশ্বাস সড়ক দুর্ঘটনা অনেকাংশে কমে যাবে।

পাঠকের মতামত: