ঢাকা,মঙ্গলবার, ১২ নভেম্বর ২০২৪

সেন্টমার্টিনে অযত্ন-অবহেলায় হুমায়ূনের সমুদ্র বিলাস

humayun somudra bilasকক্সবাজার  প্রতিনিধি :::

প্রয়াত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ নব্বই দশকের প্রথম দিকে রূপালী দ্বীপ নামক একটি উপন্যাস লিখেছিলেন। সেই উপন্যাসে তিনি নতুন পরিচিতি এনে দিয়েছিলেন দেশের সর্ব দক্ষিণ-পূর্ব সীমানা কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলায় অবস্থিত সেন্ট মার্টিন দ্বীপ বা নারকেল জিঞ্জিরার। ১৯৯৩ সালের মার্চ মাসে এই দ্বীপে জমি কিনে বাড়িও করেন তিনি। বাড়ির নাম দেন ‘সমুদ্র বিলাস’। এরপর সারা দেশে নতুন ফোকাস পায় সেন্ট মার্টিন। ক্রমেই পর্যটকদের ভিড় বাড়তে থাকে প্রত্যন্ত এই দ্বীপে। দ্বীপে আসা পর্যটকদের কাছে অন্যতম আকর্ষণ হুমায়ূন আহমেদের স্বপ্নের সমুদ্র বিলাস।
বাড়ি করার পর হুমায়ূন মাঝেমধ্যে সেন্ট মার্টিনে এসে থাকতেন। সমুদ্র বিলাসে বসে উপন্যাস লিখতেন। সর্বশেষ ২০১১ সালের ১৮ ডিসেম্বর স্ত্রী শাওন, দুই সন্তান নিশাদ ও নিনিত এবং নাট্যপরিচালক মাসুদ রানাসহ এসেছিলেন সমুদ্র বিলাসে। হুমায়ূন এখানে আর না এলেও তাঁর বাড়ি পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয় এক স্থান। তবে সম্প্রতি সমুদ্র বিলাস দেখতে গিয়ে পর্যটকেরা হতাশ হচ্ছেন।
সরেজমিনে দেখা গেছে, লেখকের বাড়ি অযত্ন আর অবহেলায় পড়ে আছে। বাড়ির সামনে গড়ে উঠেছে চা, পান, ডাব, শামুক-ঝিনুক ও শুঁটকি মাছের দোকান। নূহাশপল্লীর সৌন্দর্য দেখার পর যাঁরা সেন্ট মার্টিনে হুমায়ূন আহমেদের বাড়ি দেখতে আসেন, তাঁরা বিব্রত ও হতাশ হচ্ছেন। বাড়ির মধ্যে গড়ে উঠেছে বাণিজ্যিক রিসোর্ট।
এ বিষয়ে সেন্ট মার্টিন ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান নুর আহমদ বলেন, ‘অনেক পর্যটক সেন্ট মার্টিন বেড়াতে এসে হুমায়ূন আহমেদের বাড়ি দেখতে আসেন। অনেক মানুষজন যেহেতু সেখানে আসেন, তাই দ্বীপের কিছু গরিব মানুষ সেখানে চা ও ডাবের দোকান দিয়েছেন। দোকানগুলো আসলে স্থায়ী নয়। ইদানীং দু-একটা শুঁটকি মাছের দোকানও গড়ে উঠেছে। দোকানগুলো যদি তাঁর বাড়ির সামনে না হয়ে একটু পাশে হয়, তাহলে ভালো হতো। চেয়ারম্যান হিসেবে আমার ক্ষমতা সীমিত, তবু এই বিষয়ে আমার যদি কিছু করার থাকে আমি তা করব।’
সেন্ট মার্টিন ঘুরতে আসা আতিকুর রহমান বলেন, ‘সেন্ট মার্টিনে হুমায়ূন আহমেদের বাড়ি সম্পর্কে অনেক আগ্রহ ছিল আমার। আমার ধারণা ছিল এটি একটি ছিমছাম এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত এলাকা, কিন্তু বাড়ির সামনের এই অবস্থা আমাকে কিছুটা হতাশ করেছে।’
সুমদ্র বিলাসের মূল গেটে কেয়ারটেকার ওসমান গণির সঙ্গে দেখা হয়। সাংবাদিক পরিচয় পাওয়ার পরই স্মৃতির ঝাঁপি খুলতে থাকেন ওসমান গণি। হুমায়ূনের নানা স্মৃতি বলতে থাকেন তিনি। তবে সামনের গেট খুলতে রাজি হন না তিনি। পাশে কেয়া ঝোঁপের পাশ দিয়ে সরু গলিটা দেখিয়ে বলেন পেছনে যেতে। দক্ষিণের গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকতেই জাল বোনা অসমাপ্ত রেখে পেছনের ঘরে সেঁধিয়ে গেলেন ওসমান গণির স্ত্রী ইয়াসমিন হক। সেন্ট মার্টিনের আর সব নারীর মতোই লাজুক চোখে নজর রাখেন দরজার আড়াল থেকে। তাঁরা যেখানটায় আড়াল নিয়েছেন, সেটি একটা দোতলা ভবন। ওসমান গণি বলেন, নিচের ওই বড় ঘরটায় লাইব্রেরি করার ইচ্ছা ছিল হুমায়ূন আহমেদের। আর ওপরের খোলা দোতলায় করতে চেয়েছিলেন রেস্টুরেন্ট। কিন্তু অমোঘ নিয়তি তাঁকে সে সময় দেয়নি।
সামনে দুদিকে তিনটি করে ছয়টি কটেজ। সব নন-এসি। ভাড়া এক রাতের জন্য দেড় হাজার টাকা। লাগোয়া ফ্রেশরুমসহ মাত্র একটি করেই রুম রয়েছে প্রতিটি কটেজে। তবে পর্যটকদের কাউকেই এসব কটেজে থাকতে দেখা যায়নি। কারণ পুরো কটেজের চার পাশে ময়লা-আবর্জনায় ভরা। পর্যটকেরা সুমদ্র বিলাসের সামনে এসে ছবি তুলেই সন্তুষ্ট হচ্ছেন। ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহ পেরিয়ে গেলেও কোনো ভাড়াই পায়নি সমুদ্র বিলাস।
সুমদ্র বিলাসে আগে ছিল তিন রুমের কেবল একটি কটেজ। তাতে থাকতেন হুমায়ূন আহমেদ। হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যুর পর লিজ দেওয়া হয় সমুদ্র বিলাস। সম্প্রতি হুমায়ূনের স্ত্রী শাওন বাতিল করে দিয়েছেন লিজ। মাত্র কয়েক হাজার টাকার জমির দাম বেড়ে এখন প্রতি শতকের দাম হয়েছে তিন লাখ টাকা। আগের ২২ শতকের সঙ্গে ২০১৫ সালে সমুদ্র বিলাসের ঠিক পেছনেই আরও ৩০ শতাংশ জমি কিনেছেন শাওন। এই ৫২ শতকের ওপর কি তাহলে আধুনিক কোনো রিসোর্ট গড়বেন তিনি? স্পষ্ট করে সে প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেন না ওসমান গণি।
সমুদ্র বিলাসের সামনে আগে ওসমান গণির দুটি শুঁটকির দোকান ছিল। তা বিক্রি করে দিয়েছেন অনেক আগেই। এখন সৈকতে ছাতা ভাড়া দেন প্রতি ঘণ্টা ৩০ টাকায়।
ওসমান গণি বলেন, ১৯৯৩ সালের ১৬ মার্চ সেন্ট মার্টিনের বাসিন্দা জোলেখা খাতুনের কাছ থেকে ২০ হাজার টাকার বিনিময়ে ২২ শতক জমি কেনেন হুমায়ূন আহমেদ। পরে ১৯৯৪ সালে তিনি একটি বাড়ি নির্মাণ করেন। ওই সময় তিনি স্থানীয় বাসিন্দা মো. শফিক ও ওসমান গণিকে বাড়িটি দেখাশোনার জন্য মাসিক বেতনভুক্ত করে দায়িত্ব দেন।
সমুদ্র বিলাসের অযত্ন-অবেহলার বিষয়টি জানিয়ে মেহের আফরোজ শাওনের কাছে এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, ‘সমুদ্র বিলাসকে পাল্টে ফেলার পরিকল্পনা করেছি। আমরা সমুদ্র বিলাসকে কেবল একটি রিসোর্টে সীমাবদ্ধ রাখতে চাই না। বিশ্বের অন্যান্য জায়গায়ও বিখ্যাত ব্যক্তিদের স্মৃতি ধরে রাখার এমন পদক্ষেপ নেওয়ার উদাহরণ আছে। আমরাও সেই আদলেই সমুদ্র বিলাসকে নতুন রূপ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’

 

পাঠকের মতামত: