লাবণ্য রাণী, পূজা, নিজস্ব প্রতিবেদক ::
চকরিয়া-পেকুয়া আসনটি দক্ষিণ চট্টগ্রামে বিএনপির দুর্গ হিসেবে পরিচিত। স্বাধীনতা পরবর্তী ১৯৭৩ সালের পর থেকে এই আসনে ক্ষমতার মসনদে আসতে পারেনি আওয়ামী লীগ। গেল নির্বাচনেও কৌশলগত কারণে আসনটি জোটের শরীক দলকে ছেড়ে দেয়া হয়। কিন্তু এবার আর ছাড় নয়, ৪৫ বছরের ইতিহাস পাল্টাতে চায় টানা দুইবার রাষ্ট্র ক্ষমতায় থাকা দলটি। তবে কোন্দলে জড়িয়ে তিন মেরুতে বিভক্ত দলটি এই আসন থেকে জাতীয় সংসদে আদৌ যেতে পারবে কিনা তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে খোদ দলের মধ্যে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সাবেক যোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী সালাউদ্দিন আহমেদ চকরিয়া-পেকুয়ার বিএনপির পরিবারের কাছে ‘বরপুত্র’ হিসেবে পরিচিত। তিনি এই আসন থেকে ৯৬ সালে ধানের শীষ প্রতীকে জিতে সংসদে যান। এরপর ২০০১ সালে ফের নির্বাচিত হন। দায়িত্বপান সরকারের যোগাযোগ প্রতিমন্ত্রীর। পাল্টাতে শুরু করেন এলাকার চেহারা। এলাকার মানুষ তাকে উন্নয়নের প্রতীক হিসেবে জানে। তবে তিনি এখন দেশে নেই। অবৈধভাবে ভারতে অনুপ্রবেশের অপরাধে শিলংয়ে আইনি লড়াই করছেন। বিএনপির দাবী এই আসন থেকে ২০০৮ সালের মত ধানের শীষ প্রতীকে লড়বেন তার স্ত্রী হাসিনা আহমেদ।
কক্সবাজার-১ (চকরিয়া-পেকুয়া) আসনটিকে আওয়ামী লীগের জন্য নেগেটিভ আসন হিসেবে ধরা হয়। সর্বশেষ ১৯৭৩ এর নির্বাচনে ডাঃ শামসুদ্দিন নৌকা প্রতীক নিয়ে এ আসনে জিতেছিলেন। এর পর আর জয়ের স্বাদ পায়নি স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি। তবে এবার পরিস্থিতি পাল্টেছে। বিশেষজ্ঞ মহল মনে করেন শক্তিশালী প্রার্থী দিতে পারলে জয় আসবে আওয়ামী লীগের ঘরে।
জাতীয় সংসদের (২৯৪) কক্সবাজার-১ আসনটি চকরিয়া-পেকুয়া দুই উপজেলার ২৫টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভা নিয়ে গঠিত। দুই উপজেলার বর্তমান ভোটার সংখ্যা প্রায় তিন লাখ। বিএনপির শক্ত ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত এ আসন থেকে ১৯৯১ সালে জামায়াত প্রার্থী এনামুল হক মঞ্জু ও ১৯৯৬ এবং ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী বর্তমান বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন আহমদ পর পর দু’বার এমপি নির্বাচিত হন।
২০০৮ সালের নির্বাচনে সালাহউদ্দিন আহমদ কারাবন্দি থাকায় স্ত্রী অ্যাডভোকেট হাসিনা আহমেদ বিএনপির টিকিটে আওয়ামী লীগের প্রার্থী সালাউদ্দিন আহমদ সিআইপিকে ৩৫ হাজার ৪০১ ভোটে পরাজিত করে এমপি নির্বাচিত হন। ২০১৪ সালের নির্বাচনে এই আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এমপি নির্বাচিত হন জাতীয় পার্টির (এরশাদ) প্রার্থী ও কক্সবাজার জেলা জাপার সভাপতি হাজি মোহাম্মদ ইলিয়াছ।
দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে চকরিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও চকরিয়া উপজেলা চেয়ারম্যান জাফর আলমকে এই আসন থেকে আওয়ামী লীগ দলীয় মনোনয়ন দিয়েছিল। কিন্তু জাতীয় পার্টির সঙ্গে মহাজোটের আসন ভাগাভাগি করার ফলে ভোট গ্রহণের দু’দিন আগে দলীয় সভানেত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে মনোনয়ন প্রত্যাহার করে নেন জাফর আলম।
চকরিয়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান জাফর আলমের পাশাপাশি বর্তমানে চকরিয়া-পেকুয়া আসনে দলীয় মনোনয়ন প্রত্যাশী হিসেবে মাঠ চষে বেড়াচ্ছেন আরো ৪ প্রভাবশালী নেতা। তারা হলেন জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ স¤পাদক সালাহউদ্দিন সিআইপি, জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি চকরিয়া উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান রেজাউল করিম, কক্সবাজার জেলা আওয়ামী লীগের শিক্ষা ও মানব সম্পদ বিষয়ক সম্পাদক মোহাম্মদ আশরাফুল ইসলাম সজিব। জেলা আওয়ামী লীগের শিল্প বিষয়ক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ মিথুন। তাদের মধ্যে সালাহউদ্দিন আহমদ সিআইপি ১৯৯৬, ২০০১ ও ২০০৬ সালে তিনবার আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করেন।
পেকুয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবুল কাশেম জানান, স্বাধীনতার পর থেকে এই আসনে নৌকা জিততে পারেনি। প্রার্থীর অযোগ্যতা ও অজনপ্রিয়তার কারণে বার বার নৌকা হেরেছে। কিন্তু এখন আর নয়। গত ১০ বছরে এই আসনে নৌকা অনেক শক্তিশালী হয়েছে। মার্কাটি মানুষের হৃদয়ে পৌছেছে। তাই আর হাতছাড়া করতে চায় না। এই আসনে যোগ্য প্রার্থীর হাতে নৌকার মনোনয়ন চায়।
চকরিয়া পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি জাহেদুল ইসলাম লিটু বলেন, এখনই উত্তম সময় আসনটি পুণরুদ্ধারের। বিএনপির ঘাঁটিতে জাফর আলম আঘাত হানতে সক্ষম হয়েছেন। তার (জাফর আলম) নেতৃত্বে নেতাকর্মীরা ঐক্যবদ্ধ। তাই তৃণমূল নেতাকর্মীদের দাবী জাফর আলমকে এই আসনে নৌকার মনোনয়ন দেওয়ার।
সম্প্রতি চকরিয়া পৌর বাসটার্মিনালে দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ট্রেন এসে থেমেছিল। পথসভা পরিণত হয় বিশাল জনসভায়। সেই জনসভায় জাফর আলমকে মনোনয়ন দেওয়ার জন্যে দাবী জানায় নেতাকর্মীরা।
সেই সভায় বক্তব্যে চকরিয়া পৌরসভার মেয়র আলমগীর চৌধুরী বলেছিলেন, গেল নির্বাচনে সুবর্ণ সুযোগ ছিল। কিন্তু দলের স্বার্থে জাফর আলম ত্যাগ স্বীকার করেছেন। এবার আমরা আশা করবো দল থেকে তাকে নৌকা প্রতীকের মনোনয়ন দিয়ে সঠিক মূল্যায়ন করবে।
তবে দলের একটি পক্ষের দাবী, জাফরের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ আছে। আসনটি পুনরুদ্ধার করতে হলে প্রয়োজন একজন ক্লিন ইমেজের নেতা।
নৌকার মনোনয়ন প্রত্যাশী ড. মোহাম্মদ আশরাফুল ইসলাম সজিব বলেন, গত এক যুগেরও বেশি সময় ধরে চকরিয়া-পেকুয়ার মানুষের সাথে কাজ করে যাচ্ছি। এই আসনে নৌকাকে জনপ্রিয় করতে মানুষের ঘরে ঘরে গিয়েছি। চেষ্টা করেছি প্রতিটি মানুষের কাছে শেখ হাসিনার উন্নয়ন তুলে ধরতে।
তিনি আরও বলেন, মনোনয়ন দেবেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তাই দল থেকে যাকে মনোনয়ন দেয়া হয় তাকে বিজয়ী করার জন্য কাজ করবো। কিন্তু কোন বিতর্কিত, ভয় প্রদর্শনকারী বা সন্ত্রাসীর হাতে যেন নৌকা তুলে দেয়া না হয়।
নৌকার মনোনয়ন প্রত্যাশী চকরিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি জাফর আলম বলেন, তার নেতৃত্বে দল এখন চকরিয়া-পেকুয়াতে অনেক শক্তিশালী। বিএনপির টানা হরতাল আন্দোলনে চকরিয়াতে এক মুহুর্তের জন্যও দাঁড়াতে পারেনি। অথচ নাশকতার সবচেয়ে বেশি আশঙ্কা ছিল চকরিয়ায়। দলের স্বার্থে গেল নির্বাচনে ত্যাগ করেছি। আমার বিশ^াস নেত্রী এবার আমাকে মনোনয়ন দেবেন।
জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও নৌকার মনোনয়ন প্রত্যাশী সালাহ উদ্দিন আহমেদ সিআইপি বলেন, দলের দুঃসময়ে আমি দীর্ঘদিন হাল ধরে ছিলাম। এখন দল অনেক শক্তিশালী, সুসময় পার করছে। এখন সময় কষ্টের ফসল ঘরে তোলার। আমার বিশ^াস নেত্রী আমাকে মনোনয়ন দেবেন।
অন্যদিকে চকরিয়া-পেকুয়া আসনটি বিএনপির দুর্গ হিসেবে পরিচিত। এই আসনে সালাহ উদ্দিন আহমেদ একাধিকবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। এখানে তিনি তুমুল জনপ্রিয়। তার জনপ্রিয়তার তুলনায় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগে এখনো সেই ধরণের নেতা হয়ে উঠেনি বলে মনে করে থাকেন রাজনৈতিক বোদ্ধারা। সালাহ উদ্দিন আহমেদের জনপ্রিয়তার উপর ভর করেই ২০০৮ সালে প্রথমবার রাজনীতি ও নির্বাচনের মাঠে নেমে ছক্কা হাকান তার স্ত্রী হাসিনা আহমেদ। সেই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থীকে বিপুল ভোটে পরাজিত করেছিলেন তিনি। এবারও সালাহ উদ্দিন আহমেদ দেশে ফিরতে না পারলে তার স্ত্রী নির্বাচন করবেন এমনটা আগে থেকেই জানে তৃণমূল নেতাকর্মীরা। তৃণমূলের নেতাকর্মীরা মনে করেন, সুষ্ঠু পরিবেশে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে হাসিন আহমেদ আবারও বিপুল ভোটে জয়ী হবেন।
কক্সবাজার জেলা বিএনপির দপ্তর সম্পাদক ইউসুফ বদরী বলেন, ‘সালাহ উদ্দিন আহমেদ অবহেলিত পেকুয়া-চকরিয়াকে ১০০ বছর এগিয়ে নিয়ে গেছেন। একারণে তিনি শুধু দলীয় নেতাকর্মীদের কাছে নয়, সর্বস্তরের মানুষের কাছে জনপ্রিয়। এখানকার মানুষের প্রত্যাশা তিনিই (সালাহ উদ্দিন আহমেদ) নির্বাচন করবেন। তবে যদি তিনি দেশে ফিরতে না পারেন তাহলে তার স্ত্রী হাসিনা আহমেদই নির্বাচন করবেন।’
বিএনপির দলীয় সূত্রে জানা গেছে, চকরিয়া-পেকুয়ায় তাদের কোনো ধরনের গ্রুপিং নেই। চকরিয়ায় সাংগঠনিক কার্যক্রম চলছে মিজানুর রহমান চৌধুরী খোকন মিয়া আর পেকুয়ায় চলছে সদর চেয়ারম্যান বাহাদুর শাহের একক নেতৃত্বে। বিএনপি ও অঙ্গ সহযোগী সংগঠনের কমিটি গোছাতে ব্যস্ত তারা।
দুই বড় দলের পাশাপাশি মনোনয়ন প্রত্যাশী হিসেবে আলোচনায় রয়েছেন জাতীয় পার্টির (এরশাদ) দলীয় বর্তমান এমপি হাজি মোহাম্মদ ইলিয়াছ। আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোটগত নির্বাচন হলে এবারো তিনি আসনটি পাবেন বলে ধারণা জাপা নেতাকর্মীদের।
অন্যদিকে মহাজোটের শরিক দল জাতীয় পার্টি (মঞ্জু) জেপির প্রেসিডিয়াম সদস্য সাবেক এমপি এএইচ সালাহউদ্দিন মাহমুদও নির্বাচন করবেন বলে আভাস পাওয়া যাচ্ছে। এছাড়াও জামায়াত থেকে এই আসনে মাঠে চষে বেড়াচ্ছেন আরিফুর রহমান চৌধুরী মানিক।
পাঠকের মতামত: