ঢাকা,সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪

সংকুচিত হাতির চলার পথ

নিজস্ব প্রতিবেদক ::
কক্সবাজার-বান্দরবান ও চট্টগ্রাম দক্ষিণ বনবিভাগের ১২টি করিডোর দিয়ে বংশপরম্পরায় চলাচল করেছে হাতি। গুরুত্বপূর্ণ এ করিডোরগুলো একের পর বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। হাতির আবাসস্থলে গড়ে উঠছে মিল কারখানা। বিপন্ন হয়ে পড়ছে হাতি। এ অবস্থায় নতুন করে হাতির আবাসস্থল গড়ে তোলার সক্ষমতাও নেই বনবিভাগের।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করিডোর বন্ধ হয়ে গেলে হাতির চলাচলের পথ সংকুচিত হয়ে যাবে। এক পর্যায়ে বিলুপ্ত হয়ে যাবে। সব করিডোর না হলেও অন্তত গুরুত্বপূর্ণ করিডোরগুলো খুলে হাতি চলাচলের নিরাপদ পরিবেশ নির্বিঘ্ন করা খুবই জরুরি। বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের দেয়া তথ্য অনুযায়ী হাতি চলাচলের প্রধান ১২টি করিডোরের মধ্যে ইতিমধ্যে অধিকাংশ বন্ধ হয়ে গেছে। জানা গেছে, কক্সবাজার-ঘুনধুম রেল লাইন প্রকল্পে ২৭ কিলোমিটার রেলপথ যাবে তিনটি অভয়ারণ্যের ভেতর দিয়ে। এতে বন্ধ হয়ে যাবে হাতি চলাচলের ছোট-বড় ২১টি করিডোর। জরুরি ভিত্তিতে উদ্যোগ না নিলে বিলুপ্ত ডাইনোসরের মতো পরবর্তী প্রজন্ম হাতির ছবি দেখতে পাবে।

বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা সংরক্ষণ বিভাগের চট্টগ্রাম বিভাগীয় প্রধান রফিকুল ইসলাম চৌধুরী জানান, পার্বত্য চট্টগ্রাম, কক্সবাজার উত্তর ও দক্ষিণ এবং চট্টগ্রাম দক্ষিণ বন বিভাগের বনাঞ্চলে হাতি চলাচলের ১২ টি করিডোর রয়েছে। এসব করিডোর দিয়ে বংশ পরম্পরায় হাতি চলাচল করতো। করিডোরগুলো হলো, কক্সবাজার দক্ষিণ বনাঞ্চলের উখিয়া থেকে ঘুনধুম, তুলাবাগান থেকে জানের ছড়া, নাইক্ষ্যংছড়ি থেকে রাজারকুল, কক্সবাজার দক্ষিণ বনাঞ্চলের ভোমারিয়া থেকে ঘোনা রাজঘাট, নাইক্ষ্যংছড়ির তুলাতলি থেকে ঈদগড়, খুটাখালি থেকে মেধাকচ্ছপিয়া, ফাঁসিয়াখালি থেকে চকরিয়া, ফাঁসিয়াখালি থেকে মানিকপুর, চট্টগ্রাম দক্ষিণ বনবিভাগের চুনতি থেকে সাতগড়, চন্দনাইশের লালুটিয়া থেকে সাতকানিয়ার বরদোয়ারা, রাঙ্গুনিয়ার সুখবিলাস থেকে কোদালা ও নারিচ্ছ্যা থেকে কোদালা।

এছাড়া আনোয়ারা-বাঁশখালীর জলদি, লোহাগাড়ার চুনতি বোয়ালখালী, নারিচ্ছ্যা ও বান্দরবানের লামার বিস্তীর্ণ পাহাড়ি এলাকজুড়ে হাতির পদচারণা রয়েছে। বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনার এ কর্মকর্তা বলেন, রোহিঙ্গা ক্যাম্পের কারণে হাতি চলাচলের গুরুত্বপূর্ণ করিডোরগুলো বন্ধ হয়ে গেছে। বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে এশীয় বুনো হাতি যাতায়াতের করিডোর হিসাবে চুনতি অভয়ারণ্যে অন্যতম। এ অভয়ারণ্য হাতির অন্যতম প্রজনন ক্ষেত্র। চুনতি অভয়ারণ্যের ভেতর দিয়ে ১০ কিলোমিটার রেলপথ তৈরি হচ্ছে। এতে হাতি চলাচলের ১১টি করিডোর বন্ধ হয়ে যাবে। সংরক্ষিত বনে হাতি চলাচলের জন্য পাঁচটি স্থায়ী ও ছয়টি মৌসুমি পথ রয়েছে। রেললাইন নির্মিত হলে ওই সব পথে হাতির চলাচল ব্যাহত হবে।

বিখ্যাত এশীয় প্রজাতির হাতি বিলুপ্তির হুমকিতে পড়বে। আনোয়ারার যে স্থানে কেইপিজেডের বিভিন্ন কারখানা গড়ে উঠেছে ওই এলাকাটি হাতির বড় আকারের আবাসস্থল। মাঝে মাঝে সেখানে হাতি আর মানুষের দ্বন্দ্ব তৈরি হচ্ছে। তবে রেল বিভাগ জানিয়েছে, তিনটি অভয়ারণ্য চুনতি, খুটাখালীর মেধাকচ্ছপিয়া ও ফাঁসিয়াখালির ২৭ কিলোমিটার রেলপথে হাতির চলাচলের জন্য আন্ডারপাস রাখা হবে। ওই পথ দিয়ে হাতি চলাচল করলে নির্দিষ্ট দূরত্ব থেকে ট্রেন চালক বিশেষ সংকেতের মাধ্যমে বুঝতে পারবে এবং ট্রেন থেমে যাবে।

বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞ জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক মনিরুল এইচ খান জানান, যেভাবে করার কথা আন্ডারপাসগুলো সেভাবে করলে হাতি চলাচল করবে। কিন্তু এখন যেভাবে আন্ডারপাস করা হচ্ছে তা আমি দেখেছি। এসব আন্ডারপাস ছোট হয়ে গেছে। হাতি চলাচলের জন্য নিয়ম অনুযায়ী ডিজাইন করা হয়নি। হাতি চলাচলের জন্য উপযুক্ত ও যথেষ্ট নয়। হাতি যে পথে চলাচল করে সেই পথ খোলা রাখা ছাড়া কোন বিকল্প নেই। হাতির মতো বড় প্রাণী ছোট এলাকায় রাখা যাবে না। তার স্বভাবই হচ্ছে বিস্তীর্ণ এলাকায় ঘুরবে। অপরিকল্পিতভাবে বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন স্থাপনা হয়েছে, সরকারি বিভিন্ন স্থাপনা তৈরি হয়েছে। এসব কারণে যে করিডোরগুলো বন্ধ হয়ে গেছে করিডোরগুলো অন্তত সব জায়গায় না হোক- হাতি ঠিকিয়ে রাখতে গেলে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি করিডোর খোলা রাখা ছাড়া বিকল্প নেই ।

অধ্যাপক মনিরুল বলেন, হাতির আবাসস্থলে বিভিন্ন ধরনের ফসল চাষাবাদ হচ্ছে। যখন কোন ফসল কোথাও চাষ হয় সেখানে হাতি অনেক বেশি খাবার পায়। যারফলে হাতি সেখানে আকৃষ্ট হয়। পাহাড়ে যদি খাবার থাকেও সেখানে এক জায়গায় অনেক খাবার থাকে না। ক্ষেতে এক জায়গায় অনেক খাবার থাকে। যখন হাতির আবাসস্থলে চাষাবাদ হয় তখন হাতি খাবারের জন্য প্রলুদ্ধ হয় আর মানুষ তখন ফসল রক্ষার চেষ্টা করে। আর রক্ষা করতে হাতির সঙ্গে মানুষের দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়। অনেক ক্ষেত্রে মানুষ মারা পড়ে। হাতির আবাসস্থল যদি নিরাপদ রাখা যায়, চাষাবাদ বন্ধ করা যায় তাহলে হাতি মানুষের দ্বন্দ্ব কমানো যাবে। বাংলাদেশ বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইন ১৯৭৪-এর আলোকে ১৯৮৬ সালে সাত হাজার ৭৬৪ হেক্টর সংরক্ষিত বনভূমি নিয়ে চুনতি অভয়ারণ্য প্রতিষ্ঠা করা হয়। রেললাইনে বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল খ-িত হয়ে পড়বে। ফলে বন্যপ্রাণীর বিচরণ সীমিত হয়ে পড়বে।

পাঠকের মতামত: