ডেস্ক নিউজ:
একটি ভিডিও ফুটেজ নয় মিনিট ছয় সেকেন্ডের। এতে দেখা যাচ্ছে, সাদা পাজেরো গাড়িতে আসা এক ব্যক্তি রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে দুজনের কাছ থেকে টাকা নিচ্ছেন। একজনের কাছ থেকে নিলেন পাঁচ হাজার, অন্যজনের কাছ থেকে তিন হাজার। টাকাগুলো গুনে তিনি পকেটে ঢোকালেন। এরপর তাঁর সঙ্গে আসা আরও তিনজনকে নিয়ে গাড়িতে ওঠেন।
ভিডিওটি হাতে আসার পর খোঁজ নিয়ে জানা গেল, টাকা নেওয়া ওই লোকটি পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) কর্মকর্তা। এক বছর আগে সাভারের আশুলিয়ার শেখ শাওন নামে সাড়ে চার বছরের এক শিশু নিখোঁজের মামলার তদন্তে এসেছিলেন তিনি। যাঁর কাছ থেকে তিনি টাকা নিয়েছেন, তিনিই এই অপহরণ মামলার আসামি, নাম মো. মাসুম (২৮)।
স্থানীয় ব্যক্তিদের মাধ্যমে মাসুমের সঙ্গে যোগাযোগ করে জানা যায়, সিআইডির এই কর্মকর্তার নাম ওবায়দুর রহমান। তাঁর অভিযোগ, ‘কলমের খোঁচায় জীবন শেষ করে দেওয়ার’ হুমকি দিয়ে ওবায়দুর রহমান তাঁর কাছ থেকে এখন পর্যন্ত ২ লাখ ২২ হাজার টাকা নিয়েছেন। স্থানীয় ব্যক্তিরা বলছেন, নিখোঁজ শিশুটিকে খোঁজার কার্যকর কোনো উদ্যোগ তাঁরা সিআইডিকে নিতে দেখেননি। শুধু মাঝেমধ্যে ডেকে টাকা নেয়। নিখোঁজ শিশুটি যেন হয়ে উঠেছে সিআইডি কর্মকর্তার ‘টাকার গাছ’। সিআইডির এক কর্মকর্তার কাছে ওবায়দুরের মুঠোফোন নম্বর নিয়ে সম্প্রতি তাঁকে ফোন করা হয়। ফোনে জানতে চাওয়া হয় তিনি সিআইডির কর্মকর্তা ওবায়দুর কি না। জবাব আসে, ‘জি, বলছি।’ পরে সাংবাদিক পরিচয় দিলেই তিনি ‘রং নাম্বার’ বলে ফোনটি কেটে দেন। এরপর একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি ধরেননি। মুঠোফোনে পাঠানো খুদেবার্তারও কোনো জবাব দেননি।
মুঠোফোন নম্বরটি আসলেই কার—জানতে সিআইডির ঢাকা বিভাগের বিশেষ সুপার মোহাম্মদ আবু সুফিয়ানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, এটি সিআইডি ঢাকা বিভাগের উপপরিদর্শক (এসআই) ওবায়দুর রহমানের। তারপরও নিশ্চিত হতে গত বুধবার মোহাম্মদ আবু সুফিয়ানের কার্যালয়ে গিয়ে তাঁকে ভিডিও ফুটেজটি দেখানো হয়। ফুটেজ দেখে তিনি বলেন, ঢাকা বিভাগে ৩০-৪০ জন এসআই আছেন, সবার সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হয় না। তাই ফুটেজে চেহারা দেখে তিনি পরিচয় সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারছেন না। ওবায়দুরের পরিচয় নিশ্চিত হতে তিনি সিআইডির ঢাকা বিভাগের সহকারী পুলিশ সুপার খোরশেদ আলমকে তাঁর কার্যালয়ে ডাকেন। ফুটেজ দেখে খোরশেদ আলম নিশ্চিত করেন, টাকা নেওয়া ওই ব্যক্তি সিআইডির ঢাকা বিভাগের এসআই ওবায়দুর রহমান। ২০১৬ সালের ১২ মার্চ আশুলিয়া থানায় দায়ের হওয়া শিশু অপহরণ মামলার তদন্ত কর্মকর্তা তিনি।
ওই মামলার বাদী নিখোঁজ শিশু শাওনের বাবা শেখ সুমন এজাহারে উল্লেখ করেন, ২০১৫ সালের ২০ ডিসেম্বর বিকেল চারটার দিকে শাওন আশুলিয়ার পূর্ব ধনিয়ার স্টারলিং গার্মেন্টসের পেছনের একটি বালুর মাঠে খেলছিল। পরে তাকে আর পাওয়া যায়নি। তাঁর অভিযোগ, প্রতিবেশী মাসুম ও তাঁর অজ্ঞাতনামা সহযোগীরা শাওনকে অপহরণ করে অজ্ঞাত স্থানে আটকে রেখেছেন।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ওবায়দুর রহমানআশুলিয়া থানা থেকে ৬ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে পূর্ব ধনিয়া গ্রাম। মামলাটি সম্পর্কে খোঁজ নিতে সম্প্রতি ওই গ্রামে গিয়ে জানা গেছে, পূর্ব ধনিয়ার ছোট একটি আধা পাকা বাড়িতে ভাড়া থাকতেন সুমন-কুলসুম দম্পতি। তাঁরা যখন স্থানীয় পোশাক কারখানায় কাজে যেতেন, শাওনের দেখভাল করতেন মামলার আসামি মাসুমের মা-বাবা। মাসুমেরও একই বয়সী একটি ছেলে রয়েছে, তার সঙ্গেই ছিল শাওনের বন্ধুত্ব।
মাসুম ও সুমনের কয়েকজন পুরোনো প্রতিবেশী বলেন, মাসুমের মা-বাবা শাওনকে নিজের নাতির মতোই আদর-যত্ন করতেন। মাসুমও ভালোবাসতেন শাওনকে। কেন মাসুমের বিরুদ্ধে অপহরণের অভিযোগ উঠল, তা তাঁরা জানেন না। অপহরণ মামলার পর সুমন তাঁর স্ত্রীকে নিয়ে ওই এলাকা ছেড়ে দক্ষিণ সিন্ধুরিয়ার গ্রামের বাড়িতে চলে গেছেন।
শাওন নিখোঁজ হওয়ার ঘটনা সম্পর্কে স্থানীয় লোকজন বলেন, ওই সময় বালুর মাঠটিতে সরলতা হাউজিংয়ের প্লট তৈরির কাজ চলছিল। পাইপে টেনে আনা বালু সমান করতে এক্সকাভেটর যন্ত্র (ভেকু মেশিন) চালানো হচ্ছিল। শাওনকে খুঁজে না পেয়ে কেউ কেউ সন্দেহ করেন, এই ভেকু মেশিনের নিচে পড়ে শাওন মারা গিয়ে থাকতে পারে। এ সন্দেহ থেকে মাঠের বিভিন্ন স্থানের মাটি তুলে দেখেন স্থানীয় লোকজন। কিন্তু শাওনকে পাওয়া যায়নি।
মাসুমকে আসামি করার কারণ সম্পর্কে সুমন বলেন, মাসুমের সঙ্গে তাঁদের কোনো শত্রুতা ছিল না। ঘটনার এক মাস পর মাসুম এলাকা থেকে চলে যান। তাই তাঁকে সন্দেহ হয়।
এ সম্পর্কে আসামি মাসুম বলেন, ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে নারায়ণগঞ্জে তাঁর একটি ভালো চাকরি হয়। নতুন চাকরিতে যোগ দিতে তিনি নারায়ণগঞ্জে গিয়েছিলেন। গ্রামের পরিচিত ব্যক্তিদের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ ছিল। তিনি বলেন, মার্চ মাসের শুরুতে মুঠোফোনে আশুলিয়া থানার পুলিশ তাঁকে নারায়ণগঞ্জ থেকে থানায় আসতে বলে। ৯ মার্চ তিনি থানায় এলে তাঁকে আটক করা হয়। এরপর তিন দিন আটকে রেখে শারীরিক নির্যাতন করে ১২ মার্চ তাঁর বিরুদ্ধে অপহরণের মামলা করা হয়। ১৩ মার্চ তাঁকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে কারাগারে পাঠানো হয়।
স্থানীয় লোকজন বলেছেন, মাসুম যখন কারাগারে, তখন ভোল পাল্টান সুমন। সে সময় সুমন অভিযোগ করা শুরু করেন যে স্থানীয় আবাসন ব্যবসায়ী সরলতা হাউজিংয়ের মালিক শাহাজউদ্দিন তাঁর ছেলে শাওনকে বালুর মাঠে হত্যা করে লাশ গুম করেছেন। এই অভিযোগে ২০১৬ সালের ৭ মে সাভারের সিটি সেন্টারের সামনে মানববন্ধনও করেন সুমন ও তাঁর স্বজনেরা।
যোগাযোগ করা হলে শাহাজউদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ঘটনার দিন মাঠের সব জায়গা ও আশপাশের বিভিন্ন এলাকায় শিশুটিকে খোঁজা হয়েছে। আর ঘটনার তিন মাস পর পর্যন্ত ভেকুর চালক সেখানে ছিলেন। কাজ শেষে তিনি চলে গেছেন। চালকের নাম-ঠিকানা তাঁর মনে নেই। তাঁর বিরুদ্ধে মানববন্ধনের কারণ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘আমার বদনাম করতে এবং কিছু টাকার আশায় সুমন এ কাজ করেছিল।’
প্রথমে একজনের নামে মামলা, পরে আবার অন্যজনের বিরুদ্ধে হত্যার অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে সুমন কোনো জবাব না দিয়ে বলেন, অপরাধী যেই হোক, তিনি ন্যায়বিচার এবং সন্তানের সন্ধান চান।
কিন্তু ঘটনার ১৪ মাসেও আশুলিয়া থানা-পুলিশ কিংবা সিআইডি শিশুটির সন্ধান দিতে পারেনি। মাসুমের পরিবারের দাবি, শাওনের নিখোঁজ সম্পর্কে তাঁরা কিছুই জানেন না। অকারণে মামলায় মাসুমকে ফাঁসানো হয়েছে। আর এই মামলা সামাল দিতে গিয়ে ইলেকট্রিশিয়ানের কাজ করা মাসুম ও তাঁর পরিবার নিঃস্ব হয়ে গেছে। কিছুদিন পরপর সিআইডি কর্মকর্তা তাঁকে তাঁদের কার্যালয়ে ডাকেন আর জীবন শেষ করে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে টাকা নেন।
৯ মিনিট ৬ সেকেন্ডের ভিডিও ফুটেজটি দেখে মাসুমের এক আত্মীয় বলেন, ভিডিওটি গত ২৫ নভেম্বরের। ওই দিন মামলার তদন্ত করতে ওবায়দুর রহমান পূর্ব ধনিয়ায় এসেছিলেন। কিন্তু তদন্ত শুরুর আগে ২০ হাজার টাকা দাবি করেন। পরে ৮ হাজার টাকায় রফা হয়।
মামলার তদন্তে এসে আসামির কাছ থেকে টাকা নেওয়া সম্পর্কে জানতে চাইলে সিআইডি ঢাকা বিভাগের সহকারী পুলিশ সুপার খোরশেদ আলম বলেন, ‘টাকা নেওয়া ঠিক হয় নাই। টাকা নিলে ভুল করেছে।’ এ প্রসঙ্গে সিআইডি ঢাকা বিভাগের বিশেষ সুপার মোহাম্মদ আবু সুফিয়ান বলেন, কেউ এ ধরনের অভিযোগ করলে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
ওই ভিডিও ফুটেজ এবং একই সময়ের ১৭ মিনিট ১৯ সেকেন্ডের আরেকটি ভিডিও ফুটেজে দেখা গেছে, ওই দিন ওবায়দুর ঢাকা মেট্রো ঘ ১৩-৭১৭০ নম্বরের একটি সাদা পাজেরো গাড়িতে এসেছিলেন। গাড়িটি আশুলিয়ার কোহিনূর গেট বাসস্ট্যান্ডের পাশে জাতীয় বস্ত্র প্রকৌশল ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সামনে দাঁড় করানো ছিল। আসামিপক্ষের কাছ থেকে টাকা নেওয়ার পর ওবায়দুর ওই গাড়ির চালকের পাশের আসনে বসেন। মাসুমের বাবাকে গাড়ির পেছনের সিটের মাঝখানে বসানো হয়। মাসুমের বাবার দুই পাশে আরও দুজন ছিলেন। এরপর গাড়িটি চলতে শুরু করে।
-প্রথমআলো
পাঠকের মতামত: