ঢাকা,রোববার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪

রোহিঙ্গাদের রক্তে লাল নাফ নদীর বিশাল জলরাশি

248662_124ফরিদুল মোস্তফা খান, কক্সবাজার থেকে :::

নাফ নদীর বিশাল জলরাশি লাল হয়েছে বারবার রোহিঙ্গাদের রক্তে। জলজ প্রাণি ও শিয়াল কুকুরের আহার হয়েছে রোহিঙ্গা মুসমানরা। বাদ যাননি হিন্দুরাও । নিষ্ঠুর সামরিক জান্তা বারবার এদের নিপীড়ন করেছে যুগের পর যুগ ধরে। নাফ নদীতে অসহায় রোহিঙ্গাদের লাশ ভাসার খবর নতুন কিছু নয়। ১৭৮৪ সালে তৎকালীন বর্মি রাজা ভোদাপায়া দখল করে নেন স্বাধীন সমৃদ্ধ জনপদ আরাকান রাজ্য। ইতিহাস সাক্ষী ভোদাপায়ার নিষ্ঠুরতা থেকে রেহাই পেতে তখন আরাকানের তিন ভাগের দুই ভাগ মানুষ চট্টগ্রামে পালিয়ে আসে। রোহিঙ্গাদের রক্তে তখনো লাল হয়ে ওঠে নাফ নদীর পানি। নাফ নদীর পানি লাল হয়েছে বারবার রোহিঙ্গাদের রক্তে। নাফ নদীতে অসহায় রোহিঙ্গাদের লাশ ভাসার খবর নতুন কিছু নয়। ১৭৮৪ সালে তৎকালীন বর্মি রাজা ভোদাপায়া দখল করে নেন স্বাধীন সমৃদ্ধ জনপদ আরাকান রাজ্য। ইতিহাস সাক্ষী ভোদাপায়ার নিষ্ঠুরতা থেকে রেহাই পেতে তখন আরাকানের তিন ভাগের দুই ভাগ মানুষ চট্টগ্রামে পালিয়ে আসে। রোহিঙ্গাদের রক্তে তখনো লাল হয়ে ওঠে নাফ নদীর পানি। এক সময় গৌড় (বর্তমান চাঁপাইনবাবগঞ্জ) কেন্দ্রিক বাংলার সুলতানদের অধীন ছিল সমৃদ্ধ আরাকান রাজ্য। এরপর দিল্লির মোগলদের কারণে বাংলার সুলতানদের ক্ষমতা খর্ব হলে আরাকান অনেকটা স্বাধীন হয়ে যায়। পরে আবার আরাকান রাজ্যের স্বাধীনতা বিলুপ্ত হওয়া এবং শেষ পর্যন্ত বর্মি রাজাদের দখলের পেছনে রয়েছে এক দীর্ঘ ও মর্মান্তিক ইতিহাস। দিল্লির সিংহাসন দখলের লড়াইয়ে পরাজিত হয়ে মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেবের ভাই শাহ সুজা ১৬৬০ সালে আশ্রয় নেন তৎকালীন বার্মার আরাকানে (বর্তমান রাখাইন)। সাথে ছিল বিরাট এক অনুগত বাহিনী। তখন আরাকান বা রোসাঙ্গরাজা ছিলেন চন্দ্র সু ধর্ম্মা। তিনি শাহ সুজাকে সম্মানের সাথে আশ্রয় দিলেও পরে বিশ্বাস ভঙ্গ করেন এবং সপরিবারে নির্মমভাবে নিহত হন শাহ সুজা। কথা ছিল শাহ সুজা কিছু দিন আরাকানে অবস্থান শেষে তাকে সপরিবারে মক্কায় পাঠানোর ব্যবস্থা করা হবে। কিন্তু চন্দ্র সু ধর্ম্মা শাহ সুজার সুন্দরী কন্যা আমিনাকে দেখে মুগ্ধ হন এবং তাদের মক্কায় পাঠানোর বিষয়ে গড়িমসি করতে থাকেন। একপর্যায়ে তিনি আমিনাকে বিয়ের প্রস্তাব পাঠান। কিন্তু শাহ সুজা তাতে রাজি না হলে এ নিয়ে উভায়ের মধ্যে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়। শেষ পর্যন্ত তা যুদ্ধে রূপ নেয়। চন্দ্র সু ধর্ম্মার উচ্চপদস্থ সেনা কর্মকর্তাদের অনেকে ছিল মুসলমান। শাহ সুজা উচ্চপদস্থ মুসলিম সেনা কর্মকর্তাদের সহায়তা চান কিন্তু তারা সাহায্য করতে অস্বীকার করেন। ফলে চন্দ্র সু ধর্ম্মার সৈন্যদের হাতে ১৬৬৪ সালে নির্মমভাবে নিহত হন দিল্লির সম্রাট শাহজাহানের পুত্র মোগল যুবরাজ ঢাকার এক সময়কার নবাব শাহ সুজা। যুবরাজ শাহ সুজার সাথে নির্মমভাবে হত্যা করা হয় তার পুত্র, কন্যা এবং স্ত্রীকেও। তারা শুধু হত্যা করেই ক্ষান্ত হয়নি; বরং ঢাকা থেকে হুগলি পর্যন্ত সমুদ্র ও নৌপথে তারা লুণ্ঠন ও হত্যাযজ্ঞ বাড়িয়ে দেয়। সমগ্র বাংলা হাহাকার ও মাতমে ভেঙে পড়ল। শাহ সুজার মৃত্যুর পর আরাকানে দীর্ঘকালের জন্য নেমে আসে এক ভয়াবহ অরাজকতা। আরাকানসহ দিল্লির মুসলমানেরা প্রথমে শোকে বিহবল হয়ে পড়েন নির্মম এ হত্যাকাণ্ডে। এরপর তীব্র ক্ষোভে ফেটে পড়েন তারা। বাংলা এবং দিল্লি থেকে এ সময় অনেকে আরাকানে গমন করেন এ হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য। আরাকানে ছড়িয়ে পড়ে চরম বিশৃঙ্খলা। একের পর এক রাজার পতন হতে থাকে। এরই ধারাবাহিকতায় ১৭৮৪ সালে বার্মা রাজা দখল করে নেয় আরাকান। এ দিকে এর আগে ভাই শাহ সুজার মৃত্যুর খবরে মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেব তার মামা ঢাকার নবাব শায়েস্তা খানকে নির্দেশ দেন এর প্রতিকারের। কিন্তু মগ জলদুস্যদের মোকাবেলায় উপযুক্ত নৌবাহিনী গড়ে তুলতে বেশ সময় লাগে নবাব শায়েস্তা খানের। কারণ মোগলরা নৌশক্তিতে খুবই দুর্বল ছিল তখন। অবশেষে ১৬৬৬ সালে মগ জলদস্যুদের সম্পূর্ণরূপে পর্যদুস্ত করে নবাব শায়েস্তা খান চট্টগ্রাম দখল করেন এবং নাম দেন ইসলামাবাদ। এভাবে বাংলার উপকূলবাসী নিস্তার পায় মগ জলদস্যুদের অত্যাচার থেকে। এর আগে মোগল সেনাপতি ফতে খান মগ পর্তুগিজ জলদস্যুদের পরাজিত করে সন্দ্বীপ দখল করেন ১৬০৭ সালে। পরে ১৬০৯ সালে তিনি মগ পর্তুগিজ জলদস্যুদের সাথে এক যুদ্ধে নিহত হন। নবাব শায়েস্তা খানের চট্টগ্রাম বিজয়ে যাদের অবদান স্মরণীয় হয়ে আছে তাদের মধ্যে হলেন শায়েস্তা খানের পুত্র উমেদ খান ও সেনাধ্যক্ষ হোসেন বেগ। ভোদাপায়ার অধীনে আরাকান লুণ্ঠন১৭৮৪ সালে বার্মার রাজা ভোদাপায়া আরাকান আক্রমণ করে দখলে নেন এবং একে তৎকালীন বার্মার একটি প্রদেশে পরিণত করেন। এর মাধ্যমে অবসান ঘটে হাজার বছরের স্বাধীন আরাকান রাজ্য এবং প্রাচুর্যে ভরপুর এক সভ্যতার। এ সময় বর্মি বাহিনীর অত্যাচারে মগ মুসলিম নির্বিশেষে অনেক মানুষ চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে পালিয়ে এসে বসবাস শুরু করে। রাজা ভোদাপায়া যখন আরাকান দখল করেন তখন আরাকানের চেয়ে বার্মা অনেক পশ্চাৎপদ ছিল। ইতিহাসে বর্ণিত হয়েছে আরাকানের মুদ্রা ব্যবস্থা, বিচার ব্যবস্থা দেখে বিস্মিত হন বার্মার রাজা ভোদাপায়া। তিনি তার রাজ্যে আরাকানের অনুরূপ মুদ্রা ও বিচার ব্যবস্থা চালুর জন্য তিন হাজার ৭০০ মুসলমানকে বার্মায় নিয়ে যান। আরাকান থেকে লুণ্ঠিত মালামাল বহনের জন্য জোরপূর্বক হাজার হাজার মগ, আরাকানিদের নিয়োজিত করা হয়। এ সময় দুর্গম পথে অসংখ্য মানুষের মৃত্যু হয়। তা ছাড়া আরাকানে চালু করা হয় উচ্চ কর। ভোদাপায়ার লুণ্ঠনের কারণে দারিদ্র্য নেমে আসে আরাকানে। ভোদাপায়ার অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে একপর্যায়ে তারই নিযুক্ত আরাকানের গভর্নর ঘা থানডি কয়েক শত অনুচর নিয়ে পালিয়ে এসে আশ্রয় নেন কক্সবাজারে। এখান থেকে তিনি রাজা ভোদাপায়ার বিরুদ্ধে আরাকানের স্বাধীনতার জন্য লড়াই শুরু করেন। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস হলো ঘা থানডিই রাজা ভোদাপায়াকে আরাকান দখলের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন এক সময়। বর্মি বাহিনীর নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ড আর অত্যাচারে ১৭৯৮ সালের মধ্যে আরাকানের তিন ভাগের এক ভাগ মানুষ চট্টগ্রামে আশ্রয় নেয়। বর্মি বাহিনীর হত্যাকাণ্ডে নাফ নদীর পানি লাল হয়ে ওঠে। এ সময় দৈনিক ২০ জন শিশু মারা যায় চট্টগ্রামে আসা শরণার্থীদের মধ্যে। ১৮১৯ সালে মৃত্যু হয় রাজা ভোদাপায়ার। এরপর তার দৌহিত্র বাজিদ ক্ষমতায় বসেন। বাজিদ ১৮২৪ সালে চট্টগ্রাম দখলে অভিযান চালান। এ সময় থেকে শুরু হয় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সাথে বর্মি বাহিনীর যুদ্ধ। ১৮২৬ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সাথে যুদ্ধে পরাজিত হয়ে তৎকালীন বার্মা রাজা চুক্তি করে এবং চুক্তিতে বর্মি সরকার আরাকান, আসাম ও ত্রিপুরার ওপর থেকে তাদের দাবি প্রত্যাহার করে নেয়। এরপর ব্রিটিশরা ১৮৩৬ সালে বিনাযুদ্ধে রেঙ্গুন পর্যন্ত অগ্রসর হয় এবং পুরো বার্মা দখল করে নেয়। তবে আরাকান ছাড়া বাকি অঞ্চল ক্ষতিপূরণের বিনিময়ে আবার ছেড়ে দেয় তারা। কিন্তু বার্মা সরকারের বিশ্বাসঘাতকতার কারণে ১৮৫২ সালে আবার ব্রিটিশরা আক্রমণ পরিচালনা করে বার্মা দখল করে। একপর্যায়ে আবার আরাকানসহ সমগ্র বার্মা ব্রিটিশদের দখলে চলে যায় এবং আরাকান থেকে ফেরত আসা অনেকে আবার সেখানে ফিরে যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শুরুতে ১৯৪২ সালে জাপানিরা ব্রিটিশদের কাছ থেকে বার্মা দখল করে। এ সময় ছড়িয়ে পড়া দাঙ্গায় হাজার হাজার রোহিঙ্গা মুসলিম ও বৌদ্ধ নিহত হয়। তখন বিপুল রোহিঙ্গা পূর্ব বাংলায় আশ্রয় নেয়। ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত আরাকানসহ পুরো বার্মা জাপানিদের দখলে থাকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আরাকানসহ বার্মা আবার ব্রিটিশদের অধীনে চলে যায়। ১৯৪৮ সালে বার্মা স্বাধীন হলে আরাকানকে বার্মার ভাগে দেয়া হয়। তখনো বিপুল আরাকানি চট্টগ্রামে আগমন করে। এ ছাড়া ১৯৭৮, ১৯৯১ থেকে ১৯৯২ সালে কয়েক লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নেয় বর্মি বাহিনীসহ স্থানীয় প্রতিপক্ষের হত্যাকাণ্ড থেকে বাঁচার জন্য। এভাবে ইতিহাসে বর্ণিত রয়েছে বার্মায় রোহিঙ্গা নামক এক জনগোষ্ঠীর প্রতি বারবার নিষ্ঠুরতা আর রক্তপাতের ইতিহাস। সুদীর্ঘ ১০০ বছর বাংলার সুলতানদের অধীনে থেকে আরাকানিরা জ্ঞান, বিজ্ঞান, শিক্ষা ও সংস্কৃতিসম্পন্ন এক উন্নত জাতিতে পরিণত হয়। আর বর্মি রাজারা বারবার আরাকান আক্রমণ করে হত্যা আর লুণ্ঠনে তা ছারখার করেছে।

পাঠকের মতামত: