ঢাকা,সোমবার, ১৮ নভেম্বর ২০২৪

রামুর সংরক্ষিত বনে দীর্ঘ সড়ক নির্মাণের উদ্যোগ

ইব্রাহিম খলিল মামুন, কক্সবাজার :: কক্সবাজারের রামুতে সংরক্ষিত বনের বুক চিরে একটি সড়ক নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি)। ইতোমধ্যে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় প্রকল্পটি অনুমোদনও হয়ে গেছে। তবে বন বিভাগ এ সড়কটির বিপক্ষে। পরিবেশ অধিদপ্তরের অনুমোদনও নেওয়া হয়নি।

বন বিভাগ জানিয়েছে, সড়কটি নির্মাণ করা হলে গর্জন, জাম, থেনশুর, বাটনা, চাপালিশ, আকাশমণি, গামারি, আছারগোল, ডুমুর, বটগাছসহ বিভিন্ন প্রজাতির সৃজিত ও প্রাকৃতিক অন্তত ৭০ হাজার গাছ কাটা পড়বে। কাটতে হবে বড় বড় পাহাড়। এই বন আন্তর্জাতিক প্রকৃতি সংরক্ষণের জোট আইইউসিএনের তালিকাভুক্ত মহাবিপদাপন্ন এশিয়ান হাতির আবাসভূমি। এ ছাড়াও হরিণ, বানর, মেছোবাঘ, শিয়াল, সাপ, শজারু, শূকরসহ অন্তত একশ প্রজাতির বন্যপ্রাণী ও বিভিন্ন প্রজাতির পাখির আবাসস্থল এটি।

তা সত্ত্বেও রামু উপজেলার খুনিয়াপালং ইউনিয়নের শহীদ এটিএম জাফর আলম মাল্টি ডিসিপ্লিন একাডেমি থেকে কক্সবাজার সমুদ্রসৈকত সংলগ্ন মেরিন ড্রাইভ পর্যন্ত ৫ কিলোমিটার দীর্ঘ ও ১৮ ফুট প্রশস্ত সড়কটি তৈরির কাজ এগিয়ে চলেছে। এ জন্য প্রাথমিক ব্যয় ধরা হয়েছে ২৭২ কোটি টাকা। বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে সড়কটি নির্মাণ করতে বর্তমানে কাজ চলছে বলে জানিয়েছেন এলজিইডির এক কর্মকর্তা।

ওই এলাকাটি সংরক্ষিত বন হওয়ায় সড়কটি নির্মাণ না করতে সম্প্রতি বন বিভাগের পক্ষ থেকে এলজিইডিকে একটি চিঠিও দেওয়া হয়েছে। এলজিইডির কক্সবাজারের নির্বাহী প্রকৌশলীকে কক্সবাজার দক্ষিণ বন বিভাগের বিভাগীয় কর্মকর্তা সারওয়ার আলমের দেওয়া চিঠিতে বলা হয়েছে, বন্যপ্রাণী, জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশ সংরক্ষণের স্বার্থে সড়কটি নির্মাণ করা সমীচীন হবে না।

সারওয়ার আলম বলেন, এলজিইডি যেখানে সড়ক নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে; ওই এলাকা পুরোটাই সংরক্ষিত বন এবং প্রতিবেশ সংকটাপন্ন এলাকা। এ ছাড়াও ৫ কিলোমিটারের অধিকাংশ জায়গা হিমছড়ি জাতীয় উদ্যানের মধ্যে পড়বে। তাই সড়কটি নির্মাণ করলে প্রাকৃতিক পরিবেশ ও বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল মারাত্মক সংকটে পড়তে পারে। তিনি বলেন, এলজিইডি সংরক্ষিত বনে সড়ক নির্মাণ কার্যক্রম একনেক পর্যন্ত নিয়ে গেলেও বন বিভাগকে এখনও লিখিতভাবে কিছু জানায়নি।

শনিবার সরেজমিন দেখা যায়, যে বনটি কেটে সড়ক নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে; সেখানে বন বিভাগের বিভিন্ন সময়ে সৃজন করা বাগান রয়েছে। এ ছাড়া ছোট-বড় গাছে সমৃদ্ধ প্রাকৃতিক বনও দেখা গেছে। স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, এ বনে ৫০টির মতো বিপন্ন এশিয়ান হাতির একটা পাল আছে। সড়কটি নির্মাণ করা হলে হাতির পাল বিপদে পড়বে। লোকালয়ে এসে মানুষের ওপর হাতির আক্রমণ করার প্রবণতাও বেড়ে যাবে।

বনভূমি দেখাশোনা করার জন্য গেজেটভুক্ত হিমছড়ি জাতীয় উদ্যানের সহব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি আয়াছুর রহমান বলেন, ‘এ বনে হাতির বিচরণ আছে। বন কেটে সড়ক নির্মাণ করা হলে ওদের অসুবিধা হবে। ভবিষ্যতে এখানে কোনো বন থাকবে না। বন বিভাগের তথ্যমতে, ডি-রিজার্ভ করা, দখল-বেদখল, ইজারা দেওয়া এবং বন উজাড়ীকরণের কারণে হাতির বিচরণক্ষেত্র দিন দিন সংকুচিত হয়ে আসছে। ফলে হাতি ও মানুষের মধ্যে সংঘাত বাড়ছে।’

পরিবেশ অধিদপ্তর-কক্সবাজার জেলা কার্যালয়ের উপপরিচালক মুহম্মদ হাফিজুর রহমান বলেন, তাঁর জানামতে, সংযোগ সড়কটি নির্মাণে পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে কোনো ছাড়পত্র নেওয়া হয়নি। তবে বনের মধ্যে এ রকম সড়ক নির্মাণ করতে হলে অবশ্যই ছাড়পত্র নিতে হবে।

এ সম্পর্কে কক্সবাজার এলজিইডির নির্বাহী প্রকৌশলী আনিসুর রহমান বলেন, অর্থায়নের বিষয়টি নিশ্চিত হলে বন বিভাগ ও পরিবেশ অধিদপ্তরের সঙ্গে কথা বলে সড়কটি নির্মাণ করা হবে।

বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, ‘এভাবে সংরক্ষিত বন কেটে সড়ক নির্মাণ করা উচ্চ আদালতের রায়ের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।

২০১৯ সালে উচ্চ আদালত কক্সবাজারের আর কোনো বনভূমি কোনো ব্যক্তি বা সংস্থাকে নতুন করে বরাদ্দ না দিতে সরকারকে নির্দেশ দিয়েছিলেন। তিনি বলেন, কক্সবাজারের মোট বনভূমির এক-তৃতীয়াংশ এরই মধ্যে ধ্বংস হয়ে গেছে। নতুন করে সংরক্ষিত বন কেটে সড়ক নির্মাণের কোনো যৌক্তিকতা নেই।

পাঠকের মতামত: