রমজান মাস অন্যসব মাসের মত সাধারণ কোন মাস নয়। এটি অত্যন্ত পবিত্র মাস, পূণ্যের মাস। রহমত, বরকত ও মাগফিরাতের মাস মাহে রমজান। এই পুরো মাসটিই ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যে পূর্ণ। এই মাসেই পবিত্র কোরআন মজিদ নাযিল হয়েছে। তাই এই পবিত্র মাসে রোজা বা সিয়াম সাধনাকে আল্লাহ্ রাব্বুল আ’লামীন প্রত্যেক ঈমানদার নরনারীর উপর ফরজ বা বাধ্যতামূলক করেছেন। শুধু আল কোরআনই নয়, অন্যান্য প্রধান প্রধান আসমানি কিতাবও রমজান মাসেই নাযিল হয়েছিল এবং একারণে পূর্ববর্তী উম্মতদের উপরও রমজান মাসে সিয়াম সাধনা বাধ্যতামূলক ছিল। যেমন পবিত্র কোরআন মজিদে আল¬াহ রাব্বুল আ’লামীন স্বয়ং বলেন:
‘হে মু’মিনগণ! তোমাদের তোমাদের জন্য সিয়ামের বিধান দেওয়া হইল, যেমন বিধান তোমাদের পূর্ববর্তীগণকে দেওয়া হইয়াছিল, যাহাতে তোমারা মুত্তাকী হইতে পার।’ -[বাকারা : ১৮৩]
রমজান মাসের পুরো সময় রোজা রাখা ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভ বা মৌলিক ইবাদতের অন্যতম। মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন: পাঁচটি স্তম্ভের উপর ইসলামের বুনিয়াদ স্থাপিত। এগুলো হলো- ১.ঈমান- আল্লাহ্ ছাড়া আর কোন ইলাহ নেই এবং মুহাম্মদ (সা.) আল্লাহ’র রাসূল এই প্রত্যয় ব্যক্ত করা; ২. নামাজ কায়েম করা; ৩. যাকাত প্রদান করা; ৪. রমজান মাসের রোজা রাখা এবং ৫. বাইতুল্লা’য় হজ্জ করা।
পবিত্র রমজান মাস রহমতের মাস। এ মাসে জান্নাতের দরজা সমূহ খুলে দেয়া হয়। তাই এ মাসে সমগ্র মুসলিম বিশ্বে এক পবিত্র ভাবধারা বিরাজ করে। সমগ্র মুসলিম উম্মাহ এই পবিত্র মাসে ইবাদত-বন্দেগীতে মশগুল থেকে আল¬াহর নৈকট্য লাভের চেষ্টা করেন। পবিত্র এ মাস হল মাগফিরাতের মাস, নাজাতের মাস। এ মাসে জাহান্নামের দরজাগুলো বন্ধ রাখা হয় এবং প্রধা প্রধান শয়তানগুলোকে বন্দী রাখা হয়। তাই এ মাসে সাধারণভাবে ঈমানদারদের দিল নরম থাকে, তাদের হৃদয়, মন ও আত্মা আল্লাহ’র দিকে, মহান সৃষ্টিকর্তার দিকে রুজু থাকে।
পবিত্র এই মাস অশেষ পূণ্যের মাস। মহানবী (সা.) শাবান মাসের শেষ দিন সাহাবীদের উদ্দেশ্যে প্রদত্ত এক ভাষণে পবিত্র রমজান মাসের আগমন বার্তা ঘোষণা করে এই মাসকে এক মহিমান্বিত ও বরকতময় মাস হিসেবে উল্লেখ করে বলেছেন, এই মাসে এমন এক রাত রয়েছে, যা হাজার মাসের চেয়েও উত্তম। বলাবাহুল্য, এই রাতটির নাম ক্বদরের রাত। মহানবী জানিয়েছেন, এ মাসের শেষ দশ দিনের বেজোর রাত সমূহের মধ্যেই ক্বদরের রাত নিহিত থাকে। এই শেষ দশদিনে মুসলমানদেরকে এতেকাফে বসার জন্যও তাগিদ দিয়েছেন তিনি। গুনাহ মাফ এবং জাহান্নাম থেকে নাজাতের আশায় এ সময় মুসলমানরা মসজিদে মসজিদে এতেকাফ করে থাকেন। ক্বদরের রাত ছাড়াও এ মাসের প্রতিটি রাত, প্রতিটি দিন এবং প্রতিটি মুহূর্ত অত্যন্ত বরকতপূর্ণ। মহানবী (সা.) বলেছেন, এই পবিত্র মাসে যে একটি নফল ইবাদত করবে সে অন্য সময়ে একটি ফরজ ইবাদত করার সমান পূণ্য লাভ করবে। আর যে ব্যক্তি এই মাসে একটি ফরজ আদায় করবে, সে অন্য মাসের সত্তরটি ফরজ আদায়ের পূণ্য লাভ করবে। একারণেই বলছিলাম যে, পবিত্র এই মাস অন্য মাসের মত নয়। এই বরকতময় সময়ের একটি মুহূর্তও হেলায় হারানো উচিত নয়। বিশেষ করে ক্বদরের রাত তো নয়ই। মহানবী (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি ক্বদরের রাত থেকে বঞ্চিত হল তার মত হতভাগা আর নেই। তিনি আরো বলেছেন, রমজান মাসের প্রথম দশ দিন রহমতে পূর্ণ থাকে। দ্বিতীয় দশদিন ক্ষমা লাভ এবং শেষ দশ দিন জাহান্নাম থেকে মুক্তি লাভের উপায়। তবে এ সবকিছুই নির্ভর করে এই পবিত্র মাসের মাহাত্ম্য ও তাৎপর্যকে যথাযথভাবে উপলব্ধি করার উপর।
মনে রাখতে হবে, সিয়াম শুধু মাত্র সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত না খেয়ে থাকার নাম নয়, বরং এটি রীতিমত একটি সাধনার নাম। রোজার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে তাক্বওয়ার গুণাবলী অর্জন করা। এর অর্থ হচ্ছে আল্ল¬াহ্কে ভয় করে, ভালোবেসে চলা; তার আদেশ নিষেধ মেনে চলা। আত্মশুদ্ধি এবং স্রষ্টার নৈকট্য লাভ ছাড়া এই গুণাবলী অর্জন সম্ভব নয়। অনেককেই দেখা যায়, রোজা রাখা সত্বেও নামাজ পড়ে না, টেলিভিশন ও সিনেমা দেখে সময় কাটায়। এ থেকে বুঝা যায়, রোজার তাৎপর্য তাদের কাছে স্পষ্ট নয়। মনে রাখতে হবে রোজা আর উপবাস/অনশন এক নয়। রোজা রেখে যদি খোদাভীতি অর্জন করা না যায় তাহলে কোন লাভ নেই। কারণ খোদাভীতি অর্জন করাই রোজার মূল উদ্দেশ্য, যা আমরা উপরে উল্লেখিত আয়াত থেকেই জানতে পেরেছি। এ প্রসঙ্গে মহানবী (সা.) বলেছেন: ‘যে ব্যক্তি মিথ্যা কথা বলা এবং মিথ্যা কাজ থেকে বিরত থাকতে পারল না, তার রোজা রেখে পানাহার ত্যাগ করায় আল্লাহ্র কোন প্রয়োজন নেই।’ আল¬াহকে ভয় করে চলা মানে যেমন তাঁর নিষিদ্ধ কাজ থেকে বিরত থাকা তেমনি যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে তাঁর আদেশ পালন করা। নামাজ পড়া হল আল্ল¬াহ’র আদেশ। কোন অবস্থাতেই আল্লাহ’র এই আদেশ লঙ্ঘন করার সুযোগ নেই। রোজা রাখা অবস্থায় আল্লাহ’র এই আদেশ লংঘন করার কথা তো ঈমানদার ব্যক্তি চিন্তাই করতে পারেন না।
এ কারণে আত্মসংযমমফ হল রোজা রাখা বা সিয়াম সাধনার মূল কথা। সমস্ত লোভ, লালসা হারাম থেকে বেঁচে থাকা রমজানের বড় শিক্ষা। এজন্য যথেষ্ট সবর ও ধৈর্য্য প্রয়োজন। প্রয়োজন পরস্পরের প্রতি সহনশীল হওয়া, সহমর্মিতা প্রকাশ করা। আমরা আমাদের দেশে আরেকটি উদ্ভট জিনিস দেখি। সেটি হল রমজান এলেই জিনিস-পত্রের দাম যেন হু হু করে বেড়ে যায়। এটি পৃথিবীর আর কোন মুসলিম দেশে দেখা যায় না। এটি কোন মতেই আত্মসংযমের মধ্যে পড়ে না। এছাড়া ইদানিং আমাদের দেশে নাগরিকদের মধ্যে হিংসা, বিদ্বেষ ও সহিংসতা দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে। রমজানের সঠিক চেতনা তথা ভ্রাতৃত্ববোধ, সহনশীলতা, ধৈর্য্যই আমাদেরকে এই সংকট থেকে রেহাই দিতে পারে।
মাহে রমজান হল কোরআন নাযিলের মাস। এ মাসেই পবিত্র কোরআন মজিদ নাযিল হয়। আল্লাহ্ বলেন: ‘রমজান সেই মাস, যে মাসে কোরআন নাযিল করা হয়েছে; যা সমগ্র মানব জাতির জন্য হেদায়াত, সুস্পষ্ট পথ-নির্দেশ এবং সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারী। তোমাদের মধ্যে যেই এ মাসের সাক্ষাৎ পাবে, সে যেন রোজা রাখে।’ – আল বাকারা: ১৮৫। কাজেই এই মাসে আল্লাহ’র কালাম তেলাওয়াত করা, অধ্যয়ন ও উপলব্ধির মাধ্যমে সিরাতুল মুশতাক্বিমের সন্ধান করা আমাদের সকলের কর্তব্য।
পাঠকের মতামত: