মৃত্যুফাঁদে পরিণত হয়েছে চট্টগ্রাম–কক্সবাজার মহাসড়কের চকরিয়া অংশ। মহাসড়কের প্রায় ৩৬ কিলোমিটার অংশ অতিক্রম করার সময় আতঙ্কে থাকতে হয় যাত্রীদের। চকরিয়ার এই ৩৬ কিলোমিটার জুড়ে রয়েছে অসংখ্য ঝুঁকিপূর্ণ বাঁক। এসব বাঁক অতিক্রম করার সময় দুর্ঘটনায় পতিত হচ্ছে যানবাহনগুলো। এতে অকালেই একের পর এক ঝরে পড়ছে তাজা প্রাণ। মর্মান্তিক দুর্ঘটনার শিকার হয়ে পঙ্গুত্ব বরণ করতে হচ্ছে মানুষকে। মহাসড়কের চকরিয়া অংশের নিরাপত্তায় নিয়োজিত রয়েছে বানিয়ারছড়াস্থ চিরিঙ্গা হাইওয়ে ও ডুলাহাজারার মালুমঘাট হাইওয়ে পুলিশ ফাঁড়ি। এই দুই ফাঁড়ির হিসেব অনুযায়ী গত একমাসে অন্তত ১০টি (ছোট–বড়) দুর্ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। এসব দুর্ঘটনায় একই পরিবারের একাধিক সদস্য শিশু, নারীসহ ৮জন জন নিহত হয়েছেন। কয়েকটি দুর্ঘটনায় মারা না গেলেও আহত হয়েছেন অর্ধ শতাধিক ব্যক্তি। তাদের অনেকেই পঙ্গুত্ব বরণ করেছে।
সর্বশেষ গত একসপ্তাহে তিনটি ভয়াবহ দুর্ঘটনায় সংঘটিত হয়েছে এই সড়কের চকরিয়া অংশের হারবাংয়ের গয়ালমারা ও ইনানী রিসোর্টের সামনে। এছাড়া ডুলাহাজারা ইউনিয়নের পাগলির বিল এলাকায়ও ভয়াবহ দুর্ঘটনা সংঘটিত হয়। ৩ ফেব্রুয়ারি দিবাগত রাত বারোটার দিকে হারবাংয়ের গয়ালমারা বিপজ্জনক বাঁকে ঢাকা থেকে পর্যটকবাহী নোয়াহ গাড়ির মুখোমুখি সংঘর্ষ হয় বিপরীত দিক থেকে আসা শ্যামলী পরিবহনের যাত্রীবাহী এসি বাসের সঙ্গে। এ সময় নোয়াহ গাড়িটি চুর্ণ–বিচুর্ণ হয়ে যাওয়া মাত্রই গ্যাস সিলিন্ডার বিষ্ফোরিত হয়ে গাড়িতে আগুন ধরে গেলে তিনজন পুড়ে অঙ্গার হয়ে যায়। এ সময় আহত হয় দুই বাসের আরো অন্তত ১৫ জন। এর একদিন পর হারবাং ইনানী রিসোর্টের সামনে বিপজ্জনক বাঁক পেরুতেই পিকনিক বাসের সঙ্গে মাইক্রোবাসের মুখোমুখি সংঘর্ষে ঘটনাস্থলে পুলিশ কনস্টেবল নিহত হন। আহত হন মাইক্রোর আরো ৫ যাত্রী। এর আগে ১ ফেব্রুয়ারি সকালে মহাসড়কের ডুলাহাজারার পাগলির বিল এলাকায় বিপজ্জনক বাঁক পেরিয়ে সামনে তেল বোঝাই ট্রাকের মুখোমুখি সংঘর্ষ হলে মহাসড়ক থেকে ছিটকে গভীর খাদে ধানক্ষেতে উল্টে যায় পর্যটকবাহী মাইক্রোবাস (ভক্সি)। এ সময় এক কিশোর পর্যটক নিহত এবং আরো ৮ জন পর্যটক গুরুতর আহত হয়।
মহাসড়কের বানিয়ারছড়াস্থ চিরিঙ্গা হাইওয়ে পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ আবুল হাসেম মজুমদার বলেন, গত কয়দিনে যে কয়টি দুর্ঘটনা সংঘটিত হয়েছে সেগুলো ছিল একেবারে ভয়াবহ। বিশেষ করে এই ভয়াবহ দুর্ঘটনাগুলো সংঘটিত হয়েছে ঝুঁকিপূর্ণ বাঁকের (মোড়) কারণে। ঢাকা বা উত্তরবঙ্গ থেকে যেসব পিকনিক বাস বা হাইয়েজ, মাইক্রো, নোয়াহ গাড়ি আসে সেগুলোর চালকদের এই মহাসড়ক সম্পর্কে তেমন ধারণা না থাকায়। তাছাড়া কুয়াশাচ্ছন্ন এবং সড়ক পিচ্ছিল হয়ে পড়ায় বিপজ্জনক বাঁকগুলোতে চালকেরা নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারেন না যানবাহনের।
চকরিয়ার মালুমঘাট ও চিরিঙ্গা হাইওয়ে পুলিশ ফাঁড়ির সাবেক ইনচার্জ ও বর্তমান চকরিয়া থানা ট্রাফিক পুলিশ সার্জেন্ট মো. নিজাম উদ্দিন বলেন, সবার আগে পরিবহণ ব্যবস্থাপনা সংস্কার করতে হবে। অব্যবস্থাপনার কারণে এই পেশায় শিক্ষিত ও পেশাগত দক্ষ লোকের অভাব যথেষ্ট। তাই আমার মনে হয়, যানবাহন চালকগুলোকে যথাযথ প্রশিক্ষণ ও সচেতন না করলে দুর্ঘটনা ঘটতেই থাকবে।
নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা), হাইওয়ে পুলিশ ও সচেতন লোকজন প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনা সংঘটিত হওয়ার পেছনে কয়েকটি কারণ চিহ্নিত করেছেন। তন্মধ্যে অদক্ষ চালক, মহাসড়কের চকরিয়া অংশের অসংখ্য বিপজ্জনক মোড় (বাঁক), ঢাকাসহ উত্তরবঙ্গের চালকদের এই সড়ক সম্পর্কে ধারণা না থাকা, খামখেয়ালীপনার মধ্যে একেবারে বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালানো, ট্রাফিক সিগন্যাল না মানা এবং নিয়ম ভঙ্গ করে লবণ পরিবহনের সময় গলে পড়া লবণ পানি ও ঘন কুয়াশার মধ্যে সড়ক পিচ্ছিল হয়ে যাওয়াকে দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চট্টগ্রাম–কক্সবাজার মহাসড়কের চকরিয়ার প্রায় ৩৬ কিলোমিটার অংশে বিপজ্জনক বাঁক (মোড়) রয়েছে অন্তত ৩০টি পয়েন্টে। তন্মধ্যে বেশি বিপজ্জনক বাঁক রয়েছে অন্তত ১০টি। এসব বিপজ্জনক মোড়ে সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধে দৃশ্যমান নেই কোন সতর্কতামূলক সাইনবোর্ড বা নির্দেশনা। এতে যে কোন যানবাহন মোড় ঘুরতেই বিপরীত দিক থেকে দ্রুতগতিতে আসা অপর যানবাহনের সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষের ঘটনা ঘটছে। এছাড়াও দুর্ঘটনা প্রতিরোধে মহাসড়কের নিরাপত্তায় সর্বদা নিয়োজিত থাকার কথা হাইওয়ে পুলিশের। মহাসড়কের চকরিয়া অংশের এই দুই হাইওয়ে পুলিশ সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধে কার্যকর কি ভূমিকা রাখছে তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দিহান যাত্রীসাধারণ।
চকরিয়া থানার ওসি মো. জহিরুল ইসলাম খান বলেন, চট্টগ্রাম–কক্সবাজার মহাসড়কটি দেশের জন্য অতি গুরুত্বপূর্ণ। এই সড়ক দিয়ে প্রতিদিন যেতে হয় বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত কক্সবাজার ও বান্দরবান। এছাড়াও এই সড়ক হয়ে সীমান্ত উপজেলা টেকনাফের সেন্টমার্টিনেও যেতে হয় পর্যটকদের। কিন্তু সেই তুলনায় মহাসড়কটি বিজ্ঞানসম্মতভাবে তৈরি হয়নি।
তিনি আরো বলেন, মহাসড়কের নিরাপত্তা বিধানের জন্য আলাদা দুটি হাইওয়ে পুলিশ ফাঁড়ি রয়েছে। তারাও চেষ্টা করছে এসব দুর্ঘটনা ঠেকাতে। কিন্তু প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনা ঘটায় আমাদেরকেও ভাবিয়ে তুলেছে। এতে আমাদের দৈনন্দিন কাজেও বিরূপ প্রভাব পড়ছে। কেননা মহাসড়কে দুর্ঘটনা ঘটার খবর পেলেই হাতের কাজ ফেলে দৌঁড় দিতে হচ্ছে দুর্ঘটনাস্থলে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, বিগত আওয়ামীলীগ সরকারের আমলে (৯৬ সালের পর) চট্টগ্রাম–কক্সবাজার মহাসড়কটি নতুন করে নির্মাণ করার জন্য প্রকল্প অনুমোদন দেওয়া হয়। এই প্রকল্প অনুমোদন দেওয়ার সময় চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত এই মহাসড়কটি একেবারে সোজা করার কথা ছিল এবং সেই অনুযায়ী ম্যাপও চুড়ান্ত করা হয়। পরবর্তীতে বিএনপি আমলে এই সড়ক নির্মাণের কাজ বাস্তবায়নের জন্য ঠিকাদার নিয়োগ দেওয়া হয়। দোহাজারী থেকে চকরিয়া পর্যন্ত কাজ বাস্তবায়নের কার্যাদেশ পায় ইসলাম ট্রেডিং কনসোর্টিয়াম লি. (আইটিসিএল)। ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানটি এই কাজ বাস্তবায়ন করতে গিয়ে রহস্যজনক কারণে একেবারে সোজা সড়ক নির্মাণের পরিবর্তে ঝুঁকিপূর্ণ বাঁক রেখে সড়কটি নির্মাণকাজ সম্পাদন করে। এর পর থেকেই শুরু এই মহাসড়কের চকরিয়া অংশে মৃত্যুর মিছিল।
এ ব্যাপারে সড়ক ও জনপথ বিভাগের চকরিয়া কার্যালয়ের উপ–সহকারী প্রকৌশলী আবু আহসান মো. আজিজুল মোস্তফা বলেন, চট্টগ্রাম–কক্সবাজার মহাসড়কের চকরিয়া অংশের একেবারে যে কয়টি বিপজ্জনক বাঁক রয়েছে তা নতুন করে ডিজাইনের জন্য ‘রুট সেফটি’ টিম পরিদর্শন করে গেছেন। তাছাড়া এসব স্পটের দুই পাশেও প্রশস্ত করা হয়েছে যাতে দুর্ঘটনা না ঘটে। তাছাড়া যেসব দুর্ঘটনা সংঘটিত হয়েছে শুধুমাত্র অদক্ষ চালক, ঘুমচোখে গাড়ি চালানো এবং নিয়ম না মেনে লবণবাহী ট্রাক–পিকআপ চলাচল করায় সড়ক একেবারে পিচ্ছিল হওয়াতে। আর এসব দুর্ঘটনা সংঘটিত হয় গভীর রাতে ও ভোররাতে। তবে ভবিষ্যতে এই মহাসড়ক চারলেন করার জন্য ইতোমধ্যে কারিগরী সমীক্ষা (টিএ) চালানো হয়েছে। আশা করি চারলেন বাস্তবায়নের সময় একেবারে দূর হবে গুরুত্বপূর্ণ এই মহাসড়কের সমস্যা।
নিরাপদ সড়ক চাই (নিচসা) চকরিয়া উপজেলার সভাপতি সোহেল মাহমুদ বলেন, উত্তরবঙ্গসহ ভিন্ন জেলার যানবাহনের চালকদের এই মহাসড়ক সম্পর্কে ধারণা না থাকার পাশাপাশি চলাচলকারী হাইয়েজ–মাইক্রোবাসগুলোর ফিটনেস বলতে কিছুই নেই। এছাড়াও আরো যেসব সমস্যা চিহ্নিত করা হয়েছে সেগুলো নিরসনকল্পে যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া হলে অনেকাংশে কমে আসবে দুর্ঘটনা।
পাঠকের মতামত: