ঢাকা,মঙ্গলবার, ২৬ নভেম্বর ২০২৪

মিয়ানমারের ওপারে নির্যাতন এপারে মানবেতর জীবন

77ফরিদুল মোস্তফা খান, কক্সবাজার ::

ওপারে মিয়ানমারের সামরিক জান্তার বর্বর নির্যাতন এবং এপারে প্রতিকূল অবস্থায় রোহিঙ্গাদের মানবেতর জীবনযাপন চলছে। উখিয়া সীমান্ত দিয়ে প্রতিদিন আসছে মিয়ানমারের অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গারা। বিজিবি বলছেন, রোহিঙ্গাদের কোনো অবস্থাতেই ঢুকতে দেয়া হচ্ছে না। সীমান্ত এলাকায় বসবাসকারী লোকজন বলছেন, রাতের আঁধারে বিজিবির চোখ ফাঁকি দিয়ে এ দেশে প্রবেশ করছে তারা। কিছু দালালের হাত ধরে কুতুপালং শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নিচ্ছেন এসব অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গারা। গতকাল আরো ১০ পরিবার কুতুপালং শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নিয়েছেন। এই ১০ পরিবারের ভাগ্যে এখনো পর্যন্ত কোনো খাবার জুটেনি। শুক্রবার বিকেলে বিজিবি সদস্যরা ৩৪ জন মিয়ানমার নাগরিককে স্বদেশে ফেরত পাঠানো হয়েছে বলে ৩৪ বিজিবির অধিনায়ক লে. কর্নেল ইমরান উল্লাহ সরকার জানিয়েছেন।

মিয়ানমারের সশস্ত্র সেনাসদস্য ও সীমান্তরক্ষী বিজিপির নিষ্ঠুরতা মরণ চোবল থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য শত শত রোহিঙ্গা বাংলাদেশ সীমান্তের দিকে ধেয়ে আসছে গত ১১ নভেম্বর থেকে। তাদের অনেকেই স্বামী হারা, কেউ বা মা-ছেলে সন্তান হারা। তাদের মধ্যে গতকাল শুক্রবার সকালে কুতুপালং রোহিঙ্গা বস্তিতে আশ্রয় নেয়া মংন্ডু জামবুনিয়া রাঙ্গাবালি গ্রামের স্বামী হারা বিমূর্ষ জরিনা খাতুন (৫৫) জানান, রাতের আঁধারে সেনাসদস্যরা অতর্কিতভাবে তাদের গ্রামে এসে বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়। এ সময় প্রাণ বাঁচাতে কে কোথায় গেছে তার জানেন নেই। তবে নূর ফাতেমা (৭), সাহেনা (৬) ও হাসিনাসহ (৫) তিনজন নাতি নিয়ে পাশের পাহাড়ের জঙ্গলে আশ্রয় নেন তারা। পরে ঝিম্মংখালী সীমান্ত পথধরে কোনো রকম এপারে চলে আসেন। তিনি আরো জানান, মোহাম্মদ শাহ আলম (১৭), নুর সালাম (১৫), হামিদ হোছন (১২), আমান উল্লাহসহ (১০) চার ছেলে কোথায় গেছে খোঁজখবর পাননি।

গতকাল সকালে উখিয়ার কুতুপালং রোহিঙ্গা বস্তি ঘুরে জানা যায়, ১০ পরিবারের প্রায় অর্ধশতাধিক নারী-পুরুষ-শিশু বস্তিতে আশ্রয় নিয়েছেন। মংন্ডু পোয়াখালী নয়াপাড়া থেকে আসা মোহাম্মদ ইউনুছ (২৫) জানান, তারা রাতে ভাত খাওয়ার সময় সেনাবাহিনীর সদস্যরা গ্রামে ঢুকে গুলিবর্ষণ শুরু করে বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়। এ সময় বাড়ির বাইরে এসে দেখা যায়, মানুষ ছোটাছুটি করে পালাচ্ছেন। সে ও তার স্ত্রী তসলিমা (২২), দুই সন্তান মোহাম্মদ ইদ্রিস (৪) ও হাবিবাকে (৩) নিয়ে পাশের ধান ক্ষেতে লুকিয়ে পড়েন। পর দিন রাতের আঁধারে টেকনাফ উপজেলার নয়াপাড়া ঘাট দিয়ে এ দেশে চলে আসেন। তিনি জানান, নাফ নদী পার হওয়ার সময় নৌকাওয়ালা জনপ্রতি ৩০ হাজার (কিয়াত) ভাড়া আদায় করেছে।

মিয়ানমারের মংন্ডু খেয়ারীপাড়া গ্রামের বয়োবৃদ্ধ আলি আহমদ (৬০) জানান, তাদের পাড়াটি জ্বালিয়ে দেয়ার কারণে তারা পাশের একটি গ্রামে আশ্রয় নিয়েছিলেন। সেখানেও সেনাবাহিনীর বর্বরোচিত হামলা চালিয়ে গ্রামটি জ্বালিয়ে দিলে তিনি পালিয়ে আসতে সক্ষম হন। কিন্তু তার পরিবারের সাত সদস্যের কোনো খোঁজখবর পাননি। একই এলাকার আবদুল হামিদ (২৬) জানান, সেনাবাহিনী ও সীমান্তরক্ষী বিজিপির সদস্যরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে পুরুষদের ধরে নিয়ে যাচ্ছে আর যুবতী নারীদের ধর্ষণ করছে। তিনি প্রাণ বাঁচাতে কোনো রকমে হেঁটে হোয়াইক্যং সীমান্ত দিয়ে এপারে চলে এসেছে। তবে তার পরিবারের ছোট ছোট ছেলেমেয়েসহ তার স্ত্রী ছেনুয়ারা কোথায় কিভাবে দিন কাটাচ্ছে তার জানা নেই।

উখিয়া থানার অফিসার ইনচার্জ মো: আবুল খায়ের জানান, অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গারা যাতে ক্যাম্পে ঢুকতে না পারে সেজন্য ক্যাম্পের বাইরে সার্বক্ষণিক পুলিশের সতর্ক নজরদারি রাখা হয়েছে। রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের ব্যাপারে কক্সবাজার ৩৪ বিজিবির অধিনায়ক লে. কর্নেল ইমরান উল্লাহ সরকার জানান, সীমান্ত এলাকায় অনুপ্রবেশ রোধে চেষ্টা করা হচ্ছে এবং বিজিবির চোখ ফাঁকি দিয়ে যেসব রোহিঙ্গা রাতের আঁধারে অনুপ্রবেশ করেছে তাদের আটক করে পুশব্যাক করা হচ্ছে।

পাঠকের মতামত: