ঢাকা,বুধবার, ২০ নভেম্বর ২০২৪

মামলার অনিষ্পত্তিতেই অপরাধ বাড়ছে কক্সবাজার পুলিশে

মুহিববুল্লাহ মুহিব, কক্সবাজার :: বাংলাদেশে পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে থানায় মামলা নেওয়ার নজির বিরল। আর আদালতে পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে মামলা হলেও তার তদন্ত করে পুলিশই। ফলে অপরাধের কারণে পুলিশের প্রচলিত আইনে শাস্তি পাওয়ার নজির খুব কমই দেখা মেলে। এর প্রচলন আরও বেশি দক্ষিণের সীমান্তবর্তী জেলা কক্সবাজারে।

বিষাক্ত মাদক ইয়াবা বড়ির কারণে এ জেলা বেশ আলোচিত। তবে মাঝেমধ্যে এই মাদক ঠেকানোর জন্য যারা বদলি হয়ে এ জেলায় আসেন, তারাও জড়িয়ে পড়েন এমন কর্মকাণ্ডে। এমন অভিযোগে গত কয়েক বছরে বেশ কিছু মামলা হয়েছে পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে।

গত ছয় বছরে কক্সবাজার জেলা পুলিশের ৯ সদস্যের বিরুদ্ধে করা ইয়াবা-সংক্রান্ত অপরাধের তিনটি মামলার একটিরও এখন পর্যন্ত নিষ্পত্তি হয়নি। এমনকি সীমান্তবর্তী উপজেলা টেকনাফে ‘ক্রসফায়ার’ দেওয়ার ভয় দেখিয়ে ডিবি পুলিশের সাত সদস্যের আদায় করা ১৭ লাখ টাকার চাঞ্চল্যকর মামলাটির সাক্ষ্য গ্রহণ পর্যন্ত শুরু হয়নি গত চার বছরেও।

গেল বছরের ৩১ জুলাই মেরিন ড্রাইভ সড়কে পুলিশের গুলিতে সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা হত্যার ঘটনার আগেই পুলিশের বিরুদ্ধে এ তিনটি মামলা হয়েছিল। ইয়াবা নিয়ে হাতেনাতে ধরা পড়াসহ ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে করা মামলাগুলোর সব আসামিই ইতোমধ্যে জামিনে বেরিয়ে গেছেন। কক্সবাজার পুলিশের একের পর এক অপরাধজনক ঘটনার বিলম্বিত বিচার কার্যক্রমের মধ্যেই গত সোমবার (১ মার্চ) এক নারীকে পিস্তল ঠেকিয়ে তিন লাখ টাকা ছিনতাইয়ের ঘটনাটিও চাঞ্চল্যের মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছে।

একাধিক সূত্র বলছে, মেজর সিনহা হত্যার আগে দেশব্যাপী পুলিশের চাঞ্চল্যকর যে ঘটনাটি ছিল, সেটি হচ্ছে একের পর এক ‘গ্রেফতার-বাণিজ্য ও ক্রসফায়ারে’র ভয় দেখিয়ে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়ার ধারাবাহিকতায় শেষ পর্যন্ত সেনাসদস্যদের হাতে ধরা পড়া কক্সবাজার জেলা গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের সাত সদস্যের বিষয়টি। টেকনাফ সীমান্তের একজন কম্বল ব্যবসায়ীকে আটকের পর ক্রসফায়ার দেওয়ার ভয় দেখিয়ে ডিবি পুলিশ ওই অঙ্কের টাকা আদায় করে কক্সবাজার শহরে ফিরছিলেন। এ সময় সেনাসদস্যরা তাদের কাছ থেকে ১৭ লাখ টাকার বস্তা উদ্ধার করেছিলেন।

২০১৭ সালের ২৪ অক্টোবর ভোররাতে কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ সড়কের লেঙ্গুরবিল এলাকায় স্থাপিত সেনাবাহিনীর অস্থায়ী ক্যাম্পে ডিবি পুলিশের ওই সদস্যদের আটক করা হয়েছিল। সেদিন সেনাসদস্যরা যখন ডিবি পুলিশের মাইক্রোবাসটি চ্যালেঞ্জ করেন, তখন দীর্ঘক্ষণ ধরে মাইক্রোবাসের আরোহী ডিবি সদস্যরা চুপচাপ বসে ছিলেন। তারা গাড়ির কাচ খুলতেও অপারগতা প্রকাশ করেছিলেন। অতঃপর সেনাসদস্যরা গাড়ির কাচ ভেঙে টাকাভর্তি বস্তা উদ্ধার করতে বাধ্য হন।

টেকনাফ সীমান্তে তখন রোহিঙ্গা ইস্যুতে কর্তব্যরত সেনাবাহিনীর দায়িত্বপ্রাপ্ত মেজর নাজিম আহমদের নেতৃত্বে সেনাসদস্যরা সাত সদস্যকে আটক করেছিলেন। পরের দিন তদানীন্তন পুলিশ সুপার ইকবাল হোসেন সাত সদস্যের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ার অঙ্গীকার করে সেনাবাহিনীর কাছ থেকে তাদের ছাড়িয়ে এনেছিলেন।

পরে সাময়িক বরখাস্ত হওয়া সাত সদস্য হলেন উপপরিদর্শক মনিরুজ্জামান ও আবুল কালাম আজাদ, সহকারী উপপরিদর্শক মোহাম্মদ ফিরোজ, গোলাম মোস্তফা ও আলাউদ্দিন এবং দুই কনস্টেবল আল আমিন ও মোস্তফা আজম।

জানা যায়, টেকনাফের দক্ষিণ জালিয়াপাড়ার বাসিন্দা এবং টেকনাফ পৌরসভার ৮ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মনিরুজ্জামান মনিরের ছোট ভাই আবদুল গফুর একজন কম্বল ব্যবসায়ী। তিনি ২০১৭ সালের ২৪ অক্টোবর কক্সবাজার শহরে আয়কর দিতে এসেছিলেন। তাকে ধরে ডিবি পুলিশের অফিসে নিয়ে যাওয়া হয়। পুলিশ তার চোখ বেঁধে টাকা আদায়ের জন্য বেধড়ক পেটায়। একপর্যায়ে ডিবি পুলিশের দল তাকে ধরে হুন্ডি ও ইয়াবা কারবারি হিসেবে অভিযুক্ত করে দাবি করে এক কোটি টাকা।

এ বিষয়ে টেকনাফ থানায় পরের দিন ২৫ অক্টোবর করা মামলায় আবদুল গফুর আরও উল্লেখ করেন যে ডিবি পুলিশের দল টাকার জন্য তার ভাই কাউন্সিলর মনিরের সঙ্গে যোগাযোগ করে একপর্যায়ে ৫০ লাখে রাজি হয়। ভাইকে রক্ষা করার জন্য মনিরুজ্জামান ডিবিকে তিন লাখ টাকা দিতে রাজি হন। কিন্তু নাছোড়াবান্দা ডিবি সদস্যরা তাতে রাজি হননি। তাদের চাহিদা মাফিক টাকা না দেওয়ায় রাতে চোখ বেঁধে তার ভাইকে ক্রসফায়ারে দেওয়ার কথা বলে টেকনাফ সীমান্তের দিকে রওনা হন ডিবি সদস্যরা। মৃত্যুর ভয়ে একপর্যায়ে গফুর রাজি হন টাকা দিতে। তারপর মনির ১৭ লাখ টাকাভর্তি একটি বস্তা টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ সড়কের লেঙ্গুরবিল এলাকায় ডিবি সদস্যদের মাইক্রোবাসে তুলে দেন। সদস্যরা তখন তার ভাই গফুরকে ছেড়ে দেন। এরপর মনিরুজ্জামান মেরিন ড্রাইভ সড়কের লেঙ্গুরবিলে অস্থায়ী সেনা ক্যাম্পে গিয়ে এ খবর জানান। সেনাসদস্যরা তখনই গাড়িটিকে চ্যালেঞ্জ করে আটক করেন।

সেই ঘটনার পর থেকেই মামলাটি বিচারাধীন রয়েছে। কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতে মামলাটির নথিতে দেখা গেছে, গত ১৭ জানুয়ারি মামলাটির ধার্য দিন ছিল সাক্ষীর জন্য। এদিন জামিনপ্রাপ্ত সাত পুলিশ সদস্য যথারীতি আদালতে হাজির ছিলেন।

মাদকের কারণে এ জেলায় নগদ অর্থ লেনদেন বেশি হয়। ফলে অনেক পুলিশ সদস্য তার লোভ সামলাতে পারেন না। যার কারণে তারাও মাদক কারবারিদের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন।
মাহাবুবুর রহমান, সাধারণ সম্পাদক, সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন), কক্সবাজার

কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতে পাবলিক প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট ফরিদুল আলম ঢাকা পোস্টকে বলেন, মামলার সাক্ষী অনুপস্থিত থাকায় আমি রাষ্ট্রপক্ষে সময় নিয়েছি। ভবিষ্যতে সাক্ষীদের সাক্ষ্য দিতে হাজির করার ব্যবস্থা করা হচ্ছে।

অন্যদিকে ২০১৮ সালের ১৬ অক্টোবর র‌্যাব-৭-এর একটি দল রামু থানার পুলিশের টহল দলের গাড়িতে অভিযান চালিয়ে ১৮ হাজার পিস ইয়াবা ও পুলিশের পোশাক, হ্যান্ডকাপ, জ্যাকেটসহ তিনজনকে আটক করেছিলেন। তাদের সঙ্গে আটক হওয়া ব্যক্তিদের একজন রামু থানার কনস্টেবল ইকবাল হোসেন। এ ঘটনার মামলাটিও বিচারাধীন রয়েছে।

এর আগে ২০১৫ সালে কক্সবাজারের চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের দায়িত্বরত (গানম্যান) কনস্টেবল সাদ্দাম হোসেনকে পুলিশ বিপুল পরিমাণের ইয়াবার চালানসহ আটক করেছিল। সেই ঘটনার মামলাও এখনো নিষ্পত্তি হয়নি।

সবশেষ গেল সোমবার (১ মার্চ) বিকেলে শহরের মধ্যম কুতুবদিয়াপাড়ার বাসিন্দা ব্যবসায়ী রিয়াজ আহমদের স্ত্রী রোজিনা খাতুন ছিনতাইয়ের শিকার হন। ওই দিন রাতে পুলিশের তিন সদস্যের বিরুদ্ধে মামলা করেন তিনি। মঙ্গলবার (২ মার্চ) বিকেলে আদালতে হাজির করলে তাদের দুদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন বিচারক। এরই মধ্যে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করে পুলিশ হেডকোয়ার্টার্স। পাশাপাশি ওই তিন পুলিশ সদস্যকে বরখাস্ত করা হয়।

পুলিশ সদস্যদের অপরাধ ঠেকাতে হলে নৈতিক দায়িত্ববোধে গুরুত্ব দেওয়ার তাগিদ কক্সবাজারের বিশিষ্টজনদের। কক্সবাজার নাগরিক আন্দোলনের সাংগঠনিক সম্পাদক এইচ এম নজরুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, সিনহা হত্যার পর জেলার সব পুলিশকে বদলি করা হয় স্বচ্ছতা আনার জন্য। নতুন সদস্যরা আবারও সেই অপরাধে জড়ালেন। পরিবর্তন নয়, পুলিশ সদস্যদের নিজেদের নৈতিকতা ঠিক রাখার দিকে খেয়াল রাখার তাগিদ দেন তিনি।

সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) কক্সবাজার জেলার সাধারণ সম্পাদক মাহাবুবুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, মাদকের কারণে এ জেলায় নগদ অর্থ লেনদেন বেশি হয়। ফলে অনেক পুলিশ সদস্য তার লোভ সামলাতে পারেন না। যে কারণে তারাও মাদক কারবারিদের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন।

তিনি বলেন, একটি ঘটনা ঘটল, তার নামমাত্র শাস্তি হিসেবে বদলি করা হয়। আর মামলা হলেও তা দ্রুত নিষ্পত্তি না হওয়ায় জামিনে বেরিয়ে যান আসামিরা। এমন প্রচলন থাকায় অন্যরা অপরাধে জড়িয়ে পড়েন।

চট্টগ্রাম রেঞ্জের উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) আনোয়ার হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, নারীকে পিস্তল ঠেকিয়ে টাকা ছিনতাইয়ের ঘটনা গুরুত্বসহকারে তদন্ত করা হচ্ছে। এ ঘটনায় যে-ই জড়িত থাকুন না কেন, সবাইকে শাস্তির আওতায় আনা হবে। সুত্র: ঢাকা পোস্ট

পাঠকের মতামত: