ঢাকা,শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪

মাতার বাড়ী কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্পে চলছে অবকাঠামো নির্মাণের কাজ: বন্ধ হয়ে গেল লবণ ও চিংড়ি চাষীদের পদচারণা

7854ছালাম কাকলী, মহেশখালী :

সাগর ও নদী ঘেরা মাতারবাড়ী ইউনিয়নের কয়লাভিত্তিক তাপ বিদ্যুৎ প্রকল্পে বিভিন্ন অব কাঠামো নির্মাণের কাজ চলছে। বন্ধ হয়ে গেছে গত ২বছর ধরে লবণ ও চিংড়ি উৎপাদনের কাজ। বন্ধ হয়ে গেছে কয়েক হাজার শ্রমিকের কর্মসংস্থান। ফলে শ্রমিকরা আয়ের (রিযিকের) সন্ধানে দলে দলে এলাকা ছেড়ে চট্টগ্রামে জাহাজ কাটার কাজ করার জন্য চলে যাচ্ছে। যারা জমি ও পেশা হারিয়েছেন তাদের জন্য ১শত কোটি টাকার প্রকল্পও হাতে নিয়েছে কর্তৃপক্ষ । অথচ এ প্রকল্পের আলোর মূখ এখনো দেখা যাচ্ছে না। অন্যদিকে এ প্রকল্পের দলনেতা তাজুল ইসলাম বারবার বলে আসছেন এ প্রকল্পের জন্য যারা ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে ঐসব পরিবারের সদস্যদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে কাজ দেয়া হবে এবং এককালীন কিছু সাহায্যও দেয়া হবে। সেখানকার অর্থ্যাৎ ১ম প্রকল্পের আওতাধীন জায়গা থেকে ৪৪ পরিবারকে গত ৫মাস পূবে উচ্ছেদ করে তাদেরকে দেয়া হয়েছে ৬পিচ টিন আর ২হাজার ৫শত টাকা করে দেয়া হয়েছে প্রতিটি পরিবারকে । এসব পরিবারের সদস্যরা এখনো খোলা আকাশের নিচে বসবাস করছে। এছাড়া ৭হাজার বর্গফুট আয়তনে যে ভবণ নির্মাণ করা হচ্ছে ঐ ভবণ নির্মাণ করার জন্য পাথর ও বালি যে আনা হচ্ছে তা পরিবহণের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে বদরখালী ভিত্তিক তৈয়বের মালিকানাধীন উপকূলীয় এন্টারপ্রাইজকে । এসব মালামাল পরিবহণের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে বদরখালী শ্রমিকদের । অন্যদিকে উত্তর পাশে অধিক গ্রহণ করা জায়গার সমপরিমাণ অর্থ্যাৎ প্রতি একরে ৩৪ লাখ টাকা করে যে দেয়ার জন্য উক্ত ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের সহ-সভাপতি মাষ্টার মোহাম্মদ উল্লাহ বার বার সংশ্লিষ্টদের কাছে আবেদন নিবেদন করলেও কর্তৃপক্ষ এখনো কোন সিদ্ধান্ত নিচ্ছে না। ফলে জমির মালিকদের পক্ষে এ দাবী কর্তৃপক্ষের কাছে তুলে ধরলেন গত ১৮ নভেম্বর জুমার নামাজ আদায়ের পূর্বে রাজঘাট মসজিদেও। চেয়ারম্যানের আবেদনের প্রেক্ষিতে কোল পাওয়ার কর্তৃপক্ষ মসজিদের উন্নয়নমূলক কাজের জন্য ৫লাখ টাকা অনুদান দিয়েছেন।

সরেজমিনে পরিদর্শনকালের দেখা যায় জাপান আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক সংস্থা (জাইকা) কয়লাভিত্তিক তাপ বিদ্যুৎ প্রকল্প করার জন্য ১৪শত ১৪ একর চিংড়ী ও লবণ চাষের জমি অধি: গ্রহণ করেছেন। উক্ত জমির মালিকদেরকে দেয়া হয়েছে শ্রেণি ভেদে ৪,৭,১১ লাখ টাকা করে প্রতি একরে। অথচ একই ইউনিয়নের উত্তর অংশে গিয়ে আরো একটি প্রকল্প করার জন্য সিঙ্গাপুর আর বাংলাদেশের যৌথ উদ্যোগে জমি অধি: গ্রহণ করেছে ১২শত একর জমি। এ জমির মূল্য দেয়া হয়েছে প্রতি একরে ৩৪ লাখ টাকা করে। ফলে ১ম প্রকল্পের জমির মূল্য নির্ধারণে বৈষম্য নীতি আচরণ করেছে বলে দাবী করেছেন মাতারবাড়ী ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের সহ-সভাপতি ও চেয়ারম্যান মাষ্টার মোহাম্মদ উল্লাহ এতদঃ অঞ্চলের সুশীল সমাজ।

অধি: গ্রহণকৃত জমি ও ঘেরের মালিকদের বিরুদ্ধে ৩টি মামলা মাথায়

প্রকল্প থেকে ক্ষতিগ্রস্থরা ২৩ কোটি টাকা উত্তোলনের কারণে ২টি মামলা যে, দায়ের হয়েছে তা এখনো শেষ হয়নি । কর্তৃপক্ষ সম্পূর্ণ যাচাই-বাছাই করে বিভিন্ন তথ্য উপাত্ত যাচাই করার পর মাতারবাড়ীর মাটি ও মানুষ এখানকার শান্তির প্রতীক ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের সভাপতি হাজী সমি উদ্দীন , চট্টগ্রাম আইন কলেজের সাবেক ভি.পি ও আওয়ামীলীগ নেতা জমির উদ্দীন , চিংড়ি ব্যবসায়ি রফিক আহমদ , চিংড়ী ও লবণ ব্যবসায়ী জাহাঙ্গীর আলম, মুহিব্বুল ইসলাম, আমিনুল ইসলাম , মো: ফারুক , এরফান , মো: সেলিম , নুর মোহাম্মদ সহ ২০জন এবং তৎকালীন জেলা প্রশাসক সহ সরকারি ৮জন কর্মকর্তা অর্থ্যাৎ ২৮ জনের বিরুদ্ধে মাতারবাড়ীর কায়সারুল ইসলাম বাদী হয়ে ২০১৪ সালে ১৯ নভেম্বর দুদক অধিদপ্তরে ১টি মামলা দায়ের করে। পরে তৎকালীন জেলা প্রশাসক উক্ত মামলা থেকে বাদ দেয়া হয়েছে । অন্যদিকে এ টাকা আদায়ে উল্লেখিত মাতারবাড়ী বাসিন্দাদের বিরুদ্ধে অর্থ্যাৎ ১৯ জনের বিরুদ্ধে জেলা প্রশাসন কর্তৃক আরো একটি সার্টিফিকেট মামলা দায়ের করা হয়েছে। এসব লোকজনদের আদালতে হাজিরা দিতে প্রান যায় যায় অবস্থা হয়েছে । এমনিতেও এসব লোকজন লবণ ও চিংড়ী চাষ করে যে লাখ লাখ টাকা আয় করত তা এখন বন্ধ হয়ে গেছে। বর্তমানে এ প্রকল্পের অধীনে ২টি মামলা এবং ২য় প্রকল্পের অধীনে একটি জি.আর মামলা ঝুলে রয়েছে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এ ৩টি মামলা প্রত্যাহার না করলেও কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্পে কাজ করতে কোথাও বাঁধা নেই। অথচ এসব মামলায় হাজিরা দিতে তাদের প্রাণ যায় যায় অবস্থা হয়েছে । ফলে এ ৩টি মামলা প্রত্যাহারেরর দাবী জানিয়েছেন মাতারবাড়ীবাসী।

১ম প্রকল্পের বর্তমান অবস্থান

জাইকা কর্তৃক অধি: গ্রহণকৃত ১৪শত ১৪ একর জমি হচ্ছে পূর্বে কোহলিয়া নদী, পশ্চিমে বঙ্গোপসাগর , উত্তরে মাতারবাড়ী ইউনিয়নের সাইরার ডেইল গ্রামস, দক্ষিণে ধলঘাটা মুহুরীঘোনা। এরই মাঝে অধি: গ্রহণ করা জমি ভরাট করার জন্য পূর্বে পাশে কোহলিয়া নদীতে বসানো হয়েছে বালি তোলার ড্রেজার মেশিন। কোহলিয়া নদী থেকে গত ৩মাস ধরে তোলা হচ্ছে পাইপ লাইন দিয়ে বালি। ধলঘাটার পশ্চিমে সাগরে বসানো হয়েছে আরো একটি ড্রেজার মেশিন, বসানো হয়েছে দীর্ঘ পাইপ লাইন। ড্রেজার মেশিনের দ্বারা তোলা বালি দিয়ে ৩০ফুট উঁচু করে ভারট করা হবে বলে জানিয়েছেন প্রকল্প বাস্তবায়নকারী ঠিকাদারী সংস্থা কোল পাওয়ার জেনারেশন কম্পানীর উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী মাহমুদ আলম। এ প্রকল্পের উত্তর পামে সাইরার ডেইল এর পশ্চিমে কয়লাভর্তি জাহাজ ভিড়ের জন্য জেটিও নির্মাণ করা হবে জানিয়েছেন তিনি। এ প্রকল্প ঘুরে আরো দেখা যায় এস্কেভেটার গাড়ী , মাটি পরিবহণের গাড়ী সহ বিভিন্ন যানবাহন দ্বারা চালিয়ে যাচ্ছে প্রকল্পের কাজ। মাতারবাড়ী ইউনিয়ন শ্রমিকলীগের সভাপতি হাজী মালিক জানান, এ প্রকল্পে বেশী ভাগই শ্রমিক নিয়োগ দেয়া হয়েছে এলাকার বাইরের লোকদের । অপরদিকে এ প্রকল্পের পশ্চিমে সাইরার ডেইল ঘেষে উত্তর দক্ষিণে রাস্তার দু’পাশে থাকা ৪৪টি বসতবাড়ীকে ৪মাস পূর্বে উচ্ছেদ করে দিয়েছে কর্তৃপক্ষ। তাদের প্রতিটি পরিবারকে দেয়া হয়েছে ৬পিচ টিন আর ২ হাজার ৫শত টাকা। এসব পরিবারের লোকজন এখনো খোলা আকাশে বসবাস করছে।

৭হাজার বর্গফুট আয়তনের ৭তলা ভবণ নির্মাণের কাজ চলছে

সিনাম ইঞ্জিনিয়ারিং এর প্রকোশলী মাসুদ রানা জানাস, প্রকল্পের দক্ষিণ পাশে কোহলিয়া নদীর পাড়ে ৭ হাজার বর্গফুট আয়তনের ৭তলা ভবণ নির্মাণের জন্য কার্যক্রম শুরু করা হয়েছে। তিনি আরো জানান, আপাতত ৩তলা পর্যন্ত হবে। তবে এ ভবণ নির্মাণের কাজ শেষ হলে প্রকল্প বাস্তবায়নকারী ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান কোল পাওয়ার জেনারেশন কম্পানী এবং জাপানী কনষ্ট্রাকশন ফার্ম ফ্যান্টা ওশান লিঃ একযোগে সেখানে কাজ শুরু করবে। অন্যদিকে মাতারবাড়ী ইউনিয়ন স্বেচ্ছাসেবকলীগের সভাপতি তরুণ ব্যবসায়ী শওকত ইকবাল মোরাদ ও শ্রমিকলীগের সভাপতি হাজী মানিক জানান, উক্ত ভবণ নির্মাণের জন্য যে পাথর ও বালি আনা হচ্ছে তা বদরখালী ভিত্তিক ১টি সিন্ডিকেটের মাধ্যমে। এছাড়া এ ভবণ নির্মাণ কাজে ব্যবহৃত পাথর ও বালি আনার দায়িত্বও দেয়া উক্ত সিন্ডিকেটকে। যার ফলে মাতারবাড়ী বাসীর সাথে বৈষম্যনীতি আচরণ করেছে কর্তৃপক্ষ।

বিসিক মাতারবাড়ী অফিস :

বিসিক মাতারবাড়ী শাখার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জাফর ইকবাল জানান, মাতারবাড়ী মৌজায় লবণ উৎপাদনের জমির পরিমান হচ্ছে ২৩শত একর আর ধলঘাটা মৌজায় হচ্ছে ২২শত একর তৎমধ্যে সরকার তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য দু’দফায় ২৬শত ১৪ একর জমির অধি: গ্রহণ করেছে। এসব জমিতে ৭শত চাষির সংখ্যা ছিল বিসিক এর জরীপ অনুযায়ী ৩ হাজার ৪শত জন। আর জমি অধি; গ্রহণের কারণে বেকার হয়েছে প্রায় ২ হাজার লবণচাষী । বর্তমানে তারা মানবেতর জীবন-যাপন করছে।

মাতারবাড়ী ইউ.পি চেয়ারম্যানের বক্তব্য :

সর্বোপরি মাতারবাড়ীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে আসার সময় কথা হয় ইউ.পি চেয়ারম্যান মাষ্টার মোহাম্মদ উল্লাহ-র সাথে । এসময় তিনি বলেন, আমার দাবী হচ্ছে ১ম কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য অধি: গ্রহণকৃত ১৪শ ১৪ একর ভূমির ক্ষতিপূরণ বাবদ দেয়া হয়েছে প্রতি একরে ৪,৭ ও ১১ লাক টাকা মাত্র। অথচ ২য় কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য অধি: গ্রহণকৃত ভূমির ক্ষতিপূরণ বাবদ প্রতি একরে দেয়া হয়েছে ৩৪ লাখ টাকা । এ বৈষম্যমূলক আচরণ বন্ধ করে সমপরিমাণ টাকা দেয়ার দাবী জানিয়েছেন তিনি। মাতারবাড়ীর অভ্যন্তরীণ রাস্তা-ঘাট সংষ্কার ও চতুর্দিক বেড়িবাঁধ দ্রুত নির্মাণ , পূর্ণবাসন ও প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের মাধ্যমে প্রকল্পের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা , লবণ ও চিংড়ি চাষের অধিকাংশ ভূমি অধি গ্রহণের আওতায় চলে গেছে। ফলে লবণ ও শস্য ঋণ দ্রুত মওকূপ করা হউক , সর্বোচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান মাতারবাড়ী উচ্চ বিদ্যালয় ও দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান মজিদিয়া সিনিয়র মাদ্রাকে সরকারীকরণ এবং পাবলিক উচ্চ বিদ্যালয়কে দ্রুত এম.পিও ভূক্তকরণ, ১শত শয্যা বিশ্ষ্টি ১টি হাসপাতাল এবং ১টি কলেজ প্রতিষ্ঠা করা, দু’প্রকল্পে সার্বিক নিরাপত্তার জন্য ১টি থানার ব্যবস্থা করা, এ ইউনিয়নকে শিল্পাঞ্চল ঘোষণা করা , দু’প্রকল্পের মধ্যে চাকরির সুবিধা নিশ্চিতকল্পে প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন করা ও মাতারবাড়ীর সর্বত্রই বিদ্যুতায়ন সহ নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ সহ ১০ দফা দাবী সম্বলিত একটি স্মারক লিপি আমি কর্তৃপক্ষের কাছে পেশ করেছি।

পাঠকের মতামত: