ঢাকা,রোববার, ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪

মাতামুুহুরীতে অপরিকল্পিত বাঁধ : চকরিয়ার ১৩ ইউনিয়নে বন্যার আশংকা

জহিরুল ইসলাম : Pic Chakaria20.06.2016(1)
মাতামুহুরী নদীর চকরিয়া অংশের সওদাগর ঘোনায় প্রায় ৬০ লাখ টাকা ব্যয়ে অপরিকল্পিত বাঁধ নির্মাণ ও লোপকাটিং করে লাখ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে। বাঁধের কারণে এ বর্ষা মৌসুমে পৌরসভাসহ ১৩টি ইউনিয়নে ব্যাপক বন্যার আশংকা দেখা দিয়েছে। লোপকাটিংয়ের কারণে এ নদীর পালাকাটা রাবার ড্যামটি হুমকির মুখে পড়েছে। এ নদীর শাখা প্রশাখার কয়েকটি খালেও প্রভাবশালীরা বাঁধ দিয়ে বন্ধ করে দেয়ায় চিংড়ি চাষ ব্যাহতসহ খালে খালে যাতায়তের  ক্ষেত্রে চরম ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। এলাকাবাসি ওই বাঁধ কেটে দিয়ে বন্যার কবল থেকে রক্ষার জন্য প্রশাসনের প্রতি দাবী জানিয়েছেন।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, চকরিয়া উপজেলার চিরিঙ্গা ইউনিয়নের সওদাগর ঘোনা এলাকায় মাতামুহুরী নদীর মূল অংশে এ বছর ‘কাজের বিনিময়ে টাকা’ কর্মসূচীর আওতায় প্রায় ৬০লাখ টাকা ব্যয়ে উপজেলা প্রকল্প কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে বাঁধ নির্মাণ ও নদীর একটি অংশে লোপকাটিং করা হয়েছে। নদীর মূল অংশে বাঁধ নির্মাণের কারণে এ নদীর আবহমান কাল থেকে প্রবাহিত পানির বহমান ¯্রােত ধারা বন্ধ হয়ে গেছে। ওই বাঁধের একটি অংশে লোপকাটিং করে (খাল কেটে নদীর গতিপথ পরিবর্তন) নদীটির দিকও পরিবর্তন করে দেয়া হয়। এতে মাতামুহুরী নদীর পালাকাটা অংশে কক্সবাজার পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃক প্রায় ২২ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত পালাকাটা রাবার ড্যামটিও হুমকির মুখে পড়েছে। রাবার ড্যামটি নদীর লোপকাটিংয় দিয়ে প্রবাহিত পানির ¯্রােতে পড়ে ক্ষতির শিকার বা পলি পড়ে অকেজো হয়ে যাওয়ার আশংকা রয়েছে। এলাকাবাসি জানায়; একটি স্বার্থান্বেষী মহল নিজেদের লাভের জন্য সরকারী টাকা ব্যয়ে এ বাঁধ নির্মাণ করেছে। এতে সরকারী টাকা খরচ করা হয়েছে। প্রকল্পটি কাজের বিনিময়ে টাকা হলেও এখানে মাটি কাটা হয়েছে স্কেবেটর দিয়ে। অভিযোগ উঠেছে; এ প্রকল্পের বেশীরভাগ টাকা সংশ্লিষ্টরা ভাগাভাগি করে আত্মসাত করেছেন। ওই বাঁধের কারণে মাতামুহুরী নদীর তলদেশের কয়েক শত একরের জমি বের করে নিয়ে ওই জমিগুলো সংশ্লিষ্ট প্রভাবশালী ব্যক্তিরা জবর দখল করে সেখানে এখন মাছের চাষ করা হচ্ছে। এলাকাবাসি জানায়; নদীটির দিক পরিবর্তন করে দেয়ায় সওদাগর ঘোনার ব্যাপক এলাকার ফসলি জমি ও বসতি নদী ভাঙনের কবলে পড়বে। এ ব্যাপারে চকরিয়া উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মোঃ আহসান উল্লাহ মুঠে ফোনে বলেন, সওদাগর ঘোনা এলাকার নদীর ভাঙন রোধের জন্য এ বাঁধগুলো দেয়া হয়েছে। তিনি দু’টি বাঁধ নির্মাণ ও লোপকাটিংয়ে প্রায় ১ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে বলে বিভ্রান্তিকর তথ্য দেন। পরে তার কার্যালয়ে গেলে পিআইও সহকারী জানায়, ওই প্রকল্পটিতে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ৫৮ লাখ ৩৫ হাজার টাকা। এ সময় প্রকল্প কর্মকর্তা মোঃ আহসান উল্লাহ’র কার্যালয়ে গিযে কথা বললে টাকা আত্মসাতের কথা অস্বীকার করে মানুষ দিয়ে কাজ না করে স্কেবেটর দিয়ে মাটি কাটর কাজ সারিয়ে নেয়ার কথা স্বীকার করেন।
অপরদিকে এ নদীর পালাকাটা রাবার ড্যামের পাশে পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্মিত একটি বাঁধ রয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের চিরিঙ্গা শাখা কর্মকর্তা নজরুল ইসলাম জানান, ওই রাবার ড্যামটি পলি পড়ে অকেজো হয়ে যাওয়ায় গত শুষ্ক মৌসুমে পানি উন্নয়ন বোর্ড ড্যামটি মেরামত করার জন্য ড্যামের নিচে ও উপরে দুইটি বাঁধ নির্মাণ করে। ড্যামটি মেরামত শেষে বর্ষার শুরুতেই বাঁধ দুইটি কেটে দেয়া হয়েছে। এলাকাবাসি জানায়, ওই দুইটি বাঁধের মধ্যেও একটি বাঁধ কেটে দিয়ে অন্য একটি বাঁধ ওই প্রভাবশালী মহলটির স্বার্থে রেখে দেয়া হয়েছে। সেই বাঁধটিও চিংড়ি চাষের জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে। প্রভাবশালী মহলটি এক্ষেত্রেও কক্সবাজার পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তাদের সাথে যোগসাজস করে এ বাঁধটি সরকারী অর্থে নির্মাণ করে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করছে। এতেও সরকারীভাবে বরাদ্দ দেয়া টাকা সংশ্লিষ্টদের মধ্যে ভাগাভাগি করা হয়েছে।
এলাকাবাসি জানায়, ওই বাঁধ দু’টির কারণে বর্ষা মৌসুমে নদীর পানি চলাচল বা^ধাগ্রস্ত হবে। খর¯্রােতা এ নদীতে পাহাড়ী ঢল আসলে দু’কূল উপচে উপজেলার ১৮টি ইউনিয়নের মধ্যে চকরিয়া পৌরসভাসহ ১৩টি ইউনিয়নে ব্যাপক বন্যা দেখা দিবে। গত কয়েক বছর ধরে এসব এলাকায় বর্ষা মৌসুমে কয়েকবার বন্যা দেখা দিচ্ছে। ওই বাঁধ দু’টি দেয়ার কারণে বন্যার ঝুঁকি আরও বেড়ে গেল। এ বছর বর্ষার শুরুতেই মাত্র কয়েকদিনের বর্ষণে ওই এলাকায় বন্যা দেখা দেয়। এ ব্যাপারে চকরিয়া উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও কৃষকলীগের কেন্দ্রীয় যুগ্ম সম্পাদক রেজাউল করিম জানান, বন্যার কবল থেকে কৃষকদের বাঁচাতে হলে জরুরীভাবে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। তা না হলে বন্যা দেখা দিয়ে আমন ও চিংড়ি চাষীরা ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির শিকার হবে। তিনি বলেছেন; সরকারী টাকা আত্মসাত করা ও সরকারী অর্থে স্বার্থান্বেষী মহলের ব্যক্তিগত চিংড়ি ঘের তৈরী করার উদ্দেশ্যেই এ ধরণের অপরিকল্পিত প্রকল্প বাস্তবায়ন দেখানো হয়েছে।
এ ব্যাপারে কক্সবাজার পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মোঃ সাবিবুর রহমান জানান, লোপকাটিংয়ের (খাল কেটে নদীর গতিপথ পরিবর্তন) কারণে রাবার ড্যামে কী ধরণের ক্ষতি হতে পারে তা এ বছর দেখে পরবর্তীতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।
ওই এলাকার চিংড়ি চাষীরা জানায়, কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তি মাতামহুরী নদীর চিংড়ি জোনের রামপুর ও চরনদ্বীপ এলাকার টাক্কার ফাঁড়ি খাল, চারালিয়া খাল, বুড়ি পুকুরের বাটামনি খাল, মাছ কাটা খাল, ধুইজ্যার খাল ও ইচার ফাঁড়ি খালে বাঁধ দিয়ে অবৈধভাবে চিংড়ি চাষ করছে। চকরিয়া বর্গা চিংড়ি চাষী সমিতির সভাপতি ফরিদুল আলম জানান, এসব খাল গুলোতে অবৈধভাবে বাঁধ দেয়ায় খাল দিয়ে পানি চলাচল ব্যাহত হচ্ছে। বাঁধের কারণে স্বাভাবিক ভাবে বৈধ চিংড়ি ঘের মালিকরা তাদের ঘেরে পানি ঢুকাতে পারছেন না। ফলে চিংড়ি চাষ ব্যাহত ও নদীর আবহমান ¯্রােত ধারা বন্ধ হয়ে গেছে। তিনি জানান, খালগুলোতে বাঁধ দেয়ায় নদী পথে চিংড়ি চাষী ও লবণ চাষীদের যাতায়তের ক্ষেত্রে চরম ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। তাদেরকে প্রায় ৬ কিলোমিটার অতিরিক্ত নদীপথ পাড়ি দিয়ে বদরখালী নৌ বন্দর যেতে হয়। চিরিঙ্গার দিকে যেতেও অনেক বেশী পথ অতিক্রম করে যেতে হচ্ছে।

পাঠকের মতামত: