মুহাম্মদ গিয়াস উদ্দিন, পেকুয়া :: কক্সবাজারের পেকুয়া উপজেলার মগনামা লঞ্চঘাট থেকে কুতুবদিয়া চ্যানেল হয়ে লেমশীখালী হযরাত মালেক শাহ দরবার ঘাট পারাপারের একমাত্র নৌরুটে গত ১৭ ফেব্রæয়ারী থেকে ২০ ফেব্রæয়ারী দুপুর পর্যন্ত চারদিনেই অন্তত লক্ষাধিক যাত্রী পারপার হয়েছে।
কুতুবদিয়ার হযরাত মালেক শাহ হুজুরের বার্ষিক ফাতেহা ও ওরশ শরীফের প্রধান দিবস সমাপ্ত হয়েছে গতকাল ১৯ ফেব্রুয়ারী। এর দুই দিন পূর্বে থেকে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের দুর দুরান্ত থেকে মালেক শাহের দরবারের অসংখ্য ভক্ত-আশেকানগণ পেকুয়া উপজেলার মগনামা লঞ্চঘাট দিয়ে কুতুবদিয়ার দরবার ঘাটে পার হয়ে কুতুব শরীফ দরবারে যাতায়াত করেছে। গত ১৮ ফেব্রুয়ারী অন্তত ২০ হাজার মানুষ মগনামা-কুতুবদিয়ার দরবার নৌ-রুটে পার হয়ে কুতুব শরীফ দরবারে জিয়ারতের জন্য যাতায়াত করেছেন। আর কুতুব শরীফ দরবারের প্রধান দিবস ছিল গতকাল ১৯ ফেব্রুয়ারী। শুধু এদিন ভোর থেকে রাত ৩ টা পর্যন্ত অন্তত ৬০ হাজার মানুষ মগনামা লঞ্চঘাট দিয়ে ড্যানিস বোটে ও স্পীড বোটে করে কুতুবদিয়া দরাবর ঘাট হয়ে কুতুবদিয়ার মালেকশাহ’র দরবারে গেছে। সব মিলিয়ে গত চার দিনে মগনামা-কুতুবদিয়া দরবার নৌ রুটে অন্তত কুতুব শরীফ দরবারের লক্ষাধিক ভক্ত-আশেকান যাতায়াত করেছে। ডেনিস বোট ও স্পীড এর মাধ্যমে এসব মানুষ পারপার করেছে। প্রতিটি ডেনিস বোটে ঝুঁকি নিয়ে প্রায় শাতাধিক যাত্রী পারাপার করেছে প্রতিজন থেকে ডেনিস বোটে আদায় করা হয়েছে ৩০ টাকা করে। আর প্রতিটি স্পীড বোটে ৮ জন করে যাত্রী পারাপার করেছে। স্পীড বোটে প্রতিজন যাত্রীর/ভক্তদের কাছ থেকে আদায় করা হয়েছে একশত টাকা করে।
এ প্রতিবেদক সরেজমিনে গত ৪ দিন প্রতিদিনি সকাল-সন্ধ্যা-গভীর রাত অবধি মগনামা লঞ্চঘাটের আশেপাশে অবস্থান করে স্বচক্ষে দেখেছেন এবং বিভিন্ন সূত্রে এসব নির্ভরযোগ্য তথ্য-উপাত্ত পেয়েছেন।
জানা যায়, গত ৮/৯ মাস ধরে মগনামা-কুতুবদিয়া দরবার নৌ-রুট খাস কালেকশনের মাধ্যমে চলছে। স্থানীয় প্রভাবশালী যুবদল নেতা নুরুল ইসলাম দৈনিক কখনো ২৫ হাজার টাকা ও আবার কখনো ৩২ হাজার টাকা করে সরকারী কোষাগারে ট্রেজারী চালানের মাধ্যমে জমা দিয়ে আসছিল। খাস কালেকশনের টাকা জমা দেওয়ার স্লীপ পেকুয়ার ইউএনও অফিসে জমা দেন নুরুল ইসলাম।
তবে, গত চার দিনে উত্তোলিত ৪০ লক্ষাধিক টাকা আজ (২০ ফেব্রুয়ারী) রোববার পর্যন্ত সরকারী কোষাগারে জমা দেননি নুরুল ইসলাম। তিনি পেকুয়ার ইউএনও অফিস থেকে খাস কালেকশনের দায়িত্বপ্রাপ্ত। এছাড়াও তিনি মগনামার প্রভাবশালী যুবদল নেতা।
খাস কালেকশনের টাকা উত্তোলন করে জমা দেননি কেন জানতে চাইলে রোববার বিকালে যুবদল নেতা নুরুল ইসলাম জানান, উত্তোলিত টাকার এখনো হিসাব করা হয়নি। তাই জমা দেওয়া হয়নি। গত চার দিনে মগনামা-কুতুবদিয়া দরবার নৌ রুটে সর্বমোট কতো খাস কালেকশনের টাকা উত্তোলিত হয়েছে জানতে চাইলে তিনি কোন ধরনের সদুত্তর দিতে পারেনি।
পেকুয়া উপজেলা স্বেচ্চাসেবক লীগ নেতা ও মগনামা লঞ্চঘাট এলাকার বাসিন্দা মো: মকছুদ জানান, মালেক শাহের বার্ষিক ফাতিহা ও ওরশ উপলক্ষ্যে গত চার দিনে মগনামা-দরবার নৌ রুটে অন্তত লক্ষাধিক মানুষ পারপার হয়েছে। কমপক্ষে হলেও ৪০ লাখ টাকারও বেশি খাস কালেকশনের টাকা উত্তোলণ করা হয়েছে। এই বিপুল পরিমাণ টাকা সরকারী কোষাগারে জমা না দিয়ে স্থানীয় একটি সিন্ডিকেট লুটে নিতে চেষ্টা করছে বলেও তিনি অভিযোগ করেছেন। তিনি এ ঘটনায় সরকারী তদন্ত দাবী করেছেন।
এদিকে মগনামা-কুতুবদিয়ার দরবার নৌ রুটে খাস কালেকশনের পর থেকে স্থানীয় একটি সিন্ডিকেট প্রতিনিয়তই খাস কালেকশনের টাকা ধারাবাহিকভাবে লুটে নিলেও স্থানীয় প্রশাসন কোন ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। ফলে সরকার মোটা অংকের রাজস্ব থেকে বরাবরই বঞ্চিত হয়েছে। এভাবে সরকারী টাকা লুট হলেও রহস্যজনক নিরবতায় রয়েছে দায়িত্বপ্রাপ্ত সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের কর্তাবাবুরা।
অন্যদিকে সরকারি টাকা মেরে লাভবান হচ্ছে স্থানীয় অসাধু সিন্ডিকেট। স্থানীয় কিছু অসাধু লোকজনের অপতৎপরতার কারণে চলতি বাংলা বছরের শুরুতে মগনামা লঞ্চঘাট-কুতুবদিয়ার লেমশীখালী মালেক শাহ দরবার ঘাট পারাপারের নৌরুটটি ইজারা হয়নি। আর এ সুযোগে মগনামার একটি অসাধু সিন্ডিকেটের সদস্যরা খাস কালেকশনের নামে ‘অভিনব কৌশলে’ লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। এতে সরকার লাখ লাখ টাকার রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হলেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কোনোরকম মাথা ব্যথা নেই! কর্তৃপক্ষের এহেন উদাসিনতায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন স্থানীয় সচেতন মহল।
নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, বিগত বছর গুলোতে ওই নৌ-রুট কক্সবাজার জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের স্থানীয় সরকার শাখা হতে ইজারা হতো প্রায় কোটি টাকার ওপরে। প্রতি বছর বাংলা মাসের শুরুতে ওই নৌ-রুটটি পরবর্তী এক বছরের জন্য ইজারা দেওয়ার পর সরকার ইজারা গ্রহীতার কাছ থেকে আয়কর/ভ্যাটসহ প্রায় দেড় কোটি টাকার ওপরে রাজস্ব পেত। কিন্তু চলতি বছর ঘাটটি ইজারা না হওয়ায় সরকার মোটা অংকের রাজস্ব আয় থেকে বঞ্চিত হয়েছে।
সরেজমিনে গিয়ে ও স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা গেছে, পেকুয়া ও কুতুবদিয়া উপজেলার ব্যস্ততম নৌরুট হচ্ছে মগনামা লঞ্চঘাট টু কুতুবদিয়া দরবার নৌরুট। এ রুট দিয়ে প্রতিদিন হাজার মানুষ স্পিডবোট ও ড্যানিস বোট নিয়ে পারাপার করে। ড্যানিস বোটে পারাপারের সময় প্রতি যাত্রীর কাছ থেকে ৩০ টাকা আদায় করা হয়। আর অন্যদিকে স্পিডবোটে যাতায়াতে প্রতি যাত্রীর কাছ থেকে ১০০ টাকা আদায় করা হয়। মালামাল পরিবহনের ক্ষেত্রেও গলাকাটা পরিবহন খরচ আদায় করা হয়। আর পারাপার ও মালামাল পরিবহনের টাকা মগনামা লঞ্চঘাট কেন্দ্রীক নুরুল ইসলাম সিন্ডিকেটের লোকজনই আদায় করে। স্থানীয় নুরুল ইসলামের নেতৃত্বে কয়েকজনের একটি প্রভাবশালী সিন্ডিকেট দীর্ঘদিন ধরে মগনামা লঞ্চঘাট দিয়ে দরবার ঘাটে পারাপারে যাত্রীদের কাছ থেকে খাস কালেকশনের টাকা আদায় করছেন। মালেক শাহের বার্ষিক ফাতিহা ও ওরশ শরীফের সময়ে চারদিন লক্ষাধিক মানুষ পারাপার ছাড়াও প্রতিদিন দেড়-দুই লাখ টাকা পর্যন্ত খাস কালেকশনের টাকা আদায় করা হয়। কিন্তু হলেও প্রতিদিন ২৫-৩২ হাজার টাকা পর্যন্ত সরকারি কোষাগারে জমা দিয়ে থাকে নুরুল ইসলাম। দীর্ঘদিন ধরে খাস কালেকশন আদায় করার সময় কোনো দিনই স্থাণীয় প্রশাসনের কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারীকে মগনামা লঞ্চঘাটে দায়িত্ব পালন করতে দেখা যায়নি। যুবদল নেতা নুরুল ইসলামের নেতৃত্বে একটি প্রভাবশালী সিন্ডিকিটের নিয়ন্ত্রণে খাস কালেকশনের টাকা উত্তোলন করার দায়িত্ব ভাগিয়ে নেওয়ায় এ নিয়ে কোনো ধরনের মাথা ব্যথা নেই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের।
তবে, তবে স্থাণীয় একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র বলছে, মগনামা লঞ্চঘাটে কাউকে খাস কালেকশনের টাকা উত্তোলনের জন্য কাউকে নির্দিষ্ট করে দায়িত্ব দেওয়া হয়নি। প্রশাসনের কিছু দূর্নীতিবাজ কর্মকর্তাকে ম্যানেজ করেই একটি কমিটি করে স্থানীয় যুবদল নেতা নুরুল ইসলাম খাস কালেকশনের দায়িত্ব অনিয়মের আশ্রয় নিয়ে ভাগিয় নিয়েছেন।
এ বিষয়ে পেকুয়া ইউনিয়ন ভূমি অফিসের তহশিলদার কাজল কুমার শীলের সাথে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, সদ্য বদলি হওয়া ইউএনও মগনাম টু কুতুবদিয়া দরবার ঘাট নৌরুটে পারাপারে যাত্রীদের কাছ থেকে খাস কালেকশনের টাকা উত্তোলনের জন্য মগনামার যুবদল নেতা নুরুল ইসলামের নেতৃত্বে কয়েকজনকে দায়িত্ব অর্পণ করেছিলেন তিনি এতটুকু জানেন। মগনামা ঘাটে খাস কালেকশনের টাকার লুট হচ্ছে বলেও এ কর্মকর্তা স্বীকার করেছেন।
পাঠকের মতামত: