শাহীন মাহমুদ রাসেল :: করোনা মহামারিতে দীর্ঘ আট মাস ধরে বন্ধ থাকা কক্সবাজার জেলার কিন্ডারগার্টেন স্কুল, স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদ্রাসা ও নন এমপিও বেসরকারি প্রাইমারি স্কুলের প্রায় এক হাজার শিক্ষক-কর্মচারী মানবেতর জীবনযাপন করছেন। কিন্ডারগার্টেন স্কুল কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠানের ভাড়া, বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ করতে হিমশিম খাচ্ছে। ইতোমধ্যে কয়েকটি স্কুলের কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে এবং দেওয়ার চিন্তাভাবনা চলছে। মাদ্রাসা ও নন এমপিও স্কুলের শিক্ষক-কর্মচারীরা সরকারের কাছ থেকে কিছু মানবিক সহায়তা পেলেও এসব কিন্ডারগার্টেনের শিক্ষক-কর্মচারীরা কোনো সহায়তা পাননি।
দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুরু হলে গত ১৭ মার্চ থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করে সরকার। এরপর দফায় দফায় বন্ধের মেয়াদ বাড়ানো হয়। সর্বশেষ নির্দেশনায় আগামী ১৪ নভেম্বর পর্যন্ত এ মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে।
শহিদ উল্লাহ রামু উপজেলার একটি বেসরকারি মাদ্রাসার শিক্ষক। মাসে বেতন পান তিন হাজার টাকা। এ ছাড়া কিছু ছাত্রছাত্রীকে ব্যাচে পাড়াতেন। পাশাপাশি সন্ধ্যা থেকে রাত পর্যন্ত বাসায় গিয়ে করতেন টিউশনি। সব মিলিয়ে মাসে ১৫-১৭ হাজার টাকা পেতেন। এতেই মোটামুটি সংসারের খরচ মিটে যেত তাঁর। কিন্তু করোনার কারণে মার্চ থেকে তাঁর সবই বন্ধ রয়েছে। এখন ঋণ ও জমানো টাকায় চলছে সংসার।
শুধু শহিদ উল্লাহই নন, এটি জেলার সব বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদেরই দুরবস্থার চিত্র। জেলায় মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের বেসরকারি শিক্ষক আছেন অন্তত এক হাজার। আর কর্মচারী রয়েছেন দুই শতাধিক জন। করোনার কারণে জেলার প্রায় ৮০ শতাংশ বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীদের সাত আট মাস ধরে বেতন-ভাতা বন্ধ রয়েছে। বন্ধ হয়ে গেছে ব্যাচ পড়ানো ও টিউশনিও। আর্থিক অনটনে শিক্ষকেরা পরিবার-পরিজন নিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছেন।
বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও কলেজের শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, জেলার অধিকাংশ বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ভাড়া করা ভবন নিয়ে তাদের শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করছে। বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো সরকারি কোনো ধরনের অনুদান পায় না। শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে মাসিক বেতন, পরীক্ষার ফি ও ভর্তির ফি থেকে প্রাপ্ত টাকা দিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের খরচ ও কর্মরত শিক্ষকদের বেতন পরিশোধ করা হয়ে থাকে। আবার কিছু কিছু বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মালিকপক্ষ বিদ্যালয়ের মাসিক আয় থেকে আগে নিজের জন্য আয়ের একটা পরিমাণ কেটে নিয়ে যান। অবশিষ্ট অংশ থেকে প্রতিষ্ঠানের যাবতীয় খরচ মেটাতে হয়। একই অবস্থা জেলার কিন্ডারগার্টেনগুলোতেও।
করোনার সংক্রমণ প্রতিরোধে গত ১৭ মার্চ থেকে সরকার সারা দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করে। এখনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। যে কারণে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে বেতন আদায় করতে পারছে না। এ জন্য জেলার বেসরকারি ও নন–এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ মার্চ মাস থেকেই শিক্ষকদের বেতন দিতে পারছে না। অনেকে ত্রাণ সহায়তাও পাচ্ছে না। বিশেষ করে সামাজিক মর্যাদার কারণে অনেকেই কারো কাছে হাত পাততে পারছে না বলে তারা জানিয়েছেন। এ কারণে সেসব প্রতিষ্ঠানে কর্মরত শিক্ষক, কর্মচারী ও তাঁদের পরিবার করোনার এই সময়ে মানবেতর জীবন যাপন করছেন।
বেসরকারি প্রতিষ্টানের অন্তত ১০ জন শিক্ষকের সঙ্গে কথা হলে তাঁরা জানান, শিক্ষকেরা নিজ নিজ প্রতিষ্ঠান থেকে স্বল্প বেতন পান, যা দিয়ে তাঁদের পরিবারের খরচ কোনোভাবেই মেটানো সম্ভব নয়। তাই বাধ্য হয়েই প্রাইভেট পড়ানো ও টিউশনি করতে হয়। মার্চ থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার পরও বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভাড়া নেওয়া ভবনের ভাড়া প্রতি মাসে পরিশোধ করতে হচ্ছে। যদিও প্রতিষ্ঠানের কোনো আয় নেই। এতে হিমশিম খাচ্ছে মালিকপক্ষ।
ফয়সাল নামের এক স্কুলশিক্ষক বলেন, শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড, যা একজন শিক্ষক মজবুত করেন। অথচ আট মাস ধরে প্রতিষ্ঠান থেকে কোনো বেতন পাচ্ছি না। প্রাইভেট ও টিউশনিও বন্ধ। ঋণ করে পরিবারের খরচ চালাচ্ছি। এভাবে চলতে থাকলে অবশেষে দিনমজুরের কাজে নামতে হবে।
মোবারক নামের এক শিক্ষক বলেন, গ্রাম অঞ্চলের কোনও প্রতিষ্ঠানেই টিউশন ফি আদায় করা যাচ্ছে না। আমার প্রতিষ্ঠানে যারা লেখাপড়া করে তারা হতদরিদ্র। টিউশন ফি দেওয়ার মতো ক্ষমতা তাদের নেই। পরীক্ষার সময় সামান্য কিছু অর্থ নেওয়া হতো। করোনার কারণে সেই সুযোগও থাকছে না। একারণে শিক্ষকরা এবছর একটি টাকাও পাবেন না। তারা মানবেতর জীবনযাপন করছেন।
রামু উপজেলার নন-এমপিওভুক্ত রাজারকুল ইসলামিয়া বালিকা দাখিল মাদ্রাসার ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক আবদুস সালাম বলেন, করোনার সময় টিউশন ফি আদায় না হওয়ায় শিক্ষকদের বেতন দিতে পারছি না। তারা মানবেতর জীবনযাপন করছেন। তিনি বলেন, করোনা পরিস্থিতিতে শুধু আমার মাদ্রাসাই নয়, দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নন-এমপিও শিক্ষকরা বেতন না পেয়ে অত্যন্ত কষ্টে আছেন।
জেলা কিন্ডারগার্টেন এসোসিয়েশনের সভাপতি কক্সবাজার ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের অধ্যক্ষ রফিকুল ইসলাম বলেন, ছাত্রছাত্রীদের কাছ থেকে আদায় করা বেতন থেকেই বেসরকারি সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিয়োজিত শিক্ষকসহ জনবলের বেতন, বাড়িভাড়া ও অন্যান্য খরচ বহন করতে হয়। বেসরকারি এই প্রতিষ্ঠানগুলো সরকার থেকে আংশিক বা পুরোপুরি কোনো ধরনের আর্থিক সুবিধা পায় না। তাই বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীর জন্য সুদবিহীন ঋণ এবং অনলাইন, মোবাইল ব্যাংকিং বা ব্যক্তিগতভাবে শিক্ষার্থীদের নিকট থেকে প্রতিষ্ঠানের মাসিক টিউশন বেতন আদায়ের অনুমতিসহ প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঁচ দফা দাবি জানানো হয়।
বিদ্যমান এই পরিস্থিতিতে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক নেতারা সরকারের কাছে প্রণোদনা চেয়েছেন। এসব প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণসহ জরুরিভিত্তিতে এমপিওভুক্তিরও দাবি জানানো হয়।
পাঠকের মতামত: