বিদেশ ডেস্ক :
লম্বাবিল সীমান্ত দিয়ে এভাবেই দলে দলে বাংলাদেশে ঢুকেছেন রোহিঙ্গারাযুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী দৈনিক পত্রিকা নিউ ইয়র্ক টাইমসের সাংবাদিক জেফরি গেটলেম্যান। আন্তর্জাতিক সাংবাদিকতার জন্য ২০১২ সালে তিনি পুলিৎজার পুরস্কার পেয়েছিলেন। বর্তমানে নিউ ইয়র্ক টাইমসের দক্ষিণ এশিয়ার ব্যুরো প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। সম্প্রতি কক্সবাজারে রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শনকালে রাখাইনের সহিংসতায় পালিয়ে আসা একাধিক রোহিঙ্গা নারী-পুরুষের সঙ্গে কথা বলেছেন। এসব সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে ১১ অক্টোবর নিউ ইয়র্ক টাইমসে একটি প্রতিবেদন লিখেছেন। “রোহিঙ্গা রিকাউন্ট অ্যাট্রসিটিজ: ‘দে থ্রিউ মাই বেবি ইনটু এ ফায়ার’’ শিরোনামের ওই প্রতিবেদনে উঠে এসেছে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর ভয়ঙ্কর নিপীড়নের বিবরণ। প্রতিবেদনটি বাংলা ট্রিবিউন পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো:
বন্দুকের মুখে নদীতে কয়েকশ নারী। তাদেরকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে নড়াচড়া না করতে। সেনাদের একটি দল এগিয়ে এলো এক তরুণীর দিকে। নদীতে বুক সমান পানিতে দাঁড়িয়ে থাকা ওই তরুণীর নাম রাজুমা। বুকের একটু ওপরে সন্তানকে কোনোমতে ধরে রেখেছেন। মিয়ানমারের রাখাইনে সেনাবাহিনী ও স্থানীয় বৌদ্ধরা গ্রাম পুড়িয়ে দেওয়ায় পালিয়ে এসেছেন তিনি।
‘তুমি,’ রাজুমা’র দিকে ইঙ্গিত করে বলে ওঠে এক সেনা।
রাজুমা নিশ্চল হয়ে পড়ে।
‘তুমি!’
এরপর মুহূর্তের সহিংসতায় অন্ধকার হয়ে ওঠে তার চারপাশ। সেনারা লাঠি দিয়ে রাজুমার মুখে আঘাত করে। কান্নারত সন্তানকে কেড়ে নেয় একটানে। ছুড়ে মারে আগুনে। রাজুমাকে জোর করে টেনে-হিঁচড়ে নেওয়া হয় একটি ঘরে। সেখানে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হন সদ্য সন্তান হারানো রাজুমা।
দিনের সূর্য তখন প্রায় অস্তমিত। নগ্ন ও রক্তাক্ত শরীর নিয়ে একটি ধানের ক্ষেত দিয়ে দৌড়ে পালাচ্ছিলেন রাজুমা। সন্তান হারিয়েছেন তিনি; হারিয়েছেন মা, দুই বোন ও দুই ছোট ভাইকে। সবাইকে তার চোখের সামনেই হত্যা করা হয়েছে।
নাফ নদী পেরিয়ে আসা এই রোহিঙ্গা জানেন না তার সন্তানদের ভবিষ্যৎ কীমিয়ানমারে রাখাইনে রোহিঙ্গারা এক অবর্ণনীয় নিপীড়ন ও হত্যাযজ্ঞের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের একটি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আশ্রয় নেওয়া রাজুমার কথায় সেই নির্যাতনেরই প্রতিচ্ছবি। রাজুমা একজন রোহিঙ্গা মুসলিম, যাদেরকে বিশ্বের সবচেয়ে অনাকাঙ্ক্ষিত জাতিগোষ্ঠী হিসেবে মনে করা হয়।
বাংলাদেশের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আসা নিউ ইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদকের কাছে এভাবেই রাজুমা তার সব হারানোর গল্প বলেন। তার নির্মম কাহিনী জানান দেয়, আগস্টের শেষ দিকে তার গ্রামে কী ঘটেছে। এখানে রাজুমার মতো কয়েক লাখ রোহিঙ্গা পালিয়ে এসেছেন নিরাপদে থাকার প্রত্যাশায়। তাদের আরও কয়েকজনও জানিয়েছেন একই ধরনের নির্মমতার কথা। মানবাধিকার সংগঠনগুলোও রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনীর নিপীড়নের তথ্য সামনে এনেছে।
পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা জানান, সরকারি সেনা সদস্যরা শিশুদের কুপিয়ে হত্যা করছে, ছেলেদের দেহ থেকে মাথা কেটে বিচ্ছিন্ন করছে, ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে পুরো পরিবারকে নিশ্চিহ্ন করছে, গ্রামের নিরস্ত্র ব্যক্তিকে বেশ কয়েকজন ঘিরে ধরছে এবং পরে হত্যা করছে। এইসব সহিংসতার ঘটনা নৃশংসতম নিষ্ঠুরতা; যা নতুন কোনও উদাহরণ নয়। ইতিহাসে জাতিগত বিদ্বেষের ক্ষেত্রে এমন ঘটনাগুলোই ঘটে থাকে।
রাজুমার ভাষায়, ‘লোকজন সেনাদের পায়ে ধরে কান্নাকাটি জীবন ভিক্ষা চেয়েছে। কিন্তু তারা থামেনি। লাথি মেরে দূরে সরিয়ে দিয়েছে, হত্যা করেছে। তারা মানুষকে কুপিয়ে, গুলি করে হত্যা করেছে। তারা আমাদের ধর্ষণ করেছে, অচেতন অবস্থায় ফেলে চলে গেছে।’
মানবাধিকার লঙ্ঘনের তদন্তকারীরা জানিয়েছেন, রাখাইনে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী অন্তত এক হাজার বেসামরিক নাগরিককে হত্যা করেছে। এই সংখ্যা পাঁচ হাজার ছাড়াতে পারে বলে ধারণা করা হয়। মিয়ানমার সরকার রাখাইনে জাতিসংঘসহ কোনও সংস্থা বা কাউকে প্রবেশের অনুমতি দিচ্ছে না। ফলে সত্যিকার অর্থে নিহতের সংখ্যা জানতে পারা কঠিন হয়ে পড়েছে।
বুধবার জাতিসংঘ জানিয়েছে, মিয়ানমার সেনাবাহিনী বেঁচে থাকা রোহিঙ্গাদের তাড়িয়ে দিতে ধর্ষণ ও অন্যান্য মানসিক আঘাত করার মতো কৌশল অবলম্বন করছে। সহিংসতার মাত্রা ছাড়াতে তারা বাড়িঘর, ক্ষেত ও গৃহপালিত পশু পর্যন্ত পুড়িয়ে দিচ্ছে। এর মধ্য দিয়ে রোহিঙ্গারা যেন পুনরায় রাখাইনে ফিরে আসতে না পারে এবং পারলেও যেনও নিজেদের ঘরবাড়ি শনাক্ত করতে না পারে, সেটা নিশ্চিত করতেই সেনাবাহিনী এসব কাণ্ড ঘটাচ্ছে বলে উল্লেখ করেছে জাতিসংঘ।
নৌপথে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বাংলাদেশে এসেছেন রোহিঙ্গারাহিউম্যান রাইটস ওয়াচের প্রবীণ তদন্তকারী পিটার বুকায়ের্ট জানান, রাখাইনে সুসংগঠিত ও পরিকল্পিত হত্যাযজ্ঞের ঘটনা ঘটছে। একটি এলাকায় সেনারা পরিকল্পিতভাবে শতাধিক বেসামরিক নাগরিককে হত্যা করেছে। এরকম একটি হত্যাযজ্ঞ থেকে বেঁচে গেছে রাজুমা। মিয়ানমার সেনাবাহিনী রাখাইনে মানবতাবিরোধী অপরাধ করছে জানিয়েছেন বুকায়ের্ট।
মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে, রাখাইনে মিয়ানমারের সেনারা একটি লক্ষ্য নিয়েই কাজ করছে। আর তা হলো— পুরো রোহিঙ্গা সম্প্রদায়কে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া। জাতিসংঘ মিয়ানমারের এই সামরিক অভিযানকে ‘জাতিগত নিধনের প্রামাণ্য উদাহরণ’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছে।
প্রায় প্রতিরাতেই বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশে উপকূলীয় এলাকায় মিয়ানমার থেকে ভেসে আসা লাশ পাওয়া যাচ্ছে। ছিদ্র হয়ে নৌকাডুবির কারণে নারী, শিশু ও বৃদ্ধ নারীরা নদীতে ডুবে মরছে।
কয়েক সপ্তাহ আগে রাজুমা কোনোমতে একটি কাঠের নৌকায় বাংলাদেশে আসতে পেরেছেন। পড়তে বা লিখতে পারেন না, মিয়ানমারে জন্ম হয়েছে— এমন কোনও কাগজপত্রও তার নেই। বাংলাদেশে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় চাইতে গেলে তার কাগজপত্র না থাকাটা নিশ্চিতভাবে সমস্যা তৈরি করবে। কিংবা মিয়ানমারে ফিরতে চাইলেও কাগজপত্র না থাকলে ফেরাটা তার জন্য কঠিন হয়ে পড়বে। রাজুমা নিজের বয়স ২০ বছর বলে মনে করেন, যদিও তার শরীর দেখে মনে হবে তিনি মাত্র ১৪ বছর বয়সের এক কিশোরী।
রাজুমা বেড়ে উঠেছেন টুলা টলি নামের একটি কৃষি এলাকায়। এই এলাকায় কখনোই শান্তি ছিল না, জানান তিনি। তার গ্রামে রোহিঙ্গা মুসলিম ও বৌদ্ধ রাখাইন জাতিগোষ্ঠীর বাস। উভয় জাতির ধর্ম আলাদা, ভাষা আলাদা, খাবারও আলাদা। একটি বিষয়েই তাদের মিল— পারস্পারিক অবিশ্বাস।
রাজুমার বাড়ি থেকে কয়েক মিনিট হাঁটা দূরত্বে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের বসবাস। কিন্তু কখনও কোনও বৌদ্ধের সঙ্গে কথা হয়নি রাজুমার। রাজুমা বলেন, ‘তারা আমাদের ঘৃণা করে।’
অনেকেই কেবল জীবনটাই নিয়ে আসতে পেরেছেন রাখাইন থেকেরোহিঙ্গাদের নিয়ে স্কটিশ অ্যাকাডেমিক আজিম ইব্রাহিম সম্প্রতি একটি বই লিখেছেন। তাতে তিনি বলেছেন, রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ঘৃণা করার বীজটি বপন করা হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়। ওই সময় রোহিঙ্গারা ব্রিটিশদের হয়ে লড়াই করে এবং অনেক রাখাইন বৌদ্ধ দখলদার জাপানের হয়ে লড়াই করে। উভয় পক্ষই ব্যাপক আকারে বেসামরিকদের হত্যা করে।
যুদ্ধে জোট জয়ী হলে রোহিঙ্গারা স্বাধীনতা অথবা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমান বাংলাদেশ) সঙ্গে একীভূত হওয়ার প্রত্যাশা করেছিল। কিন্তু ব্রিটিশরা মিয়ানমারের সংখ্যালঘু বৌদ্ধদের খুশি করতে রোহিঙ্গা এলাকাকে স্বাধীন মিয়ানমারের (ওই সময় বার্মা) অংশে পরিণত করে। এর ফলে যে বৈষম্য তৈরি হয়, তার শিকার দশকের পর দশক হয়ে আসছেন রোহিঙ্গারা।
ওই সময় থেকেই মিয়ানমারের নেতারা রোহিঙ্গাদের অধিকার খর্ব করতে শুরু করেন এবং দেশটির দুর্দশার জন্য রোহিঙ্গাদের দায়ী করতে থাকেন। রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশি অবৈধ অভিবাসী হিসেবে আখ্যায়িত করে তারা অভিযোগ তোলেন, রোহিঙ্গারা তাদের জমি দখল করে নিয়েছে। কয়েকজন প্রভাবশালী বৌদ্ধ ভিক্ষুর মতে, রোহিঙ্গারা পূর্বজন্মে সাপ ও কীটপতঙ্গ ছিল। ফলে পোকামাকড়ের মতো তাদের নির্মূল করা উচিত।
আজিম ইব্রাহিম বলেন, ‘বছরের পর বছর ধরে রোহিঙ্গাদের হুমকি হিসেবে মনে করা হয়েছে।’
এমন মনোভাব ও তা থেকে শুরু হওয়া নিপীড়ন রোহিঙ্গাদের নতুন সশস্ত্র আন্দোলনের পেছনে রসদ জুগিয়েছে। যারা ২৫ আগস্ট মিয়ানমারের নিরাপত্তাবাহিনীর ফাঁড়িতে একযোগে সমন্বিত হামলা চালিয়েছে।
রাতের আঁধারেও নৌকায় নদী পেরিয়ে এসেছেন রোহিঙ্গারানিজের গ্রাম থেকে রাজুমা এই হামলার অন্তত একটির অথবা সেনাবাহিনীর পাল্টা হামলার বিস্ফোরণ শুনেছে। এরপর কয়েকদিন ধরে রাজুমা দিগন্তজুড়ে আগুনের ধোঁয়া উঠতে দেখে। সেনাবাহিনী তখন ক্লিয়ারেন্স অভিযান জোরদার করেছে। টুলা টুলি গ্রাম পুড়িয়ে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া হয়েছে। ২৯ আগস্ট মসজিদ থেকে এক প্রবীণ ব্যক্তি এসে রাজুমাকে জানায়— ‘বৌদ্ধরা বলেছে, আমাদের নিরাপত্তার জন্য নদীতে যেতে হবে।’
রাজুমার পরিবার বাড়িতে থাকার সিদ্ধান্ত নেয়। পরদিন সকালে রাজুমা ব্যস্ত ছিলেন আলুর তরকারি রান্না করতে। যখন তিনি হাড়িতে রসুন ও মরিচ ঢালছিলেন, তখন বুঝতে পারেন কিছু একটা ঘটছে। রান্না থামিয়ে জানালা দিয়ে তাকান। দেখতে পান, একদল সেনা টুলা টলি গ্রামের দিকে মার্চ করে এগিয়ে আসছে।
রাজুমা ও তার পরিবার পালানোর চেষ্টা করে। কিন্তু দ্রুতই সেনারা তাদের নদীর তীরে আটকে ফেলে। সেখানে গ্রামের আরও কয়েকশ মানুষ বন্দি।
রাজুমাসহ টুলা টলি গ্রামের অনেকে জানায়, সেনারা সেখানে নারী ও পুরুষকে আলাদা করে ফেলে। গ্রামবাসীরা হাঁটু গেড়ে, সেনাদের বুটে পড়ে জীবন ভিক্ষা চায়। কিন্তু সেনারা পুরুষদের একের পর এক হত্যা করে। নারী ও কিশোরীদের পানিতে নামিয়ে দেওয়া হয় এবং বলা হয় অপেক্ষা করতে। নিউ ইয়র্ক টাইমসের পক্ষ থেকে তাদের সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছে পৃথকভাবে।
কৌশলের ব্যবহার, উন্মুক্ত স্থানে হত্যা, সংঘবদ্ধ ধর্ষণ এবং সামরিক সংগঠনের মাত্রার যে চিত্র ওই এলাকায় উপস্থিত, বিভিন্ন রোহিঙ্গাদের জবানিতে উঠে আসা বর্ণনায় সেই নিপীড়নের সাদৃশ্য রয়েছে।
ইউনিসেফের নির্বাহী পরিচালক অ্যান্থনি লেক বলেন, ‘নিপীড়নের ঘটনাগুলো চিরন্তন সত্য।’ তিনি জানান, রোহিঙ্গা শিশুরা ক্যাম্পে বন্দুক, আগুন, চাপাতি ও মাটিতে পড়ে থাকা রক্তাক্ত মানুষের ছবি আঁকছে। এটি তাকে গভীরভাবে ব্যথিত করেছে।
পরিবার পরিজন হারিয়ে তারা এসে আশ্রয় নিয়েছেন বাংলাদেশেবাংলাদেশের কক্সবাজারে একটি হাসপাতালের পড়ে আছেন রোহিঙ্গা দোকানদার মুহামেদুল হাসান। মনু পাড়া নামক গ্রামের বাসিন্দা তিনি। চিকিৎসকদের মতে, তার বেঁচে থাকাটাই বিস্ময়কর।
হাসান জানান, ২৭ আগস্ট ২০ জন সেনা পাশের ঘাঁটি থেকে তাদের মনু পাড়া গ্রামে প্রবেশ করে। ১০ বছরের বেশি বয়সের ছেলে ও সব পুরুষকে এলাকার গরু ব্যবসায়ীর বাড়িতে হাজির হতে বলে। সেখানে সেনারা হাত পেছনে নিয়ে সবাইকে বেঁধে ফেলে। হাত বাঁধা অবস্থায় উঠানে মাথা নিচু করে বসতে বাধ্য করে।
হাসান আরও জানান, সেখানে প্রায় ৪শ ছেলে ও পুরুষকে জড়ো করা হয়। শার্ট বেয়ে তাদের ঘাম ঝরে পড়ছিল। এরপর সেনাবাহিনীর এক সার্জেন্ট, যাকে গ্রামবাসীরা আগে থেকেই চিনতেন, একটি লম্বা ও পাতলা ছুরি বের করে। হাসান বলেন, ‘লোকজন তখন সাহায্যের জন্য চিৎকার করছিল। ছেলেরা মা-বাবার নাম ধরে চিৎকার করছিল।’
হাসান জানান, তার চোখের সামনে একের পর এক লোককে শিরশ্ছেদ অথবা গুলি করা হয়। তার শরীরে তিনটি গুলি লাগে। দু’টি পিঠে ও একটি বুকে। কিন্তু তিনটি গুলিই গুরুত্বপূর্ণ কোনও অঙ্গে আঘাত করেনি।
সেনারা চলে যাওয়ার পর হামাগুড়ি দিয়ে হাসান বাড়িতে পৌঁছান। সেখানে তার বোন আদা শুকাচ্ছিল। আদা দিয়েই তার ক্ষত সারানোর চেষ্টা করা হয়, যা তাকে বেঁচে থাকতে সহযোগিতা করে।
মানবাধিকার তদন্তকারীরা জানিয়েছেন, সবচেয়ে ভয়াবহ নৃশংসতা সংঘটিত হয়েছে ২৫ আগস্ট থেকে ১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ওই সময়ে সেনারা সামনে যাকেই পেয়েছে, তাকেই হত্যা করতে চেয়েছে।
রাখাইন থেকে রোহিঙ্গাদের স্রোত থামেনি এখনওটুলা টলি গ্রামে রাজুমা নিজের ১৮ মাসের সন্তান মোহাম্মদ সাদেককে নিজের সর্বোচ্চ দিয়ে আকঁড়ে ধরার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু এক সেনা তার হাত ধরে রাখে, অন্য একজন জাপটে ধরে তার শরীর। তৃতীয় আরেকজন লাঠি দিয়ে তার মুখে আঘাত করে। তার চোয়ালজুড়ে সেই আঘাতের চিহ্ন এখনও স্পষ্ট।
রাজুমার ছেলে কেড়ে নেওয়া হয় তার কাছ থেকে। পা ধরে শূন্যে ছুড়ে ফেলা হয়। তার ভাষায়, ‘তারা আমার ছেলেকে শূন্যে ছুড়ে মারে, আগুনে ছুড়ে ফেলে দেয়।’
রাজুমা জানান, দুই সেনা তাকে একটি ঘরে নিয়ে যায়। তার ঘোমটা ও পোশাক ছিড়ে ফেলে এবং ধর্ষণ করে। তার দুই বোনকেও একই ঘরে ধর্ষণ করার পর হত্যা করা হয়। পাশের ঘরে তার মাকে ধর্ষণ এবং ১০ বছরের ভাইকে গুলি করে হত্যা করা হয়।
এক সময় রাজুমা ভেবেছিলেন, তিনি হয়তো মারা গেছেন। নির্যাতনের তীব্রতা সইতে না পেরে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। জ্ঞান ফিরলে বুঝতে পারেন, সেনারা চলে গেছে। কিন্তু তখনও ঘরটিতে জ্বলছে আগুন। বিবস্ত্র অবস্থায় উঠে দাঁড়ান রাজুমা। স্বজনদের লাশ আর জ্বলন্ত বাড়িঘর পেছনে ফেলে আশ্রয় নেন জঙ্গলে। অন্ধকার রাত নেমে আসে পৃথিবীর বুকে, কিন্তু রাজুমার চোখে আর ঘুম আসে না।
এক সময় সকাল হয়। পুরনো টি-শার্ট খুঁজে পান রাজুমা। তা গায়ে দিতে দৌঁড়াতে থাকেন, এক অজানা গন্তব্যে।
রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আশ্রয় নেওয়া মানুষদের অনেকেই এমন বীভৎস নির্যাতনের সাক্ষী। কিন্তু তাদের অনেকেই ভয়াবহ রকমের নির্বিকার। কথা বললে মনে হয়, তাদের হয়তো কোনও অনুভূতিই নেই। নৃশংসতা থেকে বেঁচে যাওয়া যেসব মানুষ সাক্ষাৎকার দিয়েছেন, তাদের প্রায় সবাই জানিয়েছেন, তাদের সামনে হত্যা করা হয়েছে প্রিয়জনকে। কিন্তু কারও চোখ দিয়ে একফোঁটা পানি পড়তে দেখা যায়নি।
এই নবজাতক আসতে পেরেছে বাংলাদেশে, রাজুমা পারেননি তার সন্তানকে আনতেতবে রাজুমা তাদের থেকে ব্যতিক্রম। ঘটনার বিবরণ দিতে গিয়ে বারবার কান্নায় ভেঙে পড়ছিলেন। চিবুক বেয়ে গড়িয়ে পড়া অশ্রুর ধারা মুছতে মুছতেই বলছিলেন, ‘আমার ছেলে আর আমাকে মা বলে ডাকবে না কোনোদিন। এটি কত কষ্টের, তা বলে বুঝাতে পারব না।’
আরেকটি পরিবারের কাছ থেকে ধার করে নিয়ে আসা একটি প্লাস্টিকের টুলে বসেছিলেন রাজুমা। মুখে লাল কাপড়ের ঘোমটা। ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে শ্বাস নিতে পারছিলেন না।
আরও কয়েকজন রোহিঙ্গা পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় তাকান রাজুমার দিকে। পর মুহূর্তেই চলে যান রান্না বা ঝাড়ু দেওয়ার কাজে। বাইরে, খুব কাছেই রাস্তায় তখন হর্ন বাজিয়ে চলেছে কয়েকটি ট্রাক, যানজট ঠেলে এগিয়ে তো যেতে হবে।
পাঠকের মতামত: