ঢাকা,শুক্রবার, ১৫ নভেম্বর ২০২৪

বাঘের প্রজনন চকরিয়ায় !

taiছোটন কান্তি নাথ, চকরিয়া ::

কক্সবাজারের চকরিয়ার ডুলাহাজারা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্ক। পার্কটি বাঘের প্রজনন কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে চলেছে। এখানে থাকা সুন্দরবনের ব্যাঘ্রজুটি ‘জয়’ ও ‘জুঁই’ এর সংসারে জন্ম নেওয়া ‘আঁখি’ ও ‘নয়ন’ আলো ছড়াচ্ছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, একসময় এই পার্কটি বাঘ প্রজননের জন্য গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারবে। এতে করে দেশের চিড়িয়াখানাগুলো এবং গাজীপুরে বঙ্গবন্ধুর নামে প্রতিষ্ঠিত দ্বিতীয় সাফারি পার্কে এখান থেকে বাঘ সরবরাহ করা যাবে। এছাড়া বিদেশেও পাঠানো যাবে। এর জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে এখন থেকেই প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে হবে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, একসময় সাফারি পার্কে পুরুষ বাঘ ছিল না। দীর্ঘদিন ধরে বাঘিনীকে একাকী জীবন কাটাতে হয়। অনেক আবেদননিবেদনের পর ২০১২ সালের ১৩ অক্টোবর এখানে পাঠানো হয় বাঘের তিনটি শাবক। এর আগে ১১ জুন ঢাকার শ্যামলীতে র‌্যাবের হাতে ধরা পড়ে পাচারকারীসহ তিনটি ব্যাঘ্রশাবক। তাদের নাম রাখা হয় ‘জয়’, ‘জুঁই’ ও ‘জ্যোতি’। শাবকগুলো সুন্দরবনের কাঁকড়াখালী পয়েন্ট থেকে চুরি করে পাচারের উদ্দেশ্যে ঢাকায় আনে সংঘবদ্ধ চক্র। এরপর মিরপুরে জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যানের বিয়ারিং হাউজে টিস্যু কালচার পদ্ধতিতে প্রায় চার মাস পর্যন্ত ওগুলোর পরিচর্যা চলে। ৬ মাস বয়স পূর্ণ হলে ওই বছরের ১৩ অক্টোবর তাদের পাঠানো হয় ডুলাহাজারা বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্কে।

তিন শাবকে পার্কের চেহারা পাল্টে যায়। এর মধ্যে বছর দেড়েক আগে জ্যোতিকে ঢাকা চিড়িয়াখানায় পাঠানো হয়। জয় ও জুঁইকে সাফারি পার্কে একসঙ্গে রাখা হয়। তাদের সংসারেই জন্ম নেয় আঁখি ও নয়ন। অবশ্য প্রথমবার তিন শাবক জন্ম দিলেও নানা কারণে তাদের বাঁচিয়ে রাখা যায়নি। বর্তমানে আঁখি ও নয়ন পার্কের মধ্যমণি হিসেবে দর্শনার্থীদের মনে আনন্দ দিচ্ছে।

নতুন এই দুই অতিথির একটি পুরুষ, অপরটি স্ত্রী। জন্মের পর পরই তাদের নাম রাখা হয়। বর্তমানে দুই শাবক সুস্থ আছে। রাখা হয়েছে বাঘ বেষ্টনীতে। আঁখির ওজন ৯০ কেজি, নয়নের ওজন ১শ কেজি। জন্মের ৫ মাস পর থেকে দুই শাবককে মায়ের কাছ থেকে আলাদা রাখা হয়েছে। বর্তমানে দুই শাবকের বয়স ১৫ মাস। নতুন অতিথিদের দেখতে ভিড় করছে সব বয়সী মানুষ। বিশেষ করে শিশুরা শাবক দুটির প্রতি বেশ আকৃষ্ট হচ্ছে।

বাংলাদেশ বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের সাবেক বন সংরক্ষক ও বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞ ড. তপন কুমার দে চকরিয়া নিউজকে বলেন, সাফারি পার্কের আবদ্ধ পরিবেশে সুন্দরবনের বাঘের শাবক জন্ম দেওয়ার ঘটনাটি একেবারে বিরল এবং ঐতিহাসিক। আমাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা ছিল শাবক দুটিকে উপযুক্ত পরিচর্যার মধ্য দিয়ে বড় করে তোলা। সেই চেষ্টা সফল হয়েছে।

পার্ক সূত্র জানায়, সাফারি পার্কে থাকা জয়জুঁইয়ের সংসার আলোকিত করে ২০১৫ সালের ৫ মে তিনটি ফুটফুটে শাবক জন্ম নিয়েছিল। ওইসময় বেষ্টনীর কাছে মানুষ দেখলেই হুঙ্কার ছাড়ত মা জুঁই। এমনকি প্রতিনিয়ত ছবি তোলাসহ নানা কারণে জন্মের তিনদিনের মাথায় শাবক তিনটিকে মায়ের আক্রোশ থেকে বাঁচানো সম্ভব হয়নি। তাই পরে জন্ম নেওয়া আঁখি ও নয়নকে বাঁচিয়ে রাখতে আগেভাগে ব্যবস্থা নেওয়া হয়।

সূত্র আরো জানায়, আঁখি ও নয়নের জন্মের পর বাঘবেষ্টনীর কাছে কোনো মানুষকে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি। বেষ্টনীর চতুর্দিকে কয়েক স্তরের পর্দা ও ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা বসিয়ে কম্পিউটার স্ক্রিনে পর্যবেক্ষণ করা হয় মা ও শাবকদের চলাফেরা। এতে সফলতা আসে।

পার্কের ভেটেরিনারি সার্জন মো. মোস্তাফিজুর রহমান চকরিয়া নিউজকে বলেন, জন্মের পর থেকে আড়াই মাস পর্যন্ত মায়ের দুধ খেয়ে বেড়ে উঠেছে আঁখি ও নয়ন। এরপর মায়ের সঙ্গে মাংস খাওয়ানোর অভ্যাস করানো হয়। তখন থেকে মাংস খেয়েই বেড়ে উঠছে। বর্তমানে দৈনিক দুই বেলা সাড়ে ৫ কেজি করে মাংস খাচ্ছে তারা।

সাফারি পার্কের কর্মকর্তা মো. মাজহারুল ইসলাম চৌধুরী চকরিয়া নিউজকে বলেন, এই পার্কটি এখন বন্যপ্রাণী প্রজনন কেন্দ্র হিসেবেও গড়ে উঠছে। তিনি বলেন, জন্মের পর শাবক দুটিকে মা জুঁইয়ের সঙ্গে রাখা হয়েছিল। বাবা জয়কে আলাদা বেষ্টনীতে রাখা হয়। এতে জন্মের পর বাবার আক্রোশে পড়তে হয়নি। তবে শাবক দুটির বয়স যখন ছয় মাস পূর্ণ হয়, তখন মায়ের কাছ থেকে আলাদা করে বাঘের বেষ্টনীতে স্থান দেওয়া হয়। প্রজননের জন্য জয়জুঁইকে কয়েকদিনের মধ্যে আবার একই বেষ্টনীতে রাখা হবে।

সাফারি পার্কের তত্ত্বাবধায়ক (রেঞ্জার) কে এম মোর্শেদুল আলম চকরিয়া নিউজকে বলেন, শাবক দুটিকে বাঁচানোর জন্য কড়াকড়ি আরোপ করা হয়। এ কারণে গণমাধ্যমকেও প্রথম দিকে বিষয়টি জানানো হয়নি। ইতোমধ্যে শাবকের বয়স ১৫ মাস পেরিয়েছে। তারা এখন নির্দিষ্ট বেষ্টনীতে খোশমেজাজে খেলছে।

চট্টগ্রাম বন্যপ্রাণী ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা ও বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্কের প্রকল্প পরিচালক মো. গোলাম মওলা গত রাতে চকরিয়া নিউজকে বলেন, জয় ও জুঁইকে ঘিরে আমাদের বৃহৎ পরিকল্পনা রয়েছে। এই জুটিকে ঘিরে নতুন করে প্রজননের জন্য একটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। পার্কে প্রেরণের পর থেকে এই জুটি প্রজননের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। প্রজননের পর যাতে শাবকগুলোকে বাঁচিয়ে রাখা যায়, সেজন্য নতুন শেড নির্মাণ করা হবে। এজন্য মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাবনা পাঠানো হয়েছে। বন ও পরিবেশমন্ত্রী এবং সচিব মহোদয় ইতোমধ্যে পার্ক পরিদর্শন করে গেছেন। তাদের কাছে এসব বিষয় তুলে ধরেছি। এসময় তারা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন বলে জানিয়েছেন।

 

পাঠকের মতামত: