জাবেদ ইকবাল চৌধুরী :: ইয়াবার রাজ্য হিসেবে আলোচিত টেকনাফে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর উপস্থিতিতে গত ১৬ ফেব্রæয়ারি ঘটে গেলো ঐতিহাসিক অনুষ্ঠান। এখানে শতাধিক ইয়াবা কারবারি সরকারের কাছে নতি স্বীকার করলো। কিভাবে এটি বাস্তবতা পেলো এমন প্রশ্ন জনমনে ঘুরপাক খাচ্ছিলো। পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করা ১০২ ইয়াবা কারবাররিদের নিয়ে তৈরী বিশেষ প্রতিবেদনে কি আছে তা নিয়ে চুলচেড়া বিশ্লেষণ চলছে সর্বত্র। গত ১৬ ফেব্রুয়ারি টেকনাফ পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে অনুষ্ঠিত আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে এ প্রতিবেদন কক্সবাজার জেলা পুলিশের পক্ষে পুলিশ সুপার এ বি এম মাসুদ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মো: আসাদুজ্জামান খান কামাল এমপি ও আইজিপি ড. মো: জাবেদ পাটোয়ারীর হাতে হস্তান্তর করেন। এর কিছু কিছু অংশ মঞ্চে ঘোষনাও করেন অনুষ্ঠান সঞালনার দায়িত্বে থাকা পুলিশ কর্মকর্তারা। সরকারের উচ্চ মহলে জেলা পুলিশ কেমন প্রতিবেদন দিয়েছে। সেই প্রতিবেদনে কি রয়েছে তা জানান আগ্রহ রয়েছে দেশ ব্যাপী। এরই কিছু চম্বুক অংশ এখানে তুলে ধরা হয়েছে। তবে উর্দ্ধতন কতৃপক্ষকে দেওয়া প্রতিবেদনের বিষয়ে কোন তথ্য জানা নেই বলে জানান টেকনাফ মডেল থানার পরিদর্শক (তদন্ত) এ বিএমএস দৌহা ।
পারভিটিন, ম্যাড ড্রাগ, ভুলভুলাইয়া, ইয়াবা, বাবা ::
১৯১৯ সালে জাপানীরা জীপন রক্ষাকারী ঔষধ হিসেবে ইয়াবা তৈরীর পরিকল্পনা করে। দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের সময় জার্মান একনায়ক এডলফ হিটলার যুদ্ধক্ষেত্রে সৈন্যদের ক্লান্তি দূর করার জন্য ‘পারভিটিন’ নামে ইয়াবা তৈরী করেন। এ পরভিটিন থাইল্যান্ডে ট্রাক চালকেরা ক্লান্তি দূও করার জন্য ব্যবহার করতে শুরু করে। পরে ১৯৭০ সালে থাই সরকার এর বিক্রয় ও ব্যবহার নিষিদ্ধ ঘোষনা করে। মিয়ানমারের শান প্রদেশের পাহাড়ে ঘোড়াদের খাওয়ানোর জন্য ইয়াবা উৎপাদন করে। যে সব ঘোড়া পাহাড়ে গাড়ী টানতে দূর্বল হতো সেই সব ঘোড়াকে পাগলা করার জন্য বার্মিজরা ইয়াবা তৈরী করতে থাকে। মিয়ানমারের ওয়া এবং কোকাং আধিবাসীরা সবচেয়ে ইয়াবা উৎপাদনকারী সম্প্রদায় বলে প্রতিবেদনে উল্লেক করা হয়। এ ছাড়া বাংলাদেশে পরিচিত ইয়াবা বা বাবা যা থাইল্যান্ডে ম্যাড ড্রাগ, ভারতে ভুলভুলাইয়া নামে পরিচিত হলেও মিয়ানমারে কি নামে পরিচিতি রয়েছে তা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়নি।
বাংলাদেশে ইয়াবার আবির্ভাব ::
বিশেষ প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয় ১৯৯৭ সালে প্রথম বাংলাদেশে ইয়াবার আবির্ভাব ঘটে। পরবর্তীতে ২০০০ সাল হতে ২০০৪ সাল পর্যন্ত ইয়াবা উচ্চ মূল্যেও কারনে বাংলাদেশের উচ্চবিত্তের মাঝেই তুলনামূলকভাবে ইয়াবা হাত বদল হতে থাকে। এরপর বাংলাদেশের গ্রামে গঞ্জে এটি নেশা হিসেবে ব্যাপক পরিচিতি পেতে শুরু করে। এখন এ নেশা উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত, নি¤œবিত্ত ঘরের ছেলে-মেয়ে হতে শুরু করে স্কুল,কলেজে, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, সরকারী-বেসরকারী কর্মকর্তা কর্মচারী, বিভিন্ন পেশাজীবি, গøামার জগতের বাসিন্দা হতে গৃহবধু পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছে।
প্রবেশ রুট ::
১৯৩ কিলোমিটার কক্সবাজার সীমান্তের বিভিন্ন স্থান দিয়ে ইয়াবা আসে । মিয়ানমারের মংডুর সীমান্তবর্তী সিকদার পাড়া, ফয়েজিপাড়া, মগপাড়া, সুদাপাড়া, উকিলপাড়া,গওজিবিল,মাস্টারপাড়া, কাদিরবিল, ধুনাপাড়া, মাংগালাসহ বিভিন্ন এলাকা হতে সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশের টেকনাফ উপজেলার শাহপরীরদ্বীপ, বর্মা পাড়া, নাজির পাড়া, জালিয়াপাড়া, সাবরাং, নাইট্যংপাড়া, চৌধুরী পাড়া,কাটাখালী, উনচিপ্রাং, হোয়াইক্যংঘাট, হ্নীলা জাদিমোড়া, ৩ নং ¯øুইচ গেইট সংলগ্ন ফরায়েজি পাড়া,উকিলপাড়া, বোমপাড়া, আড়াই নং ¯øুইচ গেইট,মৌলভী পাড়া, শিলবনিয়াপাড়া, চকবাজার, অলিয়াবাদ,খানকারপাড়া, ২ নং ¯øুইচ গেইট, পুরাতন ট্রানজিট ঘাট, কুলাল পাড়া , নাইট্যং পাড়া, কেকে খাল, কেরুনতলী, ১৪ নং জাহাজঘাট,খুরের মুখ,নয়াপাড়া,জালিয়াপাড়া, বাহারছড়া ঘাট,রাজারছড়া ঘাট,হেচ্চার খাল, দমদমিয়া,ফুলের ডেইল,কাঞ্জরপাড়া ও তার আশপাশ এলাকা এবং উখিয়া উপজেলার পালংখালী,বালূখালী, ঘুমধুম, রেজুখাল, থাইংখালী ও আশপাশের এলাকা। কক্সবাজার মেরিন ড্রাইভের বিভিন্ন স্থান থেকে সাগর পথে ইয়াবা প্রবেশ করে থাকে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
তবে এখানে শিলবনিয়া পাড়া ও কুলাল পাড়া নাফনদী সীমান্ত দিয়ে বেশ দূরে হওয়ার পরও কেনো মিয়ানমার হতে ইয়াবা প্রবেশের রুট হিসেবে চিহ্নিত হলো তা বোধগম্য নয় সচেতন মহলের কাছে।
পাচার পদ্ধতি ::
বঙ্গোপসাগর থেকে শুরু করে নৌ , আকাশ ও স্থল পথ দিয়ে দেশে থেকে দেশে ও বিভিন্ন জেলায় ভিন্ন ভিন্ন পদ্ধতিতে ইয়াবা পাচার করে থাকে। মিযানমারের আকিয়াব, চকপ্রæ, তমব্রæ এবং ইয়াঙ্গুন হতে ইয়াবা বানিজ্যিক পন্যবাহী বোটে কাঠ,আচার, শুটকি ও মাছের সাথে প্রথমে টেকনাফ স্থল বন্দরে প্রবেশ করে। পরে পন্যবাহী যানবাহনে কক্সবাজার হয়ে চট্টগ্রাম, ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে পাচার হয়ে থাকে। তবে এ প্রতিবেদনে এখানে উল্লেখ করা হয়নি, মিয়ানমার হতে চোরাই পথে আনা শাহপরীরদ্বীপ গবাধিপশুর করিডোরে আসা বোটের কথা।
মিযানমারের পাচারকারীচক্র তাদের বোটে সেন্টামার্টিনের পশ্চিমে সীতাদ্বীপ নামক সমুদ্র পথে তাদের জল সীমায় অবস্থান করে। পরে বাংলাদেশী ইয়াবা পাচারকারীরা ফিশিং বোটে করে আইনশৃংখলা বাহিনীর চোখ ফাকিঁ দিয়ে স্থলে ভাগে নিয়ে আসে । কিন্তু অনুসন্ধানে জানা যায়,
সীতাদ্বীপ বা সীতা-লক্ষী নামক স্থানটি সেন্টমার্টিন্সের দক্ষিণ-পূর্বে বঙ্গোপাগরের মিয়ানমার সৈকত অংশ। আর সেন্টমার্টিন্সের পশ্চিমে হলে তা হবে বাংলাদেশ অংশ ।
বাংলাদেশী ইয়াবা কারবারীরা ট্রাক,পিকআপ,বাস,মাইক্রোবাস, প্রাইভেটকারসহ বিভিন্ন যানবাহনের ভেতরে বিশেষ কৌশলে দেশের অভ্যান্তরে পাচার করে থাকে। এ ছাড়া বিশেষ কায়দায় লুকিয়ে মানুষ মলদ্বার , পাকস্থলী ও মেয়েরা গোপনাঙ্গে পাচারে নিযোজিত থাকে। তা ছাড়া গরু ছাগল গরু ও মাছের পেটে ঢুকিয়ে বা লবন, পান সুপারি ইত্যাদি পণ্যের ভেতরে কওে পাচারকারীরা ইয়াবা পাচার করে থাকে। ইয়ানিং রোহিঙ্গাদের মাধ্যমে ৫ থেকে ২০ হাজার পরিমান ইয়াবা ট্যবলেট জেলার উখিযা টেকনাফ এলাকা দিয়ে প্রবেশ করে দেশের বিভিন্ন স্থানে পাচার আশংকা জনক ভাবে বেড়ে গেছে বলেও উল্লেখ করা হয় বিশেষ প্রতিবেদনে।
৫ বছরে কক্সবাজারে ৩ কোটি ৭০ লাখ উদ্ধার ::
২০১৪ সাল হতে ২০১৮ সাল পর্যন্ত বিগত ৫ বছরে শুধু কক্সবাজার জেলায় ৩ কোটি ৭০ লাখ ৩ হাজার ৬৯০ পিচ ইয়াবা উদ্ধার করেছে আইনশৃংখলা বাহিনী। যা সারা দেশের ইয়াবা উদ্ধারের কিয়দাংশ। এ সময়ে অন্যান্য মাদকের মধ্যে গাজাঁ , দেশী মদ, বিয়ার, ফেন্সিডিল, হেরোইন উদ্ধারও উল্লেখযোগ্য।
এর মধ্যে গত ২০১৪ সালে ১৭ লাখ ৬৯ হাজার ৫৩১ পিচ ইয়াবা উদ্ধার হয়েছে। ১ হাজার ৪২ টি মাদকের মামলায় ১ হাজার ৫৮৫ জন এজাহার নামীয় আসামি রয়েছে। ১ হাজার ৩৬২ জন আসামী আটক করা হয়। ওই সময়ে ৯ জন আসামীর বিভিন্ন মেয়াদে সাজা হয়েছে।
২০১৫ সালে ৪০ লাখ ৭১ হাজার ৮৫০ পিচ ইয়াবা উদ্ধার হয়েছে। ৮৬৮ টি মাদকের মামলায় আসামী করা হয়েছে ১ হাজার ২২৫ জনকে। গ্রেফতার করা হয় ১ হাজার ৭৬ জনকে। ওই সময়ে ২৪ জনের বিভিন্ন মেয়াদে সাজা হয়।
২০১৬ সালে ৩৪ লাখ ৭৬ হাজার ৫১১ পিচ ইয়াবা উদ্ধার হয়। ৬৬৯ টি মাদকের মামলায় ১ হাজার ৮৮ জনকে আসামী করা হয়। ৯৯০ জনকে আটক করা হয়। ১৯ জনের বিরুদ্ধে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা হয়।
২০১৭ সালে ৮৫ লাখ ৮১ হাজার ৯৬৬ পিচ ইয়াবা উদ্ধার হয়।
১ হাজার ৬৮৮ টি মাদকের মামলায় ২ হাজার ৪১৮ জনকে আসামী করা হয়। আটক করা হয় ১ হাজার ৯৮৯ জনকে। বিভিন্ন মেয়াদে সাজা হয় ৩০ জনের।
২০১৮ সালে উদ্ধার করা হয় ১ কোটি ২৮ লাখ ৩ হাজার ৮৩২ পিচ ইয়াবা। ১ হাজার ৮২৪ টি মামলায় ২ হাজার ৭০০ জন আসামী করা হয়। এ সময় ২ হাজার ১৭০ জন কে আটক করা হয়। বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেওয়া হয় ৫১ জনকে।
এখানে উল্লেখ্য গত ২০১৮ সালের ১৮ সেপ্টেম্বরে কক্সবাজার জেলা পুলিশ সুপার হিসেবে পদায়ন হন এ বি এম মাসুদ হোসেন। তিনি দায়িত্বভার গ্রহন হওয়ার পর হতে গত ১০ ফেব্রæয়ারি পর্যন্ত কক্সবাজারে বন্দুক যদ্ধে মারা যায় ৪৪ জন ইয়াবা কারবারী। উদ্ধার করা হয় ১২ লাখ ৩ হাজার ৫৯০ পিচ ইয়াবা। মাদক সংক্রান্ত ৭৩৯ টি মামলায় এজাহার নামীয় আসামী করা হয় ১ হাজার ১২৫ জন। এ সময়ে গ্রেফতার করা হয় এক হাজার ২ জন আসামীকে।
আত্বসমর্পনের পেক্ষাপট ::
গত ২০১৮ সালের ১৭ মে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মাদক প্রতিরোধে জিরো টলারেন্স নীতি ও বিশেষ অভিযান পরিচালনার কথা ঘোষনা দেন। এর পর হতে আইনশৃংখলা বাহিনী মাদক প্রতিরোধে তৎপরতা বৃদ্ধি করে। কক্সবাজার জেলায় আইনশৃংখলা বাহিনীর হাতে শত শত মাদক কারবারী আটক হতে থাকে। উদ্ধার হতে থাকে ইয়াবা ও অবৈধ অস্ত্র। নিজেরদের মধ্যে ও আইনশৃংখলা বাহিনীর হাতে এর পর বন্দুক যুদ্ধে মারা যায় ৫৩ জন। টেকনাফের বিভিন্ন প্রাসাদতুল্য বাড়ী ঘরে চলে ভাংচুর। ইয়াবা পরিবহনে ব্যবহার হওয়া নৌ-যানে লাগে আগুন। এমন পরিস্থিতিতে চিহ্নিত ইয়াবা কারবারীরা এলাকা ছেড়ে অন্যত্র পালাতে থাকে। তাদের বাড়ী ঘরে লোকবল শুণ্য হয়ে পড়ে। এক পর্যায়ে অনেকে ইয়াবা কারবারী নিজের প্রাণ বাচাতেঁ সচেষ্ঠ হয়। আত্মসমর্পনের পথ খুজঁতে থাকে। একটি বেসরকারী টিভি চ্যানেলের প্রতিনিধির মাধ্যমে কক্সবাজার পুলিশ সুপার বরাবরে তাদের আত্মসমর্পনের বার্তা পৌঁছানো হয়। সরকারের উচ্চ মহলও মাদক প্রতিরোধে ৯ টি শর্তের আলোকে তাতে সম্মতি প্রদান করেন। এ ধরনের আত্মসমর্পন ইতিমধ্যে কক্সবাজারের মহেমখালী, কুতুবদিয়া এলাকার ৪৩ জন জলদস্যূ ও খুলনার সুন্দরবনের বন দস্যূ র্যাবের নিকট , বরিশালে কিছু মাদক ব্যবসায়ী ও মাদকসেবী পুলিশের নিকট আত্মসমর্পণ করে। এর সুত্র ধরে কক্সবাজারেও ১০২ জন তালিকাভূক্ত মাদক ব্যবসায়ী, পৃষ্ঠপোষক, গডফাদার ও মাদক চোরাকারবারী ১৬ ফেব্রæয়ারি আত্মসমর্পন করে।
যে ৯ শর্তে আত্মসমর্পন ::
ইয়াবা কারবারিদের মূলত ৯ সটি শর্তে চিহ্নিত ইয়াবা কারবারি, পৃষ্ঠপোষক ও গডফাদাররা পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করেছেন। এ গুলো হচ্ছে।
১, আত্মসমর্পণকারী মাদক কারবারিরা এই ঘৃণ্য মাদক ব্যবসা ছেড়ে আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে সমাজে সুস্থ- সুন্দর ও স্বাভাবিক জীবন যাপন করবে।
২, ভবিষ্যতে তারা মাদক সংক্রান্ত কোন অপরাধে জড়িত হবে না।
৩, সমাজে ফিরে গিয়ে এলাকাকে মাদকমুক্ত রাখার জন্য বিশেষ ভূমিকা পালন করবেন।
৪, তাদেও স্ব স্ব এলাকা মাদক মুক্ত করার লক্ষ্যে এলাকা ভিত্তিক মাদক বিরোধী কমিটি গঠন এবং আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীকে মাদক ব্যবসা সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য প্রদানসহ সার্বিক সহযোগীতা প্রদান করবে।
৫, যেসব মাদক কারবারি এখনো ব্যবসা অব্যাহত রেখেছেন এবং ব্যবসায় সক্রিয় আছেন তাদের তথ্য কক্সবাজার জেলা পুলিশের কাছে সরবরাহ করবেন।
৬. আত্মসমর্পণের আগে তাদের বিরুদ্ধে যে সকল মামলা রুজু হয়েছে বা বিজ্ঞ আদালতে বিচারাধীন আছে এসব মামলাগুলো তারা নিজ দায়িত্বে আইনগতভাবে মোকাবেলা করবেন।
৭. আত্মসমর্পণকারী মাদক কারবারিদের হেফাজতে যে সকল মাদকদ্রব্য, অবৈধ অস্ত্র রয়েছে অত্মসমর্পণের সময় এসব মাদকদ্রব্য ও অস্ত্র পুলিশের কাছে হস্তান্তর করবেন।
৮. আত্মসমর্পণ প্রক্রিয়ায় তাদের বিরুদ্ধে যেসব মামলা রুজু করা হবে সরকারি অনুমতি সাপেক্ষে সেসব মামলায় তাদের আইনগত সুবিধা প্রদানের বিষয়টি বিবেচনা করা হবে।
৯ . মাদক ব্যবসার মাধ্যমে নিজে/পরিবারের/আত্মীয় স্বজনের নামে ও বেনামে অর্জিত সকল স্থাবর/অস্থাবর সম্পত্তি যাচাইয়ের জন্য দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), সিআইডি (মানিলন্ডারিং শাখা), এনবিআরসহ সংশ্লিষ্ঠ সরকারি সকল সংস্থার কাছে তাদের তথ্যাদি প্রেরণ করা হবে এবং সংশ্লিষ্ট এসব সংস্থার মাধ্যমে তাদের অর্জিত সকল স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি যাচাই সাপেক্ষে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
যা বলেছেন তারা
জিজ্ঞাসাবাদে আত্মসমর্পণে যাওয়া ইয়াবা কারবারীরা যা বলেছেন তা হলো। তারা অতীতে ভুল করেছেন। লোভের বশবর্তী হয়ে আর্থিকভাবে অধিক সচ্চল হওয়ার প্রয়াসে ইয়াবা ব্যবসায় সম্পৃক্ত হন তারা। তারা এখনো যারা ইয়াবা ব্যবসায় সক্রিয় রয়েছেন তাদের নাম, ব্যবসা বন্ধে করণীয় এবং বিভিন্ন বাহিনীর ভূমিকা সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছেন। যা যাছাই বাছায়ের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। এ ছাড়া এসব কারবারীরা আরো জানান, মিয়ানমারের নাগরিকরা আগে অর্থ ছাড়াই ইয়াবা পাঠিয়ে দেয়। পরে তা দেশে পাচার করে পাওয়া অর্থ বিভিন্ন মাধ্যমে মিয়ানমারেরর কারবারীদের কাছে পৌছেঁ দেওয়া হয়। তারা হুন্ডি চক্রের বেশ কিছু তথ্য দিয়েছে যা তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে।
ইয়াবা ব্যবসায়ী সংক্রান্ত পরিসংখ্যান ::
বিভিন্ন সময়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয়, পুলিশ হেডকোয়ার্টার্স, স্পেশাল ব্রাঞ্চ ইয়াবা ব্যবসায়ী হিসেবে তালিকা তৈরী করে। যে সকল তালিকা কক্সবাজার পুলিশের নিকট গৃহিত হয়েছে তা হলো।
প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের ২০১৭ সালের ১৬ জানুয়ারি তারিখের স্বারক নং-০৩.০৭৯.০১৬.০৪.০০.২২.২০১৬-৮১ মূলে কক্সবাজার জেলায় ১১৫৮ জন মাদক ব্যবসায়ী এবং ৮২ জন পৃষ্টপোষকদের নামের তালিকা প্রকাশ করে।
প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের ২০১৮ সালের ১৮ মে তারিখের স্বারক নং-০৩.০৭৯.০১৬.০৪.০০.০২১.২০১৬-৫২৭(২) মূলে মাদক কারবারী হিসেবে ৭৩ জনের তালিকা প্রকাশ করে। এ ছাড়া কক্সবাজার জেলা বিশেষ শাখা ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রæয়ারি স্বারক নং- ১২৮৬/৮২-২০০০(মাদকদ্রব্য) মূলে স্পেশাল ব্রাঞ্চ ঢাকা বরাবরে ১১৮১ জনের তালিকা প্রেরণ করে। তবে এসব তালিকায় অনেক মাদক গড ফাদারসহ মাদক কারবারীর নাম যেমন যুক্ত হয়নি তেমনি কিছু কিছু মাদকের সাথে জড়িত নয় এমন ব্যাক্তির নাম তালিকা ভূক্ত হয়েছে বলে টেকনাফ উপজেলা মাসিক আইনশৃংখলা কমিটির সভায় বক্তব্য এসেছে। আত্মসমর্পণ করা পাচারকারীদের দেয়া তথ্য হতে তদন্ত সাপেক্ষে এসব তালিকা হালনাগাদ করা প্রয়োজন বলে দাবী করেছে সাবেক সংসদ সদস্য ও টেকনাফ উপজেলা আওয়ামীলীগ সভাপতি অধ্যাপক মোহাম্মদ আলী।
ইয়াবা কারবার বন্ধে সুপারিশ ::
আত্মসমর্পণকৃত ইয়াবা ব্যবসায়ীদের নিকট জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্য ও সার্বিক পরিবেশ পরিস্থিতির আলোকে ইয়াবা পাচার রোধে কিছু সুপারিশ বাস্তবায়ন করা যেতে পারে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
সরকারের উর্দ্ধতন কতৃপক্ষ বরাবরে কক্সবাজার জেলা পুলিশের প্রেরণ করা সুপারিশ তুলে ধরা হয়েছে। সুপারিশ সমুহ হচ্ছে, মাদকের কিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতিতে সকল বাহিনীর কাজের মধ্যে সমন্বয় সাধন করা, সমুদ্র ও নৌ পথে টহলররত কোস্টগার্ড, সীমান্তে বিজিবি এবং স্থলভাগে আইনশৃংখলা রক্ষায় নিয়োজিত পুলিশ, র্যাবকে সততা, আন্তরিকতা ও নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালন করতে হবে, কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলার বালূখালী থেকে টেকনাফের শাহপরীরদ্বীপ পর্যন্ত মাঝে মাঝে গেইট রেখে কাটা তারের বেড়া দিয়ে বেষ্টনী তৈরী করা, সেন্টমার্টিনের দক্ষিনে সমুদ্রে মৌলভীরশীল নামক মিয়ানমার সীমান্ত হতে জনসীমার পশ্চিমে বিশ বাম নামক স্থান সমুদ্রে নৌ –বাহিনীর সর্তক পাহারা নিশ্চিত করা, অভিযোগ রয়েছে সীমান্তে মিয়ানমারের বর্ডার গার্ড পুলিশ (বিজিপি) ইয়াবা পাচারে সহায়তা করে থাকে। এ অবৈধ কাজ হতে তাদের বিরত রাখতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা, টেকনাফ ও উখিয়া উপজেলার সকল স্থরের জনপ্রতিনিধিদের ইয়াবা বন্ধে সক্রিয় ভূমিকা রাখা, আত্মসমর্পণকারী ইয়াবা ব্যবসায়ীদের সাথে নিয়ে এলাকা ভিত্তিক মাদক বিরোধী কমিটি গঠন করে তাদের কাজে লাগানো, তালিকাভুক্ত মাদক কারবারীদের তালিকা দুর্নীতি দমন কমিশনসহ সংশ্লিষ্ঠ সকল সংস্থার নিকট পাঠানো, তাদের স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তির অনুসন্ধান পূর্বক ব্যবস্থা নেওয়া, শাহপরীরদ্বীপ হতে মনখালী পর্যন্ত ইয়াবা পাচারের প্রধান রুট হিসেবে পরিচিত। এ এলাকার নৌ-পথে কোস্টগার্ড এবং সীমান্ত পথে বিজিবির মাধ্যমে সর্তক অবস্থান নিশ্চিত করা, সকল বিজিবি ক্যাম্পের সদস্যদেরকে একমাস অন্তর অন্তর বদলীর ব্যবস্থা করা, কক্সবাজার জেলায় কর্মরত যে সকল পুলিশ সদস্য একাধিকবার পদায়ন হয়েছে এবং কথিত মাদক ব্যবসায়ীদের সাথে যোগাযোগকারী পুলিশ সদস্যদের অন্যত্র বদলীর ব্যবস্থা করা, ইয়াবা বিস্তার রোধকল্পে ভালো কাজের জন্য আইনশৃংখলা বাহিনীর সদস্যদের প্রনোদনা বা পুরস্কার এবং খারাপ কাজে জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা, সীমান্ত এলাকায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা রোহিঙ্গাদের উচ্ছেদ করে ক্যাম্পে প্রেরণ করা, ক্যাম্প হতে বের হযে যাতে ইয়াবা পাচারে জড়িত হতে না পারে সেই জন্য রোহিঙ্গা ক্যাম্প এলাকায় কাটা তারের বেড়া বা নিরাপত্তা বেষ্টনী তৈরী করা এবং সর্বোপরি সীমান্ত এলাকায় পুলিশ, বিজিবি,র্যাব সমন্বয়ে যৌথ টহলের ব্যবস্থা করার কথা উল্লেখ করা হয়। তবে গোটা প্রতিবেদনের কোথাও স্বরাস্ট্র মন্ত্রনালয়ের অধিনস্থ মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের (ডিএনসি) কর্মকান্ড নিয়ে ইতিবাচক বা নেতিবাচক মন্তব্য উল্লেক করা হয়নি।
পাঠকের মতামত: