ঢাকা,রোববার, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪

 উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ শেষ পর্যায়ে

বদলে যাচ্ছে কক্সবাজার

প্রতীকী ছবি
কক্সবাজার প্রতিনিধি ::
বিভিন্ন মেগা প্রকল্পের কারণে নবরূপ পেতে যাচ্ছে পর্যটনের রাজধানীখ্যাত সমুদ্রশহর কক্সবাজার। এসব মেগা প্রকল্পের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো– বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব স্থলভিত্তিক এলএনজি টার্মিনাল, সামুদ্রিক মৎস্য ও প্রযুক্তিকেন্দ্র, মেরিন অ্যাকুয়ারিয়াম স্থাপন, ইনস্টলেশন অব সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং (এসপিএম) উইথ ডাবল পাইপলাইন, মাতারবাড়ী বন্দর উন্নয়ন প্রকল্প, দোহাজারী থেকে রামু হয়ে কক্সবাজার পর্যন্ত রেলপথ, আইকনিক রেল স্টেশন, রামু থেকে ঘুমধুম সীমান্ত পর্যন্ত সিঙ্গেল লাইন ডুয়েলগেজ রেল ট্র্যাক নির্মাণ, মাতারবাড়ী ২৬০০ মেগাওয়াট আলট্রা সুপারক্রিটিক্যাল কোল ফায়ার্ড পাওয়ার প্রজেক্ট কক্সবাজার বিমানবন্দর উন্নয়ন প্রকল্প ও খুরুশকুল বিশেষ আশ্রয়ণ প্রকল্প।

এ ছাড়া গোটা জেলায় আরও বেশ কয়েকটি ছোট-বড় উন্নয়ন প্রকল্পের বাস্তবায়ন চলছে। সংশ্লিষ্টদের আশা, প্রকল্পগুলো শেষ হলে শুধু কক্সবাজার শহর নয়; বরং গোটা জেলার আর্থসামাজিক অবস্থার আমূল পরিবর্তন হবে। সেই সঙ্গে আরও বিকশিত হবে পর্যটন খাতের অপার সম্ভাবনা।

সম্প্রতি কক্সবাজারের বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প ঘুরে দেখা গেছে, সেগুলোর কাজ প্রায় শেষ পর্যায়। আগামী সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বরের শুরুর দিকে বেশির ভাগ প্রকল্পের উদ্বোধন হবে। সে লক্ষ্যে এখন পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ করছেন প্রকল্প-সংশ্লিষ্টরা। জেলা প্রশাসনও কাজগুলো তদারকি করছে।

এসপিএম প্রকল্পে জ্বালানি খাতে সাশ্রয় হবে ৮০০ কোটি টাকা

মহেশখালীতে প্রায় ৯০ একর জায়গার ওপর নির্মাণ চলছে এসপিএম উইথ ডাবল পাইপলাইন প্রকল্পের। বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যে জিটুজি ভিত্তিতে বাস্তবায়নাধীন এ প্রকল্পে জাহাজ থেকে সরাসরি অফশোর পাইপলাইনের মাধ্যমে মাতারবাড়ী এলটিই (ল্যান্ড টার্মিনাল এন্ড) পর্যন্ত এবং সেখান থেকে অনশোর পাইপলাইনের মাধ্যমে মহেশখালী এলাকায় স্থাপিত স্টোরেজ ট্যাঙ্কারে জমা হবে তেল।

এর আওতায় এরই মধ্যে ২২০ কিলোমিটার পাইপলাইন স্থাপনের পাশাপাশি তৈরি করা হয়েছে ছয়টি বিশালাকার স্টোরেজ ট্যাঙ্ক, যা দেশের তেল মজুত সক্ষমতাকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাবে বলে আশা করা হচ্ছে। প্রকল্প কর্মকর্তারা জানান, এসপিএম পাইপলাইন চালু হলে তেল পরিবহনে ১১ দিনের কাজ মাত্র ৪৮ ঘণ্টায় করা সম্ভব হবে। এতে প্রতিবছর দেশের সাশ্রয় হবে ৮০০ কোটি টাকা। প্রকল্পের কাজ ৯৭ শতাংশ সম্পন্ন হয়েছে। প্রকল্পের ভৌত অবকাঠামো নির্মাণ শেষ, এখন চূড়ান্ত পর্যায়ের কাজ চলছে। উদ্বোধনের পর চলতি বছরের শেষ দিকে বাণিজ্যিক কার্যক্রম শুরু হবে।

এসপিএম নির্মাণের পাশাপাশি মাতারবাড়ী উপকূলে ৫০ হাজার টন ধারণ ক্ষমতার তিনটি ক্রুড অয়েল স্টোরেজ ট্যাঙ্ক, ৩০ হাজার টন ধারণ ক্ষমতার তিনটি ডিজেল স্টোরেজ ট্যাঙ্ক এবং মহেশখালীতে পাম্প স্টেশন স্থাপন, স্কাডা সিস্টেম স্থাপন ও ফায়ার ফাইটিং সিস্টেম তৈরি করা হয়েছে।

ডিসেম্বরেই জাতীয় গ্রিডে যোগ হবে মাতারবাড়ীর বিদ্যুৎ

মাতারবাড়ীতে নির্মাণাধীন কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে আগামী ডিসেম্বরে জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হবে ৬০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। এ ছাড়া এর দ্বিতীয় ইউনিট থেকে আরও ৬০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আসবে ২০২৪ সালের জুলাইয়ে। কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, পোর্ট ও ভৌত অবকাঠামোর কাজ ৯৫ শতাংশ সম্পন্ন হয়েছে। সার্বিক ভৌত অবকাঠামোর কাজ হয়েছে ৯০ শতাংশ। প্রকল্পের নির্বাহী পরিচালক নাজমুল হক বলেন, পরিবেশ দূষণ রোধে প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা নিশ্চিত করে এ বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাজ করা হচ্ছে। জাহাজ থেকে কয়লা নামানোর সময় মাত্র একবার ওই কয়লা দেখা যাবে। তার পর ওই কয়লা সরাসরি চলে যাবে জেটি থেকে প্লান্টে। এতে পরিবেশ দূষিত হবে না।

এ ছাড়া মাতারবাড়ীতে ১৮.৫ মিটার গভীরতার বন্দর নির্মাণের কাজ করছে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ, যা চালু হলে শুধু দেশের আমদানি-রপ্তানি গতিশীল হবে তা নয়, এ বন্দর আন্তর্জাতিক বাণিজ্যকেন্দ্রে পরিণত হবে বলে আশা সংশ্লিষ্টদের।

প্রথম ট্রেন চলবে কক্সবাজারে

কক্সবাজারে ঝিনুকের আদলে তৈরি হচ্ছে দেশের প্রথম আইকনিক রেলস্টেশন। গোটা প্রকল্পের কাজ শেষ হলে প্রথম রাজধানী থেকে চট্টগ্রাম হয়ে ট্রেন যাবে সমুদ্রনগরী কক্সবাজারে। এ মাসেই ঢাকা-কক্সবাজার রেলপথে ট্রেনের প্রথম ট্রায়াল রান হওয়ার কথা আছে। দোহাজারী-কক্সবাজার রেললাইন প্রকল্পের অতিরিক্ত পরিচালক আবুল কালাম চৌধুরী বলেন, ‘এই প্রকল্পের ৮৬ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। সামান্য কিছু কাজ বাকি। সেপ্টেম্বরের ১৫ থেকে ৩০ তারিখের মধ্যে ঢাকা থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত ট্রেনের একটি ট্রায়াল রানের চেষ্টা করব।’

একইভাবে বাস্তবায়ন চলছে দোহাজারী থেকে রামু হয়ে কক্সবাজার এবং রামু থেকে ঘুমধুম পর্যন্ত সিঙ্গেল লাইন ডুয়লেগেজ রেল ট্র্যাক নির্মাণের, যা শেষ হবে ২০২৪ সালের জুনে। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে ব্যয় হচ্ছে ১৮ হাজার কোটি টাকার বেশি।

সাগরের ওপরেই যেন নামবে বিমান

অত্যাধুনিক প্রযুক্তির সাহায্যে সাগরের ওপর রানওয়ে নির্মিত হচ্ছে কক্সবাজার বিমানবন্দরে, যার কাজ প্রায় শেষের পথে। আগামী বছরের মাঝামাঝি সময়ে এই রানওয়েতে সুপরিসর আন্তর্জাতিক বিমান ওঠানামা করতে পারবে বলে জানিয়েছেন প্রকল্প-সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, এই রানওয়ে নির্মাণ শেষ হলে বিমান অবতরণের সময় যাত্রীদের মনে হবে, যেন সাগরেই নামতে যাচ্ছেন তারা। ইতোমধ্যে প্রকল্পের ৮০ ভাগ কাজ শেষ। উড়োজাহাজ রিফুয়েলিংয়ের জন্য এখন সবাই দুবাইকে গেটওয়ে হিসেবে ব্যবহার করে। আগামীতে কক্সবাজার বিমানবন্দর আন্তর্জাতিক আকাশপথের রিফুয়েলিং হাব হবে বলে আশা সবার।

অত্যাধুনিক আশ্রয়ণ প্রকল্প

জলবায়ু উদ্বাস্তু ভূমিহীন-গৃহহীন-ছিন্নমূল মানুষের পুনর্বাসনে ২০১৪-১৫ অর্থবছরে খুরুশকুল বিশেষ আশ্রয়ণ প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। এ প্রকল্পের আওতায় পাঁচ তলা বিশিষ্ট ১৩৯টি বহুতল ভবন নির্মাণ করে ৪ হাজার ৪০৯টি জলবায়ু উদ্বাস্তু পরিবারকে পুনর্বাসন করা হবে। এটি হবে বিশ্বের বৃহত্তম জলবায়ু উদ্বাস্তু পুনর্বাসন প্রকল্প। এই আশ্রয়ণ প্রকল্পে নাগরিক সব সুবিধা বিদ্যমান থাকবে।

কক্সবাজার জেলা প্রশাসক মুহম্মদ শাহীন ইমরান বলেন, ভৌগোলিক অবস্থানগত সুবিধার অপার সম্ভাবনাকে কাজে লাগানো এবং পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে উন্নত কক্সবাজার গড়তে সরকার অগ্রাধিকার ভিত্তিতে অনেক প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। এগুলোর কাজ শেষে হলে কক্সবাজারে বেশ কয়েকটি বাণিজ্যকেন্দ্র তৈরি হবে। ফলে গোটা কক্সবাজার বদলে যাবে।

কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান কমডোর মোহাম্মদ নুরুল আবছার বলেন, বেশ কয়েকটি মেগা প্রকল্প এখানে বাস্তবায়ন হচ্ছে। আমাদের লক্ষ্য, বিভিন্ন উন্নত শহরের আদলে কক্সবাজারকে গড়ে তোলা।

কক্সবাজার-২ আসনের এমপি আশেক উল্লাহ রফিক বলেন, এই অঞ্চলের মানুষ প্রতিনিয়ত প্রকৃতির সঙ্গে যুদ্ধ করে বসবাস করে। এ ছাড়া প্রাকৃতিকভাবে কক্সবাজার সম্পদে পরিপূর্ণ। এসব প্রকল্পের মাধ্যমে এখানকার মানুষের অর্থনৈতিক সক্ষমতা আগামীতে অনেক গুণ বৃদ্ধি পাবে। এসব প্রকল্প স্থানীয় মানুষ খুশি মনে গ্রহণ করেছে।

পাঠকের মতামত: