ঢাকা,মঙ্গলবার, ১২ নভেম্বর ২০২৪

বদরখালীতে রেড ক্রিসেন্ট ভার্চু স্কুলে সন্ত্রাসীদের হামলা

নিজস্ব প্রতিবেদক, চকরিয়া ::

কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলার বদরখালীর ৪ নম্বর ওয়ার্ডে নিজের শিক্ষাবঞ্চিত অবহেলিত গ্রামে শিক্ষার আলো ছড়াতে গিয়ে হামলার শিকার হলেন দৈনিক মানবজমিনের স্টাফ রিপোর্টার মহিউদ্দিন অদুল। তিনি অল্পের জন্য প্রাণে রক্ষা পেলেও তাদের গড়া প্রতিষ্ঠান ভার্চু স্কুল অ্যান্ড কলেজে সশস্ত্র হামলায় শিক্ষক, শিক্ষার্থী, কর্মচারি ও শ্রমিকসহ অন্তত ১২ জন আহত হয়েছে। স্কুলে ভাঙ্গচুর চালানো হয়েছে। লুটপাট করা হয়েছে কয়েকলাখ টাকার জিনিসপত্র। গত রোববার বিকালে স্কুল চলাকালে স্থানীয় কয়েকটি স্বার্থান্বেষী পরিবারের সদস্যরা এ সন্ত্রাসী হামলা, ভাঙ্গচুর ও লুটপাট চালায়।

হামলায় আহতদের মধ্যে স্কুলের ভারপ্রাপ্ত কো-অর্ডিনেটর মাস্টার নুরুন্নবী, স্কুলের শিক্ষক একরাম মিয়া (২৮), খ্রিশ্চিয়ান যিহিষ্কেল মন্ডল বিপ্লব (৩৫), নাহিদা সুলতানা (৩০), স্মৃতি আফনানা লাকী (২৬), মো. রাসেল (২২) এবং স্কুলের ছাত্র তুহিন (১২), আমিনুল হক রানা (১৫), ইয়াহিয়া (১৪) ও শ্রমিক জামাল উদ্দীন মনু (৪৫) চকরিয়া স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা গ্রহণ করেন।

এ নিয়ে গত ১২ দিনে পাশের স্বার্থান্বেষীদের হাতে দু’বার হামলার শিকার হল রেড ক্রিসেন্ট কর্মকর্তা ও ২০১৭ সালে প্রতিষ্ঠিত স্কুলটি। রবিবার সন্ত্রাসীরা দু’কিলোমিটার দুরে বদরখালী বাজারে দা, কিরিচসহ সংগঠিত হয়ে প্রকাশ্য মহড়া দিয়ে গিয়ে এবং উশৃঙ্খল নারীরা পাশের ঘর থেকে বের হয়ে এই হামলা চালায়। হামলা ও চক্রান্তকারীরা হল, স্কুল সংলগ্ন ঠুটিয়াখালী ও খালকাঁচাপাড়ার বাসিন্দা, আশরাফ আলী (৫২), নুরুল হুদা বদ (৪৫), জয়তুন্নাহার মানু (৩২), মো. ইসমাইল (৩০), মো. ইউসুফ, নুরুন্নবী (৫৫), মাওলানা আবদুল মন্নান (৭০), মো. জাহাঙ্গীর (৩২), জিয়াসমিন (২৮), মো. আলমগীর (২৯), মিনা আক্তার (২৮), রফিক উদ্দিন মাঝি (৩২), ছৈয়দ নুর-১ (৪০), হাছিনা বেগম (৪৩), শহর আলী (৪৫), রেহেনা বেগম (৩৫), রুনা আক্তার (৩০), মৃত আব্দুল মজিদের ছেলে ছৈয়দ নুর (৫০), মোজাফ্ফর আহামদ (৪৫) ও আবদুল মন্নানসহ (২৩) অর্ধশতাধিক লোক।

সরেজমিনে পরিদর্শন, রেড ক্রিসেন্ট ও স্কুল সূত্রে জানা যায়, দৈনিক মানবজমিনের প্রধান কার্যালয়ের স্টাফ রিপোর্টার মহিউদ্দিন অদুলের ৬ ভাইই চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয় থেকে কৃতীত্বের সঙ্গে উচ্চ শিক্ষা অর্জন করে স্ব স্ব কর্মক্ষেত্রে সুপ্রতিষ্ঠিত। তারা এলাকার বাইরে থাকেন। কিন্তু তাদের গ্রামটি খালকাচা ও ঠুটিয়াখালীপাড়া দরিদ্রপীড়িত ও শিক্ষাবঞ্চিত। তাই নিজ গ্রামে একটি স্কুল অ্যান্ড কলেজ স্থাপনের উদ্যোগ নেন। ওই এলাকায় বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির (বিডিআরসিএস) একটি আশ্রয়কেন্দ্র কাম স্কুল ভবন, কেল্লা ও পুকুর রয়েছে। ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়ের পর ১৯৯৬ সালে তা স্থাপিত হয়। কিন্তু এরপর ২০ বছর ধরে সেখানে কার্যকর কোন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ার উদ্যোগ কেউ না নেওয়ায় ভবন, কেল্লা ও পুকুর অবহেলিত অবস্থায় পড়ে থাকে। ভবনটির প্রায় সব আসবাবপত্র, সৌর প্যানেল, ব্যাটারি, বৈদ্যুতিক তার, দরজা-জানালা,

প্রধান ফটকসহ মূল্যবান জিনিসপত্র চুরি হয়ে যায়। ভবনটি মল-মূত্র, গরু-ছাগলের বিষ্ঠায় অপরিচ্ছন্ন ময়লা-আবর্জনার ভাগাড়ে পরিণত হওয়ায় দুর্যোগে দুর্গতদের অবস্থানের পরিবেশই নষ্ট হয়ে যায়। নানা অসামাজিক কার্যকলাপ, নেশার আড্ডা ও অপরাধের আখড়ায় পরিণত হয়। সেখানে খুন হয় একব্যক্তি। তাছাড়া সংলগ্ন কিছু পরিবার সেখান থেকে মাটি লুট করে তাদের বসত ও দোকানভিটা ভরাট, রাস্তার ইট চুরি, ধানমাড়াইয়ের জন্য উপরিভাগ ছেঁটে ফেলা, গোবর শুকাতে দেয়া, অবৈধ অনুপ্রবেশ ও হাঁটাচলায় দূর্যোগে জীবনরক্ষাকারী কেল্লাটিকে মারাত্মকভাবে ক্ষতি সাধন করে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিয়েছে। কেল্লার উপরিভাগ প্রায় ৫ ফুট নিচু ও চারপাশে অর্ধেক ছোট হয়ে গেছে। এমনকি পাশে কলেজ ভবন ও মাঠের জন্য কেনা জমির মাটিও তারা লুট করেছে।

এরই মধ্যে সাংবাদিক মহিউদ্দিন অদুল ২০১৬ সালে স্থানীয় শিক্ষানুরাগীদের নিয়ে সেখানে একটি স্কুল অ্যান্ড কলেজ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন। রেড ক্রিসেন্টে আবেদন করলে সে বছরই সংস্থাটির সম্পত্তি বিভাগ ও তদরকির দায়িত্বে থাকা বিডিআরসিএসের কমিউনিটি এম্পাওয়ারমেন্ট প্রোগ্রাম (সিইপি) ভবন, কেল্লা ও পুকুর রক্ষণাবেক্ষণ এবং ব্যবহার উপযোগী করার শর্তে স্কুল অ্যান্ড কলেজ স্থাপনের জন্য বরাদ্ধ প্রদান করে। এরপর সরকারীভাবে এবং স্থানীয় আশ্রয়কেন্দ্র রক্ষা কমিটি ও স্থানীয় জনসাধারণের একাধিক সভায় সর্বসম্মত অনুমোদন গ্রহণ করে ২০১৭ সালে স্কুলটির সফল ও ঝাঁকজমকপূর্ণ যাত্রা শুরু হয়। বর্তমানে স্কুলটিতে ১২ জন শিক্ষক কর্মচারি ও শিশু অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত ২৬৮ জন ছাত্র-ছাত্রী পড়াশোনা করছে।

এরই মধ্যে চলতি বছর রেড ক্রিসেন্টের রাজধানীস্থ প্রধান কার্যালয়ের অর্থ বিভাগের পরিচালক মাইনুল ইসলাম ও সম্পত্তি বিভাগের সহকারী পরিচালক আব্দুস সবুর মোল্লা বদরখালীতে এসে তা পরিদর্শন করে যান। গত ৩১ শে জুলাই সম্পত্তি বিভাগের পরিচালক সবুর মোল্লা কেল্লা ও পুকুর পাড়ের মাটি ক্ষয়রোধ ও পরিবেশের রক্ষার জন্য চুক্তির শর্ত অনুযায়ী সীমানা পিলার ধরে ঘেরাও করে গাছ ও ঘাস রোপনের জন্য স্কুল কর্তৃক্ষকে নির্দেশ দেন। তিনিও মাইকে স্থানীয়দের প্রতি এ কাজে বাধা না দিয়ে অবৈধদখল ছেড়ে দিয়ে সহযোগিতার জন্য আহ্বান জানান। এরপর প্রধান কার্যালয়ের নির্দেশে সোসাইটি কেল্লা ও দীঘি ঘেরাও করার জন্য গত ১৪ আগস্ট ২০১৮ তারিখ নোটিশ জারি করে। তারপর ২৬ আগস্ট অবহতি ও সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি জারি করে। সব আইনী প্রক্রিয়া সম্পাদন করে গত ২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৮ তারিখ রেড ক্রিসেন্ট প্রতিনিধি ও স্কুল কর্তৃপক্ষ প্রয়োজনীয় পুলিশ ফোর্স নিয়ে ঘেরাও কাজ শুরু করলে পার্শবর্তী কয়েকটি পরিবারের উল্লেখিত ব্যক্তিবর্গসহ অর্ধশতাধিক নারী-পুরুষ তাদের পূর্ববর্তী ক্ষুদ্রস্বার্থে অবৈধভাবে গুরুত্বপূর্ণ জনসম্পদটির ক্ষতিকর ব্যবহার অব্যাহত রাখার দাবিতে ঘেরাও কাজে সশস্ত্রভাবে বেআইনী হামলা ও গালিগালাজ করে। এরপর শান্তিরক্ষায় পুলিশসহ সরে আসেন। তারপর ওই স্থানীয় কয়েক পরিবার চকরিয়া উপজেলা চেয়ারম্যান জাফর আলম বি.এ (অনার্স), এম.এর কাছে গিয়ে নালিশ করেন। তিনিসহ বদরখালী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান খায়রুল বশর গত শনিবার ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে বিষয়টি বুঝতে পারেন। যাদের জায়গা তাদেরকে তা রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ও স্কুলের পরিবেশ সমুন্নত রাখার জন্য ঘেরাওয়ে বাধা দেওয়ার কোন সুযোগ নেই বলে জানান তারা। পরের দিন গত রবিবার স্কুল কর্তৃপক্ষ ও রেড ক্রিসেন্টকে ঘেরাও করার জন্য সিন্ধান্ত দিয়ে পার্শবর্তী বাসিন্দাদেরকে বেআইনী বাধা সৃষ্টি না করার জন্য অনুরোধ করে চলে আসেন।

কিন্তু তারা নালিশ করেও তাদের বিচার অমান্য করেও উপরে উল্লেখিত ব্যক্তিবর্গ। রোববার সকালে সেই সিন্ধান্ত অনুযায়ী স্কুল কর্তৃপক্ষ পুলিশসহ ঘেরাও কাজ শুরু করেন। উপস্থিত পুলিশ সদস্যরা দুপুরের খাবারের বিরতীতে গেলে তারা অবৈধ অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে স্কুলে হামলা চালায়। মারধার করে। ঘেরাও ১৩২টি লোহার এঙ্গেলের খুঁটি, ৫টি হন্তা। ৩টি কোদাল, ৬টি বালতি, ২টি কড়াই, দঁড়ি, রশি, ৩০ বস্তা সিমেন্টসহ অন্তত আড়াই লাখ টাকার জিনিসপত্র লুট করে। অকথ্য ভাষায় গালিগালা ও উদ্যোক্তা সাংবাদিক মহিউদ্দিন অদুলকে হত্যার জন্য আসে বলে জানান। ঘেরাওয়ে বাধার পর তারা স্কুলের গেটের তালা ভেঙ্গে ভেতরে প্রবেশ করে। তারপর ছিটকিনি ভেঙ্গে আশ্রয়নেওয়া শিক্ষকদের উপর হামলা চালায়। বৃষ্টির মত কংকর নিক্ষেপ করে। রেড ক্রিসেন্ট ও স্কুল কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্টদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে।

পাঠকের মতামত: