ঢাকা,রোববার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪

প্রত্যাবাসন ঠেকাতে মিয়ানমার সীমান্তে নতুন বাঙ্কার আর কাঁটাতারের বেড়া

নিউজ ডেস্ক ::

খোঁড়া বাঙ্কার, কোথাও আবার স’াপিত হচ্ছে সীমান্ত নিরাপত্তা চৌকি। দ্য ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল খবর দিয়েছে, ১৭০ মাইলের সীমান্ত এলাকার বেশিরভাগ অংশ জুড়ে এসব পদক্ষেপ বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। ওই মার্কিন সংবাদমাধ্যম বলছে, মিয়ানমারের এইসব পদক্ষেপে প্রতিবেশি বাংলাদেশের সঙ্গে তাদের টানাপোড়েন বাড়ার পাশাপাশি দেশে না ফেরার বার্তা দেওয়া হচ্ছে রোহিঙ্গাদের।
গত বছরের ২৫ আগস্ট রাখাইনের কয়েকটি নিরাপত্তা চৌকিতে হামলার পর পূর্ব-পরিকল্পিত ও কাঠামোবদ্ধ সহিংসতা জোরালো করে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। হত্যা-ধর্ষণসহ বিভিন্ন ধারার সহিংসতা ও নিপীড়ন থেকে বাঁচতে বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর প্রায় ৭ লাখ মানুষ। তারা কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নিয়েছে। আন্তর্জাতিক চাপের মুখে পালিয়ে আসা বাংলাদেশ-মিয়ানমার প্রত্যাবাসন চুক্তি সম্পন্ন হলেও তা কার্যকরের বিষয়টি এখনও প্রক্রিয়াধীন। কেবল গত বছর আগস্ট থেকে এ পর্যন্ত ৭ লাখ রোহিঙ্গা পালিয়ে এলেও এখন পর্যন্ত কেবল ৩৮৮ জনকে ফেরত নেওয়ার প্রক্রিয়া চালু রাখার কথা জানিয়েছে মিয়ানমার। এই অবস’াতেই গ্রামগুলোতে বুলডোজার চালিয়ে আলামত নষ্ট, বিপুল সামরিকায়ন, উন্নয়ন প্রকল্প চলমান থাকা, প্রত্যাবাসন নিয়ে বৌদ্ধ জনগোষ্ঠীর হুমকির ধারাবাহিকতায় রাখাইনে বৌদ্ধদের মডেল গ্রাম গড়ে উঠছে বলে খবর পাওয়া যায়। এবার সীমান্তে নতুন করে সুরক্ষার পদক্ষেপের কথা জানা গেলো।
দ্য ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের খবরে বলা হয়েছে, সীমান্ত এলাকায় পরস্পর সম্পর্কযুক্ত বেড়ায় কাঁটাতার বসানো হচ্ছে। কংক্রিট তৈরির মাধ্যমে বেড়া জোরালো করা হচ্ছে কোনও কোনও এলাকায় বাঙ্কার আর সেনা পোস্ট বানানোও হচ্ছে। রোহিঙ্গা শরণার্থীরা বলছে, তাদের ফেলে আসা দেশে এখন ফিরে যাওয়া অসম্ভব। বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষিবাহিনীর সদস্য ও শরণার্থীরা ওয়াল স্ট্রিট জার্নালকে বলেছেন, সামপ্রতিক সপ্তাহগুলোতে মিয়ানমার সেনাবাহিনী সীমান্ত এলাকায় এসব কাজ জোরালো করেছে। মিয়ানমারের জাতিগত সংখ্যালঘু রোহিঙ্গাদের স’ায়ীভাবে বিতাড়নের জন্য চালানো কার্যক্রমের অংশ হিসেবে এসব কাজ চলছে। ওয়াশিংটনের ন্যাশনাল ওয়ার কলেজের অধ্যাপক জাচারি আবুজা বলেন, মিয়ানমার মনে করছে বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গাদের বের করে দেওয়া সম্ভব হয়েছে আর তাদের ফেরাকে আজাবে পরিণত করতে যাচ্ছে।
বাংলাদেশে পালিয়ে আসা প্রায় সাত লাখ রোহিঙ্গা এখন শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নিয়েছে। প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া এগুচ্ছে ধীর গতিতে। সাড়ে তিন হাজার শরণার্থীর একটি গ্রুপ বাংলাদেশ সীমান্তের কোনাপাড়া এলাকায় মিয়ানমারের অভ্যন্তরে স্পর্শকাতর জমিতে আটকা পড়ে আছে। দেড়শো ফুট দূরে মিয়ানমারের সীমান্ত আর রোহিঙ্গা শিবিরকে ভয় দেখাতে সেদেশের নিরাপত্তা কর্মীরা ছোট ছোট গর্ত খুঁড়ে অবস’ান নিয়েছে। আর বাংলাদেশের দিকে বর্ডার গার্ড পুলিশ ছোট ছোট চেকপোস্টে রাইফেল নিয়ে পাহারা দিচ্ছে। পাঁয়ে হেঁটে অথবা ট্রাকে করে পেট্রল ডিউটি চালিয়ে যাচ্ছে তারা। রোহিঙ্গাদের খাদ্য ও চিকিৎসা সেবা দেওয়া মিয়ানমারের আন্তর্জাতিক রেড ক্রসি কমিটির প্রধান ফ্যাব্রিজিও কারবোনি বলেন, এটা থাকার জন্য নিরপাদ জায়গা নয়।
নিজেদের মিয়ানমারের নাগরিক দাবি করে তারা বাংলাদেশে প্রবেশ করতে অস্বীকৃতি জানিয়ে আসছে এসব রোহিঙ্গা নাগরিক। তবে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্বের স্বীকৃতি দেয় না মিয়ানমার। উল্টো অবৈধ বাংলাদেশি অভিবাসী বিবেচনা করা হয় তাদের। কোনও কোনও শরণার্থী বলছেন জানুয়ারি পর্যন্ত সীমান্তের খোলা অংশ দিয়ে মিয়ানমারের অভ্যন্তরে যেতে পারতেন তারা। নারকেল আর পাম ফল সংগ্রহের পাশাপাশি গত আগস্টে ফেলে আসা বাড়িটিও দেখে আসতে পারতো তারা। ‘এখন আমরা সীমান্তের বেড়া পার হতে পারি না’, রোহিঙ্গা সমপ্রদায়ের এক নেতা নুর আলম বলছিলেন, ‘কোনও খোলা জায়গা নেই।’
যদি তারা সীমান্ত পার হয় তাহলে তার আরও বিপদজনক হতে পারে। সীমান্ত জোরালো করার কাজ শুরুর পর সীমান্ত অতিক্রমের চেষ্টা করতে গিয়ে দুই রোহিঙ্গা পা হারিয়েছে, বলেন নুর আলম। পেতে রাখা বোমার বিস্ফোরণের স্লিন্টার বুকে আঘাত করায় আহত হয়েছে তার ছেলে। জাতিসংঘের একটি অনুসন্ধানি দল সীমান্তে ভারী অস্ত্রসহ নিরাপত্তারক্ষি পাঠানোয় গত ১২ মার্চ মিয়ানমার সরকারকে অভিযুক্ত করে। রোহিঙ্গাদের হুমকে দিতে ওই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে বলে দাবি করে ওই দলটি জানায় কোনাপাড়ার নো ম্যানস ল্যান্ড থেকে কয়েকজন পালিয়ে বাংলাদেশে ঢুকে পড়েছে।
ঢাকায় নিযুক্ত মিয়ানামেরর রাষ্ট্রদূতকে চলতি মাসে তলব করে বাংলাদেশ। তাকে জানিয়ে দেওয়া হয় সামরিক স’াপনা প্রত্যাবাসনকে ক্ষতিগ্রস’ করতে পারে। তবে সু চির দফতরের এক মুখপাত্র জানিয়েছেন সীমান্ত এলাকায় বসবাস করা শরণার্থীদের কাছ থেকে নিরাপত্তা হুমকির জন্যই এসব স’াপনা নির্মাণ করা হচ্ছে। রাখাইনভিত্তিক পুলিশ কর্নেল অং মিয়াত মোয়ে বলেন, সীমান্ত এলাকার ৪০ মাইল এলাকায় নতুন করে বেড়া বসানো হবে। বেড়ার উন্নয়নে গত ফেব্রুয়ারি মাসে মিয়ানমারের সংসদ ১৫ মিলিয়ন ডলার অনুমোদন দেয়।
মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সু চির সরকার বলছে, মিয়ানমারের বসবাসের প্রশান দিতে পারলে রোহিঙ্গাদের ফিরতে দেওয়া হবে। তবে সীমান্তে দেওয়াল তোলা ছাড়াও প্রথম প্রত্যাবাসনের জন্য বাংলাদেশের দেওয়া আট হাজার রোহিঙ্গার তালিকার মধ্যে মাত্র ৩৭৯জনকে ফেরার জন্য মনোনীত করেছে। বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী রাখাইন রাজ্যের পুড়িয়ে দেওয়া রোহিঙ্গা গ্রামগুলোতে নিরাপত্তাবাহিনীর কর্মীরা যেসব স’াপনা নির্মাণ করা হচ্ছে মিয়ানমার সেগুলোকে প্রত্যাবাসিত রোহিঙ্গাদের আবাস বললেও মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল সেগুলোর কয়েকটি ভবন নিরাপত্তা বাহিনীর ঘাঁটি নির্মাণের তথ্য তুলে এনেছে।
সু চির দফতরের মুখপাত্র জাও তাই বলেন, সেখানে বসবাসকারীরা বাড়ি ফিরে আসলে তাদের স্বাগত জানানো হবে তবে সেখানে বসবাস মিয়ানমারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ বয়ে আনছে। সেখানে বসবাসকারীদের মধ্যে সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসা) সদস্যরা রয়েছেন বলেও দাবি করেন তিনি। তবে এখানে বসবাসরতদের সঙ্গে আরসার সংশ্লিষ্টতার কথা অস্বীকার করেন নুর আলম। তিনি বলেন, সীমান্ত অতিক্রমের চেষ্টা করা শরণার্থীদের ধরার পর কোনও কোনও ক্ষেত্রে আরসা সদস্য হিসেবে অভিযুক্ত করে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা পিটিয়েছে, কারাগারে পুরেছে।
রোহিঙ্গা সমপ্রদায়ের আরেক নেতা দিল মোহাম্মদ বলেন, আমরা তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে চাই। তবে আমাদের জন্য সেখানে নিরাপত্তার কোনও চিহ্ন নেই। নিজেদের নিরাপত্তাহীনতা ক্রমাগত বাড়ছে বর্ণনা করে তিনি বলেন, তাদের কুঁড়ে ঘরের পাশে থাকা ছোট নালাগুলো আসন্ন এপ্রিলের বর্ষা মৌসুমে তলিয়ে যাবে।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বলছে, মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের ফিরে আসার আবেদন করতে নিরুৎসাহিত করছে। ‘নিরাপত্তা বাহিনীর অবকাঠামোর ভবনগুলো একটি বার্তাই ছড়াচ্ছে: ফিরে আসলে তোমাদের এভাবেই বাঁচতে হবে’, বলছিলেন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের গবেষক লরা হেইগ। তিনি বলেন, রোহিঙ্গাদের মতো পরিসি’তির মধ্য দিয়ে যাওয়া একটি সমপ্রদায়ের জন্য আমি আর কোনও বার্তা এর মধ্যে দেখতে পাই না।

পাঠকের মতামত: