ঢাকা,শনিবার, ১৬ নভেম্বর ২০২৪

প্রকাশ্যে মাফ চাওয়া উচিত এমপি সাইমুমের, বলছেন ভাইও

নিউজ ডেস্ক ::
কক্সবাজারের রামুতে নিজের ছেলেবেলার শিক্ষককে লাঞ্ছিত করার ঘটনায় আওয়ামী লীগের সাংসদ সাইমুম সরওয়ার কমলের প্রকাশ্যে ক্ষমা চাওয়া উচিত বলে মনে করছেন তার নিজের ভাই।

গত রোববার দুপুরে উপজেলার জোয়ারিয়ানালা এলাকায় এমপি সাইমুম রামুর কালিরছড়া ‘রত্নগর্ভা রিজিয়া আহমেদ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের’ শিক্ষক সুনীল কুমার শর্মাকে লাঞ্ছিত করেন বলে প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্য।

আর সুনীলের অভিযোগ, তার ছেলে সুজন কুমার শর্মার ওপর ক্ষেভ দেখিয়ে সবার সামনে তাকে গলা ধাক্কা দেন সাইমুম। সুজনকে ‘গুম করে’ ফেলারও হুমকি দেন তিনি।

ওই ঘটনা নিয়ে সোমবার থেকেই সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে চলছে তুমুল সমালোচনা। সোমবার ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের এক বৈঠকেও এ ঘটনা নিয়ে সাইমুমের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন স্থানীয় নেতারা।

আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি, সাবেক রাষ্ট্রদূত ওসমান সারওয়ার আলম চৌধুরীর ছেলে সাইমুম সরওয়ার কমল কক্সবাজার জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য। আর তার বড় ভাই সোহেল সরওয়ার কাজল রামু উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান।

সোহেল বলেন, সুনীল কুমার শর্মা উত্তর কাহাতিয়াপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের পদ থেকে ২০১৪ সালে অবসরে যান। পরে রামুর রত্নগর্ভা রিজিয়া আহমেদ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে চাকরি নেন।

“সুনীল স্যার স্কুলজীবনে আমাদের দুই ভাইকে বাড়িতে এসে পড়াতেন। তিনি আমাদের সন্তানের মতই দেখেন। একজন আইনপ্রণেতা হয়ে নিজের শিক্ষাগুরুকে এভাবে ন্যক্কারজনকভাবে লাঞ্ছিত করল… এটা অসভ্যতার পর্যায়ে পড়ে। তিনি তো কেবল শিক্ষক নন, হিন্দু সম্প্রদায়ের একজন সম্মানিত নেতাও।”

সাইমুমের এ ধরনের আচরণে দল ও সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়েছে মন্তব্য করে তার ভাই সোহেল বলেন, “তার উচিৎ এখন নিজ উদ্যোগে শিক্ষকের কাছে প্রকাশ্যে ক্ষমা চাওয়া।”

অবশ্য সাংসদ সাইমুম সারওয়ার কমলের দাবি, সুনীল কুমার কখনোই তার শিক্ষক ছিলেন না। তাকে লাঞ্ছিত করার খবরও সঠিক নয়।

মঙ্গলবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “উনি কখনো আমার শিক্ষক ছিলেন না। গৃহশিক্ষক কিংবা কোনো স্কুলেও পড়াননি আমাকে। গণমাধ্যমে আমার বিরুদ্ধে যা এসেছে তা সম্পূর্ণ মিথ্যা; তাকে আমি লাঞ্ছিত করিনি।”

এই আইনপ্রণেতার দাবি, সুনীল কুমার শর্মার সঙ্গে তার ‘বাকবিতণ্ডা’ হয়েছিল।

“উনি একাত্তর, পঁচাত্তরে আমার বাবাকে জ্বালিয়েছেন; এখন ছেলেকে দিয়ে আমাকে জ্বালাচ্ছেন- এটাই বলেছি তাকে। একাত্তরে শান্তি কমিটির লোকদের নানা ধরনের সহায়তা করেছেন উনি; জিয়া-এরশাদ আমলে বিএনপি-জাপা করে স্থানীয়দের গণপিটুনি খেয়েছে।…”

‘কথা কাটাকাটির’ সময় ৫০-৬০ জন লোক সেখানে উপস্থিতি ছিলেন দাবি করে কক্সবাজার-৩ আসনের এই সাংসদ বলেন, “উনাকে গলাধাক্কা দেওয়া হয়েছে একথা কেউ বলতে পারবেন না।”

তবে একাধিক প্রত্যক্ষদর্শীর সঙ্গে কথা বলে সাংসদের বক্তব্যের সঙ্গে মিল পাওয়া যায়নি।

রোববার ঘটনাস্থলে উপস্থিত জোয়ারিয়ানালা এলাকার বাসিন্দা মনিরুল আলম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “একজন সংসদ সদস্যের এ ধরনের আচরণ সভ্য সমাজের কোথাও দেখিনি। যাকে লাঞ্ছিত করা হয়েছে তিনি সংসদ সদস্যের শিক্ষক ছিলেন।”

লাঞ্ছিত হওয়ার ঘটনায় এমপি সাইমুমের বিরুদ্ধে কোনো আইনগত ব্যবস্থা নেবেন কি না জানতে চাইলে সুনীল কুমার শর্মা বলেন, “আমি সাধারণ মানুষ। কমল আমার ছাত্র ও সন্তানের মত। প্রকাশ্যে সে লাঞ্ছিত করেছে ঠিক, কিন্তু মামলা করে ঝুট-ঝামেলায় পড়তে চাই না।”

কী ঘটেছিল রামুতে?
শিক্ষক সুনীল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, রোববার দুপুরে স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার সময় তিনি যখন জোয়ারিয়ানালা বাজার এলাকায় পৌঁছান, স্থানীয় সংসদ সদস্য সাইমুম তখন বিকেএসপির খেলার মাঠের উন্নয়ন কাজের উদ্বোধন শেষে মোনাজাতে অংশ নিচ্ছিলেন। মোনাজাত শেষ হলে তার দিকে এগিয়ে যান সাইমুম।

“সবার সামনেই সে বলে, ‘তোর ছেলে সুজন বড়ই বেড়ে গেছে। আমার বিরুদ্ধে লেগেছে। বেশি বাড়াবাড়ি করতে বারণ করিস । নইলে তাকে গুম করে ফেলব’।”

এমন আচরণের পর সাংসদকে সুনীল মনে করিয়ে দেন, তিনি এক সময় তার শিক্ষক ছিলেন। তাতে সাইমুম আরও ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন বলে সুনীলের ভাষ্য।

“তখন সে তেড়ে এসে রাগত ভঙ্গিতে আমার ঘাড়ে হাত দিল। জামার কলার ধরে টানা-হেঁচড়া করল, ধাক্কাও দিল। বলল, ‘ছেলেকে সাবধান করবি। নইলে তার খবর করে ছাড়ব’।”

যাকে নিয়ে এই ঘটনা, সেই সুজন শর্মা ঢাকায় রিয়েল এস্টেটের ব্যবসায় জড়িত। ‘ঢাকাস্থ রামু সমিতির’ সাধারণ সম্পাদক তিনি। আর এমপি সাইমুম ওই সমিতির একজন ‘সম্মানিত উপদেষ্টা’।

সুজন বলছেন, রামু সমিতির ‘মেজবান ও রামু উৎসব’ এর আয়োজন নিয়ে গত শুক্রবার ঢাকায় একটি মতবিনিময় সভা হয়। সেখানে আমন্ত্রিত অতিথিদের তালিকায় কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. ফোরকান আহমদের নাম দেখে ক্ষুব্ধ হন সাংসদ। তিনি প্রশ্ন করেন- কার কথায় ফোরকানকে অতিথি করা হয়েছে।

সমিতির সাধারণ সম্পাদক সুজন শর্মা তখন বলেন, ফোরকান আহমদ সমিতির উপদেষ্টা, তিনি অতিথি হিসেবে থাকতেই পারেন।

“এমপি তখন উত্তেজিত হয়ে বলেন, কেউ বাড়াবাড়ি করলে উৎসব করতে দেওয়া হবে না। হুমকি দিয়ে তিনি সভা থেকে চলে যান।”

সুজন বলেন, “সংসদ সদস্য আসলে চাইছেন, তার ইশারা আর নিয়ন্ত্রণে সমিতির কার্যক্রম চলুক। ঢাকায় বসবাস করা রামুর সাধারণ বাসিন্দারা অনেক পরিশ্রম করে এ সংগঠন গড়ে তুলেছে। তাই কোনো ব্যক্তি বিশেষের নিয়ন্ত্রণে সমিতি পরিচালিত হোক- তা গণতান্ত্রিক সভ্য সমাজের কাম্য হতে পারে না।”

ঢাকাস্থ রামু সমিতির ওই উৎসব হওয়ার কথা ছিল আগামী ১৯ জানুয়ারি। কিন্তু উদ্ভূত পরিস্থিতিতে তা স্থগিত করা হয়েছে বলে মঙ্গলবার সংগঠনের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়।

নানা অভিযোগে আলোচনায় সাইমুম
৪৮ বছর বয়সী সাইমুম সারওয়ার কমল আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে কেন্দ্রীয় প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক হাছান মাহমুদের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত।

২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে প্রথমবার সাংসদ নির্বাচিত হওয়া সাইমুম স্বেচ্ছাসেবক লীগের গত কমিটিতে আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক ছিলেন ।

তার ফেইসবুক পেইজে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করার পর বেলজিয়ামের একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকেও তিনি ডিগ্রি নিয়েছেন।

তার বাবা ওসমান সারওয়ার আলম চৌধুরী ১৯৭০ এর প্রাদেশিক পরিষদ এবং ১৯৭৩ সালের প্রথম সংসদে উখিয়া-টেকনাফ-রামু আসনের সাংসদ ছিলেন। ১৯৯৬-২০০১ মেয়াদের আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে রাষ্ট্রদূত ছিলেন ওসমান সারওয়ার।

২০১৩ সালে হল-মার্ক কেলেঙ্কারির সময় সোনালী ব্যাংকের সাবেক পরিচালক সদস্য সাইমুম সরওয়ার কমলের নামও আলোচনায় আসে। দুদক তাকে সে সময় জিজ্ঞাসাবাদও করে।

সংবাদ মাধ্যমে তখন খবর আসে, সোনালী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদকে ‘ম্যানেজ’ করার জন্য সাইমুমকে তিন কোটি টাকা দেওয়ার কথা আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে বলেছেন হল-মার্কের এমডি তানভীর মাহমুদ।

ওই অভিযোগ অস্বীকার করে সাইমুম সে সময় বলেছিলেন, ব্যক্তিগত ক্ষোভ থেকে তানভীর মাহমুদ তাকে ওই কেলেঙ্কারিতে জড়ানোর চেষ্টা করেছেন।

সাইমুম সরওয়ার কমল ও তার স্ত্রী সৈয়দা সেলিনা আক্তারের অবৈধ সম্পদের খোঁজে ২০১২ সালে তদন্ত চালিয়েছিল দুদক। তখনও সাইমুমকে ‍দুদকে ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছিল।

অবশ্য তিনি এমপি হওয়ার পর দুদকের পক্ষ থেকে বলা হয়, ওই অভিযোগের সত্যতা পায়নি তারা।

২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে হিমছড়ি পর্যটন স্পটের সামনে অবৈধ দোকান উচ্ছেদ করায় সংসদ সদস্য সাইমুমের নেতৃত্বে বনকর্মীদের মারধরেরও অভিযোগ উঠেছিল।

পাঠকের মতামত: