ঢাকা,রোববার, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪

পেকুয়া বারবাকিয়া রেঞ্জের বনভূমিতে পাহাড় কাটা ও ঘর বাঁধার হিড়িক

মনির আহমদ, পেকুয়া থেকে ফিরে :: কক্সবাজার জেলার পেকুয়া উপজেলার বারবাকিয়া রেঞ্জের চলাচল সড়ক সংলগ্ন পাহাড়টি রক্ষা পাচ্ছে না মাটি ও বনদস্যুদের কাছ থেকে। দিনে দুপুরে মাটি কেটে সরবরাহ করছে ইটভাটাতে।

সরেজমিনে এমনটাই দেখা গেছে। রেঞ্জারের চলাচল সড়কেই প্রতিদিন সন্ধ্যায় স্কেভেটর আর ট্রাকের আনাগোনায় পাহাড় কাটা চলে ভোর থেকে সকাল। একই ভাবে বারবাকিয়া, টইটং ও পররচাঁদা বনবিটের সংরক্ষিত বনাঞ্চলে পাহাড় কাটা, মাটি বিক্রী, ও বনভুমি দখলে নিয়ে পাকা আধা পাকা ও বহুতল এবং বাণিজ্যিক ভবন নির্মানের হিড়িক পড়েছে।

অব্যাহত দখলে ইতিপুর্বেই প্রায় ৮ হাজার একরের বেশি বনভূমি বেদখল। তৈরী হচ্ছে সংশ্লিষ্ট বন কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের ম্যানেজ করে। এই তিন বিটের আওতাধীন বনাঞ্চলের ভূমি দখল করে বসবাস করছে প্রায় লক্ষাধিক মানুষ। বিগত দীর্ঘ বছর ধরে অবৈধ জবর দখল চললেও নিষ্ক্রিয় রয়েছে বন বিভাগ।

অভিযোগ উঠেছে, কতিপয় অসাধু বনবিট কর্মকর্তা-কর্মচারীরাই অবৈধ সুবিধা নিয়ে সংরক্ষিত বনভূমি দখলের সুযোগ তৈরী করে দিয়েছে। এছাড়াও সংরক্ষিত বনভূমিতে পল্লী বিদ্যুৎ কর্তৃপক্ষ অবাধে বিদ্যুৎ সংযোগ প্রদান করায় মানুষ সংরক্ষিত বনাঞ্চলের ভিতরে বসবাসে’র দিকে ঝুঁকছে।

অভিযোগ রয়েছে বন বিভাগ মাঝে মধ্যে কিছু অভিযান পরিচালনা করলেও তা ‘লোক দেখানো’। টইটং, বারবাকিয়া ও পহরচাঁদা বনবিটের আওতাধীন প্রায় ১৪ হাজার একরের বেশি সংরক্ষিত বনভূমি আছে। এসব সংরক্ষিত বনভূমির মধ্যে প্রায় ৮ হাজার একরের বেশি বনভূমি অবৈধ দখলে রয়েছে। বনভূমি দখলের সাথে জড়িত রয়েছে স্থানীয় গুটিকয়েক প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা এবং জনপ্রতিধিরাও।

আবার অবৈধ জবর দখলের সাথে জড়িতরা নির্বিঘ্নে যাতায়াতের জন্য পাহাড় কেটে কাচা সড়কও তৈরী করেছে। এভাবে বিগত ৮/১০বছরে পেকুয়া উপজেলার বারবাকিয়া রেঞ্জের প্রায় ৮ হাজার একরের বেশি সংরক্ষিত বনাঞ্চল জবর দখল হয়ে গেছে। বিগত ২০১২ ও ২০১৫ইংরেজীতে বারবাকিয়া বনরেঞ্জ কিছু জায়গায় সামাজিক বনায়ন সৃজন করলেও বর্তমানে বনায়নের কোন অস্তিত্ব নেই।

নামমাত্র বনায়ন করে লাখ লাখ টাকা লোপাটের অভিযোগ রয়েছে। বন বিভাগের এক শ্রেণীর কর্মকর্তা সামাজিক বনায়ন সৃজনের নামে অনিয়ম-দুর্ণীতির মাধ্যমে সরকারী বরাদ্দ হাতিয়ে নেওয়ায় সামাজিক বনায়নের সুফল পায়নি উপকারভোগীরা।

বারবাকিয়া বনরেঞ্জের আওতাধীন পাহাড়চান্দা সংরক্ষিত বনে মুরগীর খামারী আব্দুর রশিদ জানান, তাদের দুই ভাই পুলিশ কর্মকর্তা, দুই ভাই প্রকৌশলী, দখলদারের কাছ থেকে বনের জায়গা কিনে পরিবার নিয়ে বসবাস সহ পোল্ট্রি খামার করছেন। তবে কোনো দলিলপত্র নেই। মাঝে মাঝে স্থানীয় বনবিটের কর্মচারী সামশু ও বিট কর্মকর্তা শাহ আলম নির্মানাধীন বাড়িতে এসে উচ্ছেদের হুমকি দিয়ে পকেট মানি নিয়ে যায়।

এ প্রসঙ্গে বারবাকিয়া রেঞ্জের অধীন পাহাড় চান্দা বনবিট কর্মকর্তা শাহ আলম এর কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, বনবিটের প্রায় অধিকাংশ বনভূমিই বেদখল হয়ে গেছে। তিনি বনবিটে যোগদান করার পর থেকে অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদের জন্য বেশ কিছু বন মামলাও দায়ের করেছেন। মামলা দিয়েও দখলবাজদের ঠেকানো যাচ্ছেনা বলে স্বীকার করেছেন বন বিভাগের এ কর্মকর্তা।

বারবাকিয়া বনবিট অফিসের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে এ প্রতিবেদককে বলেন, বারবাকিয়া বিটের সংরক্ষিত বনাঞ্চলের প্রায় ৩ হাজার একর বনভূমির দখলদারেরা অবৈধভাবে দখল করে নিয়েছে। এ ছাড়া বনাঞ্চলের ভূমি দখল করে বসবাস করছে শত শত পরিবার।

তিনি বলেন, এই বিটে বর্তমানে জনবল-সংকট আছে। জনবল সংকটের কারণে উচ্ছেদ অভিযান ব্যাহত হচ্ছে।

এলাকার সচেতন মহল জানান, পাহাড়ের ভেতর গড়ে উঠছে শত শত পাকা স্থাপনা। নির্বিচারে পাহাড় এবং গাছপালা কাটার কারণে পাহাড়ের জীববৈচিত্র হুমকির সম্মুখীন। পাহাড় দখল, অপরিকল্পিত বসতি স্থাপন এবং অবৈধ পাকা দালান নির্মাণের ফলে পাহাড় ধসে প্রাণহানির সম্ভাবনাও দেখা দিয়েছে। শুধু তাই নয়, গভীর অরণ্য কেটে ফেলার ফলে বন্যহাতি লোকালয়ে এসে মানুষ মারছে। জলবায়ুর বিরূপ প্রভাব মোকাবিলা ও পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় বন বিভাগকে আরো কঠোর হওয়ার পরামর্ষ দেন এই পরিবেশ নেতা।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বারাবকিয়া বনবিভাগের কর্মকর্তাদের যোগসাজশে হ্যাডম্যান নামধারী দালাল প্রকৃতির লোকের মাধ্যমে বন বিভাগের কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করেই প্রতিনিয়ত বন থেকে গাছ কাটছে আর অবৈধ বিলাসবহুল পাকা বাড়ি নির্মাণ করে চলছে প্রভাবশালীরা।

ফলে নিধন হচ্ছে গাছপালা, উজাড় হচ্ছে সংরক্ষিত বনাঞ্চল। অভিযোগ করা হলে বা উপর মহলের চাপ আসলে বরাবরের মতো লোক দেখানো অভিযান করে পরবর্তীতে টাকা নিয়ে সেই ঘর নির্মাণের ব্যবস্থা করে দেয় খোদ বন কর্মকর্তারা।

বারবাকিয়া রেঞ্জের অধীন পহরচাঁদা বনবিট কর্মকর্তা মো: শাহ আলম এ প্রসঙ্গে বলেন, তার বনবিটে অধীন ২ হাজার ৮’শ হেক্টর সংরক্ষিত বনভূমি রয়েছে। ১ হাজার একরেও বেশি বনভূমিই জবর দখল করে ঘরবাড়িসহ নানা স্থাপনা তৈরীর কথা এ কর্মকর্তাও স্বীকার করেছেন।

পেকুয়া উপজেলার বারবাকিয়া রেঞ্জ কর্মকর্তা মো: হাবিবুল হক জানান, তিনি অত্র রেঞ্জে যোগদান করার পর থেকে বনভূমি রক্ষায় কাজ করছেন। তিনি আসার আগেই অধিকাংশ বনভূমি জবর দখল হয়ে গেছে। এখন তিনি চেষ্টা করছেন জবরদখলকৃত বনভূমি উদ্ধার করে সামাজিক বনায়নের আওতায় নিয়ে আসতে। বন বিভাগের কর্মচারীদের ম্যানেজ করে অবৈধ স্থাপনা গড়ে উঠছে এমন প্রশ্ন করা হলে তিনি কোন মন্তব্য করেননি।

পাঠকের মতামত: