ঢাকা,মঙ্গলবার, ১৯ নভেম্বর ২০২৪

পহরচাঁদা, ডুলাহাজারা ও ফুলছড়িতে বেপরোয়া পাহাড়খেকো

পাহাড় কাটার ধুম চকরিয়ায়

পাহাড় কাটায় উপড়ে পড়ছে মেদাকচ্ছপিয়া জাতীয় উদ্যানের শতবর্ষী মাদার ট্রি
মাহমুদুর রহমান মাহমুদ, চকরিয়া ::

কক্সবাজার জেলার চকরিয়ায় চট্টগ্রাম দক্ষিণ ও কক্সবাজার উত্তর বন বিভাগের অধীন সংরক্ষিত পাহাড় নিধন চলছে প্রকাশ্যে। দক্ষিণ বন বিভাগের বারবাকিয়া রেঞ্জের পহরচাঁদা বনবিটের মোহছেনিয়াকাটা এবং কক্সবাজার উত্তর বনবিভাগের ফাঁসিয়াখালী ও ফুলছড়ি রেঞ্জের বিভিন্ন বিটের অধীন পাহাড় কেটে মাটি বিক্রি করা হচ্ছে উন্নয়ন প্রকল্প ও ইটভাটায়। প্রভাবশালীরা উচিতার বিল মৌজার বন্যহাতির অভয়ারণ্য ধ্বংস করে পাহাড় কাটছে। নির্বিচারে পাহাড় কাটায় উপড়ে পড়ছে চকরিয়ার মেদাকচ্ছপিয়া জাতীয় উদ্যানের শতবর্ষী গর্জন মাদার ট্রি। অন্যদিকে সংরক্ষিত বনে অবৈধভাবে গড়ে তোলা হয়েছে ইটভাটা। এসব ইটভাটায় ব্যবহার হচ্ছে পাহাড়ের মাটি। প্রকাশ্যে পাহাড়কাটা হলেও বনবিভাগ, পরিবেশ অধিদপ্তর ও প্রশাসনের টনক নড়ছে না।

পাহাড় কাটার বিষয়ে কক্সবাজার জেলার পরিবেশ অধিদপ্তরের উপপরিচালক শেখ নাজমুল হুদা বলেন, ‘চকরিয়ায় পাহাড় কাটার বিরুদ্ধে অসংখ্য অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে। পাহাড়খেকোদের বিরুদ্ধে মামলাও করা হয়েছে।’

চকরিয়ার ডুলাহাজারা ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের রংমহল, ৮ নম্বর ওয়ার্ডের পাগলির বিল, ৭ নম্বর ওয়ার্ডের দক্ষিণ মাইজপাড়ায় পাহাড় কাটার মহোৎসব চলছে। এই ইউনিয়নে ব্যক্তি মালিকানাধীন সমতল জমির সঙ্গে থাকা টিলা শ্রেণির পাহাড় কাটা হচ্ছে কৌশলে। ইউনিয়নের বগাইছড়ি ছড়া খালে বাঁধ দিয়ে পানিপ্রবাহ বন্ধ করে সেখানে নির্মাণ করা হয়েছে মাটির সড়ক। এই সড়কের ওপর দিয়েই পাহাড়-টিলা কেটে মাটি অন্যত্র নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। পাহাড়ের খাদে ড্রেজার বসিয়ে তোলা হচ্ছে বালু।

পরিবেশ বিধ্বংসী এসব কর্মকাণ্ডের সঙ্গে স্থানীয় প্রভাবশালী সাইফুল এহেছান চৌধুরী জড়িত রয়েছেন বলে অভিযোগ।

প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, এহেছানের পক্ষে পাহাড়কাটার কাজ সার্বক্ষণিক তদারকি করেন হামিদ রেজা সাগর। শুরুর দিকে স্থানীয়দের কাছ থেকে অভিযোগ পেয়ে চকরিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার নেতৃত্বে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালিত হয়। দুটি গাড়িও জব্দ করা হয়। তবে পাহাড়কাটা বন্ধ হয়নি।

এ ব্যাপারে হামিদ রেজা সাগর চকরিয়া নিউজকে বলেন, যেখান থেকে এক্সক্যাভেটর দিয়ে মাটি কাটা হচ্ছে সেসব জায়গা এহেছানদের পৈতৃক। তাই সেখানে মাছ চাষ করার জন্য ১০-১২টি পুকুর খনন করে পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে অনুমতি নিয়ে মাটি অপসারণ করা হচ্ছে। এই মাটি নির্মাণাধীন রেললাইনের রাস্তায় ব্যবহারে বিক্রি করা হয়েছে।

ডুলাহাজারার রংমহল এলাকায় ব্যক্তি মালিকানাধীন জমির সঙ্গে টিলা শ্রেণির পাহাড় কাটায় ওই এলাকার অসংখ্য স্থানে গভীর খাদের সৃষ্টি হয়েছে। হুমকির মুখে পড়েছে পাশের বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্কের দক্ষিণাংশের সীমানা দেয়াল। আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে রংমহল এলাকার শতাধিক পরিবারেও। সামনের বর্ষায় ভারি বৃষ্টিপাতে ভয়াবহ ভূমিধসের ঘটনা ঘটতে পারে বলে আশঙ্কা স্থানীয়দের।

জানা যায়, স্থানীয় এনামুল হক গংয়ের দায়ের করা মামলায় টিলা শ্রেণির ওই জায়গায় স্থিতাবস্থা বজায় রাখার জন্য উচ্চ আদালতের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। এরপরও প্রভাবশালীরা নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে মাটি কাটছে।

স্থানীয়রা অভিযোগ করেছেন, ডুলাহাজারা ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান নুরুল আমিন প্রথমদিকে বগাইছড়ি ছড়াখালের ওপর বাঁধ দিয়ে রাস্তা তৈরি করেন। আওয়ামী লীগ নেতা নূর হোছাইনের ছেলে সজীব, চেয়ারম্যান নুরুল আমিনের ভাইপো এমরানুল হকসহ একটি বড় সিন্ডিকেট বগাইছড়ি খালে শক্তিশালী ড্রেজার বসিয়ে বালু উত্তোলন শুরু করে। তবে চেয়ারম্যান নুরুল আমিন অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, পরিবেশ বিধ্বংসী কোনো কর্মকাণ্ডের সঙ্গে তিনি জড়িত নন।

কক্সবাজার উত্তর বনবিভাগের ফুলছড়ি রেঞ্জের নিয়ন্ত্রণাধীন খুটাখালী ইউনিয়নে রয়েছে মেদাকচ্ছপিয়া জাতীয় উদ্যান (ন্যাশনাল পার্ক)। বিশাল এই উদ্যানের মাঝখান দিয়ে গেছে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক। এই জাতীয় উদ্যানে রয়েছে প্রায় ১০ হাজার শতবর্ষী মাদার ট্রি (গর্জন)। উদ্যানের পশ্চিমাংশে প্রকাশ্যে কাটা হয়েছে বড় পাহাড়। এতে উপড়ে পড়েছে শতবর্ষী মাদার ট্রিসহ বিভিন্ন প্রজাতির গাছ। দিনরাত এক্সক্যাভেটর দিয়ে পাহাড় কেটে সেই মাটি ব্যবহার করা হচ্ছে রেললাইনে। এছাড়া খুটাখালী ইউনিয়নের উত্তর মেদাকচ্ছপিয়া, পূর্ব নোয়াপাড়া, লম্বাথলী, ভিলেজার পাড়া, বাগাইন্না পাড়া, গোলডেবা, গোদারপাড়া, নাইশ্যার ঝুমসহ অন্তত ১০টি স্থানে চলছে পাহাড় কাটা।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, খুটাখালী ইউনিয়নে পাহাড় কাটার সঙ্গে পাঁচটি সিন্ডিকেট জড়িত। প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, পাহাড় কাটার সঙ্গে জড়িত বিএনপি থেকে আওয়ামী লীগে অনুপ্রবেশকারী জিলল্গুর রহমান, রেজাউল করিম প্রকাশ রেজু মাস্টার, শফিউল আলম মেম্বার, শফিউল আলম এবং অসংখ্য বন মামলার আসামি জসীম উদ্দিন। এছাড়া যুবলীগ নেতা আরাফাত রানা, আওয়ামী লীগ নেতা রফিকুল ইসলাম, আবদু শুক্কুর, মোহাম্মদ ফারুকের বিরুদ্ধে পাহাড় কাটার অভিযোগ রয়েছে।

এ ব্যাপারে কক্সবাজার উত্তর বনবিভাগের ফুলছড়ি রেঞ্জের অতিরিক্ত দায়িত্বপ্রাপ্ত ফাঁসিয়াখালী রেঞ্জ কর্মকর্তা মো. মাজহারুল ইসলাম পাহাড় কাটার কথা স্বীকার করে চকরিয়া নিউজকে বলেন, ‘বনবিভাগ প্রতিনিয়তই পাহাড়খেকো চক্রের পরিবেশ বিধ্বংসী অপতৎপরতার বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করছে। এর আগে রেঞ্জের বিভিন্ন বনবিটের অধীন সংরক্ষিত বনভূমি সাবাড়ের ঘটনায় অন্তত ১৩০টি মামলা দায়ের করা হয়েছে।’ রেঞ্জ কর্মকর্তা মাজহারুল ইসলাম দাবি করেন, বর্তমানে বনবিভাগের লোকবল একেবারেই কম। বিশাল একটি রেঞ্জের অধীন অসংখ্য বিটের হাজার হাজার একর সংরক্ষিত বনভূমি দিনরাত পাহারায় রাখা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। আর সেই সুযোগের সদ্ব্যবহার করে থাকে পাহাড়খেকো চক্র।

চকরিয়া উপজেলা সহকারী কমিশনার (এসিল্যান্ড) ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্র্রেট তানভীর হোসেন চকরিয়া নিউজকে জানান, ব্যক্তি মালিকানাধীন জমির শ্রেণি পরিবর্তন ও পাহাড় নিধন সম্পূর্ণ অবৈধ। উপজেলা প্রশাসন ডুলাহাজারায় ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়ে মাটিভর্তি ট্রাক জব্দ করেছে। একই কথা বলেন চকরিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সৈয়দ শামসুল তাবরীজও। তিনি বলেন, ‘যেখানেই পাহাড় কাটার সংবাদ পাচ্ছি বনবিভাগকে সঙ্গে নিয়ে সেখানেই অভিযান চালাচ্ছি। পরিবেশ অধিদপ্তরকেও এ বিষয়ে জোর পদক্ষেপ নিতে বলা হয়েছে।’

ডুলাহাজারার রংমহল এলাকায় পরিবেশ বিধ্বংসী কর্মকাণ্ডের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে ইউএনও সৈয়দ শামসুল তাবরীজ বলেন, ‘মাসখানেক আগে সেখানে আমি নিজেই ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করেছি। তখন মাটি পরিবহনে নিয়োজিত দুটি গাড়িও জব্দ করেছি। এখন শুনছি, ফের ওখানে ধ্বংসযজ্ঞে মেতেছে চক্রটি। তাই এসিল্যান্ডকে নির্দেশ দিয়েছি, সেখানে গিয়ে বড় ধরনের অভিযান পরিচালনা করতে।’

চট্টগ্রাম দক্ষিণ বন বিভাগের বারবাকিয়া রেঞ্জের পহরচাঁদা বনবিটের মোহছেনিয়াকাটা নামক স্থানে পাহাড় কাটার সঙ্গে বরইতলী ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য নিয়াজুল ইসলাম বাদল, মহিউদ্দিন ও আওয়ামী লীগ নেতা নজরুল ইসলাম জড়িত বলে অভিযোগ।

এ ব্যাপারে নিয়াজুল ইসলাম বাদলের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি দাবি করেন, একজন প্রভাবশালী জনপ্রতিনিধির হয়ে তিনি মাটি কাটার কাজে তদারকি করেন, নিজে পাহাড় কাটার সঙ্গে জড়িত নন।

চট্টগ্রাম দক্ষিণ বন বিভাগের বারবাকিয়া রেঞ্জের রেঞ্জ কর্মকর্তা আবদুল গফুর মোলল্গা এ ব্যাপারে বলেন, ‘মোহছেনিয়া কাটায় পাহাড় কাটার ঘটনা সত্য। এ ব্যাপারে জড়িতদের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে।’

পাঠকের মতামত: