ঢাকা,শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪

পর্যটন ব্যবসার জোয়ারে উধাঁও সেন্টমার্টিন দ্বীপের লাল পেঁয়াজ

বিশেষ প্রতিবেদক :: ঈদুল আজহার কোরবানির মাংসের সঙ্গে রান্নার জন্য কক্সবাজারের টেকনাফ-উখিয়ার মানুষ একসময় সেন্টমার্টিনের লাল পেঁয়াজ মজুত করে রাখতেন। আঁটিতে বাঁধা ছোট আকৃতির এই পেঁয়াজের দামও এখন অনেক, প্রতি কেজি ২০০ থেকে ৩০০ টাকা।

ফলে টেকনাফ-উখিয়ার মানুষ দূরের কথা, সেন্টমার্টিন দ্বীপের মানুষও লাল পেঁয়াজ খেতে পারছেন না। তাহলে এই লাল পেঁয়াজ কোথায় হারিয়ে গেল।

সেন্টমার্টিন দ্বীপের স্থানীয় লোকজন বলছেন, দ্বীপের যত্রতত্র অপরিকল্পিতভাবে হোটেল–মোটেলসহ নানা অবকাঠামো তৈরি হয়েছে। ফলে কমেছে চাষের জমি, সঙ্গে লাল পেঁয়াজের আবাদও।

সেন্টমার্টিন ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সাবেক চেয়ারম্যান ফিরোজ আহমদ খান বলেন, ৭ বর্গকিলোমিটারের এই দ্বীপে চাষের জমি ছিল ৮৬১ একর। এর মধ্যে প্রায় ৫০০ একরে ধান, ৯০ একরে তরমুজ, মরিচ, টমেটো এবং ১০ একরে লাল পেঁয়াজের চাষ হতো।

গত দুই দশকে চাষের ৫৬০ একর জমি বিক্রি হয়েছে। সেসব জমিতে গড়ে উঠেছে ১৪০টির বেশি হোটেল–রিসোর্ট। গত মৌসুমে ধানসহ শীতকালীন সবজির চাষ কমেছে ৭০ শতাংশ। লাল পেঁয়াজের চাষ হয়েছিল মাত্র ২০ শতক জমিতে।

ফিরোজ আহমদ বলেন, ১০ বছর আগে সেন্টমার্টিনে লাল পেঁয়াজ বিক্রি হতো প্রতি কেজি ৩০ টাকায়। দ্বীপের মানুষ টেকনাফ, উখিয়া, কক্সবাজারসহ দেশের কোথাও গেলে হাতে করে উপহার হিসেবে লাল পেঁয়াজ নিয়ে যেতেন।

আবার কেউ সেন্টমার্টিন ভ্রমণে গেলে তাঁরাও হাতে করে কয়েক কেজি লাল পেঁয়াজ কিনে ফিরতেন। এখন দ্বীপের কোথাও লাল পেঁয়াজ নেই। ৫০০ টাকা দিয়েও এক কেজি লাল পেঁয়াজ পাওয়া মুশকিল।

দেশের বিভিন্ন এলাকার উৎপাদিত পেঁয়াজের তুলনায় সেন্টমার্টিনের লাল পেঁয়াজের স্বাদ ও ঝাঁজ বেশি। ইন্দোনেশিয়ায় লাল পেঁয়াজের চাষ বেশি হয়।

দ্বীপের অধিবাসীরা জানান, তিন বছর আগেও মাঝরপাড়া, দক্ষিণপাড়ায় দেড় একর জমিতে লাল পেঁয়াজের চাষ হয়েছে। পেঁয়াজ চাষের জমিতে এখন তৈরি হয়েছে একাধিক কটেজ।

একটি কটেজের মালিক নাজমুল করিম বলেন, পর্যটকের উপচে পড়া ভিড়ে দ্বীপের জায়গা–জমির দাম অনেকে বেড়েছে। পেঁয়াজ চাষে লাভ নেই, তাই চাষের জমিতে রেস্তোরাঁ বানিয়ে পর্যটন মৌসুমে ব্যবসা হচ্ছে।

দুই বছর আগে মাঝরপাড়ায় পেঁয়াজের চাষ করতেন হাফেজ আহমদ, পূর্বপাড়ার জামাল হোসেন ও নুর আহমদ। এখন তাঁরা বেকার।

নুর আহমদ বলেন, অন্যের জমি ভাড়া নিয়ে তাঁরা পেঁয়াজ চাষ করতেন। ওই জমিতে এখন ঘরবাড়ি-দোকানপাট হয়েছে। ফলে লাল পেঁয়াজের চাষও বন্ধ। সেন্টমার্টিন ছাড়া লাল পেঁয়াজের চাষ দেশের অন্য কোথাও হয় কি না, সন্দেহ আছে।

নুর আহমদ বলেন, ইন্দোনেশিয়ায় লাল পেঁয়াজের চাষ বেশি হয়। দেশের বিভিন্ন এলাকার উৎপাদিত পেঁয়াজের তুলনায় সেন্টমার্টিনের লাল পেঁয়াজের স্বাদ ও ঝাঁজ বেশি। কিন্তু অপরিকল্পিতভাবে পর্যটন বিকাশের বিপরীতে ঐতিহ্যবাহী পেঁয়াজটির বিলুপ্তি ঘটছে।

ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য নজির হোসেন বলেন, গত মৌসুমে ( ফেব্রুয়ারি- মার্চে) তাঁর ওয়ার্ডের দক্ষিণপাড়ার ওসমান গণী নামে এক কৃষক ২০ শতক জমিতে লাল পেঁয়াজের চাষ করেছিলেন। কিন্তু পরিচর্যার অভাবে ফলন তেমন হয়নি। দ্বীপের মধ্যভাগে (মাঝরপাড়ায়) লাল পেঁয়াজের ফলন ভালো হয়।

মাঝরপাড়ার মোহাম্মদ সালেহ সর্বশেষ ২০১৯ সালে ১৫ শতক জমিতে পেঁয়াজের চাষ করেছিলেন। এখন করেন না।

দ্বীপের অন্য কোথাও লাল পেঁয়াজ চাষের জমিও চোখে পড়ে না জানিয়ে মোহাম্মদ সালেহ বলেন, এবারের কোরবানের ঈদে লাল পেঁয়াজ দিয়ে দ্বীপের কেউ মাংস রান্না করতে পারেননি। লাল পেঁয়াজের জায়গা দখল করেছে দেশের উত্তরবঙ্গ এবং ভারত থেকে আনা বড় পেঁয়াজ।

সেন্টমার্টিন ইউপির বর্তমান চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান বলেন, পেঁয়াজচাষিদের অনেকেই পেশা বদলে ব্যাটারিচালিত ইজিবাইক (টমটম) চালাচ্ছেন। কেউ পর্যটন ব্যবসা শুরু করেছেন। লাল পেঁয়াজ চাষে উৎসাহিত করতে এবং দ্বীপের যত্রতত্র হোটেল–মোটেলসহ অবকাঠামো নির্মাণ বন্ধে কঠোর অবস্থানে আছে প্রশাসন। সূত্র : আব্দুল কুদ্দুস রানা, প্রথম আলো

পাঠকের মতামত: