আয়ুবুল ইসলাম, কক্সবাজার ::
আট বছরের শিশু নুসরাত প্রতিদিন ঘুম থেকে ওঠে কোরআন তেলাওয়াত শুনে। আর তা শুনতে শুনতে সে এখন নিজেই কোরআন তেলাওয়াত শিখে গেছে।হাত-মুখ ধুয়ে খাওয়া-দাওয়া করে বই নিয়ে বসে লেখাপড়ায়। এরপর পাঠশালায় যায়। শিক্ষকের সঙ্গে দুই ঘণ্টা পড়ালেখা করে মায়ের কাছে ফেরে। মায়ের আদরে দুপুরের গোসল খাওয়া-দাওয়া শেষে বিশ্রাম নেয়। বিকালে খেলতে ছুটে যায় শিশুপার্কে। প্রতিদিন শিশুপার্কে বিনোদন করে আনন্দ পায়। আর খুশি মনে মায়ের কাছে ফিরে আসে। সন্ধ্যায় আবার পড়ালেখা করে। খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে।এভাবে প্রতিদিন সুন্দর একটি দিন কাটে তার। তার মতো মো. আলী, জোহাব, মো. আনাছ, জাফর, রফিক সবাই আনন্দ আর শিখনের মাধ্যমে বড় হচ্ছে। তারা কখন ঘুম ভাঙবে এই আশায় ঘুমায়। কারণ ঘুম ভাঙলেই তারা আনন্দ বিনোদনে মেতে উঠতে পারে, শিখতে পারে, পড়তে পারে, খেলতে পারে, মায়ের স্নেহ-আদরে নিজেকে লুকিয়ে রাখতে পারে। বাংলাদেশে একমাত্র দৃষ্টিনন্দন কারা
শিশুপার্ক কক্সবাজারে এমন পরিবেশ দেখা যায়। এমন সুশৃঙ্খল আর নিয়মানুবর্তিতা আনন্দে শিক্ষা গ্রহণের মাধ্যমে কারাগারে শিশুরা বেড়ে উঠছে। যা কারাগারের বাইরের অনেক শিশু এমন সুন্দর জীবনযাপনের মধ্য দিয়ে বেড়ে ওঠার সুযোগ পাচ্ছে না। মহিলা জেলহাজতি নুর বেগম জানান, ‘প্রথমে মনে করেছিলাম আমার বন্দী জীবনের সঙ্গে আমার দুই সন্তান রফিক ও আনাছের জীবনও বন্দীদশায় কাটবে। একজন শিশুর বড় হওয়ার যে অধিকার তা থেকে বঞ্চিত হবে। কিন্তু সে ধারণা পাল্টে দিয়েছে কারা কর্তৃপক্ষ। লেখাপড়ার পাশাপাশি বিনোদনের যে ব্যবস্থা রয়েছে এতে আমার সন্তানের সময় কাটে অনেক আনন্দে। এ জন্য আমি অনেক খুশি। ’
হাজতি মহিলা সেতারা বেগম ও তসলিমা আক্তার জানান, ‘জেল সুপার থেকে শুরু করে কারারক্ষীসহ কারাগারের সব কর্মকর্তা-কর্মচারী শিশুদের অনেক আদর করে। তারা নিজেদের পরিবারের সদস্যদের মতো শিশুদের আদর করে। আর কারাগারের এসব শিশুও তাদের পরিবারের সদস্যদের ভুলে গিয়ে কারা কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আপন করে নিয়েছে। শুধু তাই নয়, কারাগারের অন্য হাজতিরাও এসব শিশুকে অনেক আদর করে। পরিবারের মমতায় শিশুরা দিনযাপন করছে। ’ কক্সবাজার কারাগারের জেলার শাহাদাত হোসেন জানান, কারাগারে বিশেষ দিনে অত্যন্ত উৎসব আমেজ আনন্দে কাটায় শিশুরা। বিশেষ করে ধর্মীয় উৎসব, বিজয় দিবস, স্বাধীনতা দিবস, জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন ও জাতীয় শিশু দিবসসহ অন্যান্য দিনে। এ দিনগুলোতে ভালো খাবার, খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক চর্চা, ভালো পোশাক, বেলুনসহ নানা খেলনা নিয়ে আনন্দে মেতে ওঠে শিশুরা। ডেপুটি জেলার অর্পণ চৌধুরী জানান, কারাগারে মহিলা হাজতির শিশুসন্তান রয়েছে ৩৩ জন। তাদের মধ্যে ১৪ জন ছেলে ও ১৭ জন মেয়েশিশু রয়েছে। এসব শিশুকে এমন করে রাখা হয়েছে তাদের মনে কোনোভাবে যাতে নেতিবাচক প্রভাব না পড়ে। তারা যেন বুঝতে না পারে তারা বন্দী জীবনযাপন করছে। কক্সবাজার কেন্দ্রীয় কারাগারের জেল সুপার বজলুল করিম আখন্দ বলেন, বিভিন্ন অপরাধের মামলায় সাজাপ্রাপ্ত মহিলা আসামিদের সঙ্গে থাকা শিশু-কিশোরদের বিনোদন, মানসিক প্রশান্তি, মেধা ও মননশীলতার বিকাশে কক্সবাজার কেন্দ্রীয় কারাগারের অভ্যন্তরে মনোরম পরিবেশে বানানো হয়েছে দৃষ্টিনন্দন কারা শিশুপার্ক। যা দেশের প্রথম ও একমাত্র কারা শিশুপার্ক। সাজাপ্রাপ্ত মহিলা আসামিদের শিশু সন্তানদের যেন বন্দীদশার রেশ না লাগে সে জন্য বিনোদন ব্যবস্থার মানসে বানানো হয়েছে কারা শিশুপার্ক। কারা কর্তৃপক্ষের এমন উদ্যোগ মানবতার স্বার্থে ও সময়ের প্রয়োজনে একটি মাইলফলক হয়ে থাকবে বলে জানিয়ে কক্সবাজার সুরক্ষা আন্দোলনের সভাপতি অ্যাডভোকেট আয়াছুর রহমান বলেন, কক্সবাজারের এই কারা শিশুপার্কটি দেশের মডেল। এভাবে দেশের অন্য কারাগারেও শিশুপার্ক করা হলে শিশু অধিকার বাস্তবায়নসহ মানবাধিকার সংরক্ষিত হবে।
পাঠকের মতামত: