তোফায়েল আহমদ, কক্সবাজার ::
গত ৬ বছরে কক্সবাজার জেলা পুলিশের ৯ সদস্যের বিরুদ্ধে দায়ের করা ইয়াবা সংক্রান্ত অপরাধের ৩টি মামলার একটিও এখনো নিষ্পত্তি হয়নি। এমনকি টেকনাফ সীমান্তের একজন কম্বল ব্যবসায়ীকে ‘ক্রস ফায়ার’ দেওয়ার ভয় দেখিয়ে ডিবি পুলিশের ৭ সদস্যের আদায় করা ১৭ লাখ টাকার চাঞ্চল্যকর মামলাটির সাক্ষ্য পর্যন্ত শুরু হয়নি গত ৪ বছরেও।
গেল বছরের ৩১ জুলাই মেরিন ড্রাইভ সড়কে পুলিশের গুলিতে সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা নিহতের ঘটনার আগেই পুলিশের বিরুদ্ধে এ তিনটি মামলা রুজু হয়েছিল। ইয়াবা নিয়ে হাতেনাতে ধরা পড়া সহ ‘ক্রস ফায়ারের’ ভয় দেখিয়ে দায়ের করা মামলাগুলোর সকল আসামিই ইতিমধ্যে জামিনে বেরিয়ে গেছেন। কক্সবাজারে পুলিশের একের পর এক অপরাধজনক ঘটনার বিলম্বিত বিচার কার্যক্রমের মধ্যেই গত সোমবার এক নারীকে পিস্তল ঠেকিয়ে ৩ লাখ টাকা ছিনতাইয়ের ঘটনাটিও চাঞ্চল্যের মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছে।
জানা গেছে, মেজর সিনহা হত্যার আগে দেশব্যাপী পুলিশের চাঞ্চল্যকর যে ঘটনাটি ছিল সেটি হচ্ছে একের পর এক ‘গ্রেপ্তার বাণিজ্য ও ক্রস ফায়ারে’র ভয় দেখিয়ে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়ার ধারাবাহিকতায় শেষ পর্যন্ত সেনা সদস্যদের হাতে ধরা পড়া কক্সবাজার জেলা গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের ৭ সদস্যের বিষয়টি। সেনা সদস্যরাই তাদের নিকট থেকে নগদ ১৭ লাখ টাকার বস্তা উদ্ধার করেছিলেন। টেকনাফ সীমান্তের একজন কম্বল ব্যবসায়ীকে আটকের পর ‘ক্রস ফায়ার’ দেওয়ার ভয় দেখিয়ে ডিবি পুলিশ উক্ত অংকের টাকা আদায় করে কক্সবাজার শহরে ফিরছিলেন।
২০১৭ সালের ২৪ অক্টোবর ভোর রাতে কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ সড়কের লেঙ্গুরবিল এলাকায় স্থাপিত সেনাবাহিনীর অস্থায়ী ক্যাম্পে ডিবি পুলিশের সদস্যদের আটক করা হয়েছিল। সেদিন সেনা সদস্যরা যখন ডিবি পুলিশের মাইক্রোবাসটি চ্যালেঞ্জ করেন তখন দীর্ঘক্ষণ ধরে মাইক্রোর আরোহী ডিবি সদস্যরা চুপচাপ বসেছিলেন। তারা গাড়ির কাঁচ খুলতেও অপারগতা প্রকাশ করেছিলেন। অতঃপর সেনা সদস্যরা গাড়ির কাঁচ ভেঙ্গে টাকা ভর্ত্তি থলি উদ্ধার করতে বাধ্য হন।
টেকনাফ সীমান্তে তখন রোহিঙ্গা ইস্যুতে কর্তব্যরত সেনাবাহিনীর দায়িত্বপ্রাপ্ত মেজর নাজিম আহমদের নেতৃত্বে সেনা সদস্যরা ১৭ লাখ টাকার বস্তাসহ ডিবি পুলিশের ৭ সদস্যকে আটক করা হয়েছিল। পরের দিন তদানীন্তন পুলিশ সুপার ড. ইকবাল হোসেন কঠোর শাস্তিমূলক বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ার অঙ্গীকারে সেনাবাহিনীর নিকট আটক অবস্থা থেকে তাদের ছাড়িয়ে এনেছিলেন। টাকাসহ ধরা পড়া কক্সবাজার ডিবি পুলিশের সাময়িক বরখাস্ত হওয়া ৭ সদস্য হচ্ছেন- যথাক্রমে উপ পরিদর্শক মনিরুজ্জামান ও আবুল কালাম আজাদ, সহকারী উপ পরিদর্শক মোহাম্মদ ফিরোজ, গোলাম মোস্তফা ও আলাউদ্দিন এবং দুই কনস্টেবল আল আমিন ও মোস্তফা আজম। তখন সীমান্ত জনপদে ডিবি পুলিশসহ টেকনাফ, উখিয়া ও রামু থানা পুলিশের কতিপয় সদস্যের অব্যাহত ‘চাঁদাবাজি’র ঘটনার ভুরি ভুরি অভিযোগ ছিল। এমন ঘটনায় এলাকাবাসী ছিল ক্ষুব্ধ। ‘চাঁদাবাজ চক্রের’ একের পর এক ঘটনার মধ্যে ডিবি পুলিশের সদস্যদের হাতেনাতে ধরে ফেলায় হয়রানি ও নির্যাতনের শিকার লোকজনের পক্ষে সেসময় সেনাবাহিনী সদস্যদের প্রতি সন্তোষ প্রকাশ করা হয়েছিল।
টেকনাফের দক্ষিন জালিয়া পাড়ার বাসিন্দা এবং টেকনাফ পৌরসভার ৮ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলার মনিরুজ্জামানের ছোট ভাই আবদুল গফুর একজন কম্বল ব্যবসায়ী। তিনি ২০১৭ সালের ২৪ অক্টোবর কক্সবাজার শহরে আয়কর দিতে এসেই পড়েছিলেন ডিবি পুলিশের হাতে। ব্যবসায়ী গফুরকে ধরে ডিবি পুলিশের অফিসে নিয়ে যাওয়া হয়। পুলিশ তার চোখ বেঁধে টাকা আদায়ের জন্য বেধড়ক পিটাতে থাকে। এক পর্যায়ে ডিবি পুলিশের দল তাকে ধরে হুন্ডি ও ইয়াবা কারবারি হিসাবে অভিযুক্ত করে দাবি করেন এক কোটি টাকা। এ বিষয়ে টেকনাফ থানায় পরের দিন ২৫ অক্টোবর দায়ের করা মামলায় কম্বল ব্যবসায়ী আবদুল গফুর আরো উল্লেখ করেন যে, ডিবি পুলিশের দলটি টাকার জন্য তার ভাই কাউন্সিলার মনিরের সঙ্গে যোগাযোগ করে এক পর্যায়ে ৫০ লাখে নেমে আসেন। ভাইকে রক্ষার জন্য কাউন্সিলার মনির ডিবিকে নগদ ৩ লাখ টাকা দিতে সন্মত হন। কিন্তু নাছোড়া বান্দা ডিবি সদস্যরা। ডিবি পুলিশের চাহিদা মাফিক টাকা না দেওয়ায় রাতে চোখ বেঁধে তার ভাইকে ‘ক্রস ফায়ারে’ দেওয়ার কথা বলে টেকনাফ সীমান্তের দিকে রওয়ানা হয়। এক পর্যায়ে ব্যবসায়ী গফুরকে এক বিশাল গর্তে নিয়ে যাওয়া হয়। সেই গর্তটিকেই তাকে দেখানো হয় ‘মৃত্যুকূপ’ হিসাবে। মৃত্যুকূপে নিয়ে তাকে (গফুর) বলা হয়-‘টাকা নাকি জান একবার ভেবে দেখ।’ টাকা না দিলে এই মৃত্যুকূপই হবে শেষ নিশানা।
মৃত্যুকূপের ভয়ে এক পর্যায়ে গফুর রাজি হয় টাকা দিতে। তারপর কাউন্সিলার ভাই নগদ ১৭ লাখ টাকা ভর্তি বস্তা টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ সড়কের লেঙ্গুরবিল এলাকায় ডিবির মাইক্রোবাসে দেওয়া হয়। ডিবি তখন তার ভাই গফুরকে ছেড়ে দেয়। এরপর কাউন্সিলার মনিরুজ্জামান মেরিন ড্রাইভ সড়কের লেঙ্গুরবিলে অস্থায়ী সেনা ক্যাম্পে গিয়ে এ খবর জানান। সেনা সদস্যরা তখনই গাড়িটিকে চ্যালেঞ্জপূর্বক আটক করেন।
সেই ঘটনার পর থেকেই মামলাটি বিচারাধীন রয়েছে। কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতে গতকাল মামলাটির নথিদৃষ্টে দেখা গেছে, গত ১৭ জানুয়ারি মামলাটির ধার্য দিন ছিল সাক্ষির জন্য। এদিন জামিনপ্রাপ্ত ৭ জন পুলিশ সদস্য যথারীতি আদালতে হাজির ছিলেন। পাবলিক প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট ফরিদুল আলম জানিয়েছেন-‘ মামলার সাক্ষি অনুপস্থিত থাকায় আমি রাষ্ট্রের পক্ষে সময় নিয়েছি। আগামীতে সাক্ষিদের সাক্ষ্য দিতে হাজির করার ব্যবস্থা করা হচ্ছে।’
অপরদিকে রামু থানার পুলিশের টহলদলের গাড়িতে অভিযান চালিয়ে ২০১৮ সালের ১৬ অক্টোবর র্যাব-৭ এর একটি দল ১৮ হাজার পিচ ইয়াবা ও পুলিশের পোশাক, হ্যান্ডকাপ, জ্যাকেটসহ তিনজনকে আটক করেছিলেন। তাদের সঙ্গে আটক হওয়া ব্যক্তিদের একজন রামু থানার কনস্টেবল ইকবাল হোসেন (কনস্টেবল নং-৬৪৬)। এ ঘটনার মামলাটিও বিচারাধীন রয়েছে। এর আগে ২০১৫ সালে কক্সবাজারের চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের দায়িত্বরত (গানম্যান) কনস্টেবল সাদ্দাম হোসেনকে পুলিশ বিপুল পরিমাণের ইয়াবার চালানসহ আটক করেছিল। সেই ঘটনার মামলাও এখনো নিষ্পত্তি হয়নি।
পাঠকের মতামত: