ঢাকা,রোববার, ১৭ নভেম্বর ২০২৪

ঠেকানো যাচ্ছে না ইয়াবা,১১ পয়েন্ট দিয়ে ঢুকছে চালান * সিন্ডিকেট পাচ্ছে হাজার কোটি টাকা

ফরিদুল মোস্তফা খান, কক্সবাজার :::

yaba,দেশে মাদকসেবীর সংখ্যা ৫০ লাখ। এর মধ্যে প্রায় ৫০ ভাগ অর্থাৎ ২৫ লাখ মানুষ ক্রেজি ড্রাগ ইয়াবায় আসক্ত। একজন মাদকসেবী দিনে যদি সর্বনিম্ন দুটি করেও সেবন করেন, তাহলে ২৫ লাখ মাদকাসক্ত প্রতিদিন সাবাড় করছে ৫০ লাখ পিস ইয়াবা। আর এই ৫০ লাখ পিস ইয়াবার পেছনে খরচ করছেন তারা পৌনে দুইশ’ কোটি টাকা। মরণনেশা ইয়াবার একদিনের চাহিদার এমন আশঙ্কাজনক তথ্য খোদ মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের।

সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের মতে, সর্বনিম্ন ব্যবহারের হিসাবে এই বিপুল পরিমাণ ইয়াবার চাহিদার তথ্য পাওয়া গেলেও প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি। হু হু করে ইয়াবাসেবীর সংখ্যা বেড়েই চলেছে। আর এই ইয়াবা প্রতিদিনই আসছে অবৈধ পথে পাশের দেশ মিয়ানমার থেকে। দেশের এক প্রান্ত টেকনাফের স্থল ও সাগরপথের ১১ পয়েন্ট দিয়ে দিনে-রাতে ঢুকছে ইয়াবার চালান। আর এই ইয়াবা বিভিন্ন উপায়ে ছড়িয়ে পড়ছে দেশের আরেক মাথা তেঁতুলিয়া পর্যন্ত। রাজধানীসহ সারা দেশের গ্রামগঞ্জে এখন ইয়াবার ব্যবসা জমজমাট। ইয়াবার সর্বনাশা থাবায় লাখো পরিবারের সন্তানদের জীবন এখন বিপন্ন। প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম ধ্বংস করে মাদক ব্যবসার এই সিন্ডিকেট হাতিয়ে নিচ্ছে হাজার কোটি টাকা। সংশ্লিষ্টরা বলছে, ইয়াবার প্রবেশ রোধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অতীতের চেয়ে এখন বেশি তৎপর। এর পরেও ঠেকানো যাচ্ছে না ভয়ঙ্কর এই মাদকের অনুপ্রবেশ।

বিভিন্ন সূত্র মতে, লাভজনক ব্যবসায় পরিণত হয়েছে এই ইয়াবা ব্যবসা। মিয়ানমারের ৬০ টাকার এই ট্যাবলেট পাচার হয়ে এসে রাজধানী ঢাকায় বিক্রি হচ্ছে ৩০০-৪০০ টাকা। আর এ কারণে পেশা পরিবর্তন করে মাদক ব্যবসায় ঝুঁকছে মানুষ। আর সুযোগে সিন্ডিকেট হাতিয়ে নিচ্ছে হাজার কোটি টাকা। দীর্ঘদিন টেকনাফে চাকরি করেছেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এমন একজন কর্মকর্তা জানান, টেকনাফের সীমান্তবর্তী এলাকার মাদক পাচারের পয়েন্টগুলোতে সর্বোচ্চ নজরদারি থাকলেও নানা কৌশলে ইয়াবার চালান আসছেই। মাছধরার ট্রলারে, জালে বেঁধে সাগরে ভাসতে ভাসতে ইয়াবার চালান আসছে দেশের ভিতর। হালে টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া পর্যন্ত দেশের সর্বত্র মহামারী রূপে ছড়িয়ে পড়েছে নীরব এই ঘাতক। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের এক কর্মকর্তা বলেন, দেশে এই মাদকের চাহিদা বেড়েই চলেছে। হালে দিনে চাহিদা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫০ লাখ পিসে। এই বিপুলসংখ্যক ইয়াবা প্রতিদিনই বিভিন্ন কৌশলে দেশে ঢুকছে। সেবনকারীরা প্রতি পিস ইয়াবা ৩০০ থেকে ৪০০ টাকায় কিনে ব্যবহার করছে। মাদকসেবীরা ধোঁয়ায় উড়িয়ে দিচ্ছে এই বিপুল অঙ্কের টাকা। জানা গেছে, সমাজের প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গ, রাজনৈতিক নেতা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কতিপয় সদস্যের সমন্বয়ে গঠিত শক্তিশালী সিন্ডিকেট ইয়াবা ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ করছে। আর এ কারণে কোনোভাবেই এর আগ্রাসন রোধ করা যাচ্ছে না। মাদক চিকিত্সার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা বলছেন, এখন চিকিত্সা নিতে আসা মাদকসেবীর বেশির ভাগই ইয়াবায় আসক্ত। জানা যায়, মিয়ানমার থেকে ইয়াবা পাচার ঠেকাতে ২০১৪ সালে ১২ শতাধিক ইয়াবা ব্যবসায়ীর একটি তালিকা করে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর। এর মধ্যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী শীর্ষ ৪০ জনের একটি তালিকা ধরে অভিযান চালায়। কিন্তু  বেশ কয়েকজন প্রভাবশালীর কারণে শেষ পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযান ভেস্তে যায়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে দাখিল করা ৭৬৪ ইয়াবা ব্যবসায়ীর পৃথক আরেকটি গোপন তালিকার শুরুতেও ওইসব প্রভাবশালী ব্যক্তিদের নাম উঠে আসে। কিন্তু তারা সব সময় থাকছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। ২০১৪ সালের মার্চে টেকনাফে ইয়াবা গডফাদার নিধনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিশেষ অভিযান শুরু হওয়ার পর ইয়াবা চোরাচালান অনেকটা কমে যায়। ইয়াবা গডফাদাররা দেশে-বিদেশে পালিয়ে থাকে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে অনেকে মারাও যায়। কিন্তু গত বছর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযান ঢিলেঢালা হওয়ায় গডফাদাররা আবার এলাকায় ফিরে আসে। প্রায় সময় চট্টগ্রাম মহাসড়কে কাভার্ড ভ্যানে, প্রাইভেট কারে, কুরিয়ার সার্ভিসের পরিবহন গাড়িতে, মানুষের জুতার মধ্যে, শরীরের বিভিন্ন অংশে বেঁধে ইয়াবা দেশের বিভিন্ন  স্থানে পাচার করা হচ্ছে। নতুন পদ্ধতি হিসাবে কলার মধ্যে ঢুকিয়ে সেই গিলে খেয়ে পেটের মধ্যে করেও পাচার হচ্ছে মাদক দ্রব্য ইয়াবা। এই পদ্ধতি সাধারণত মহিলা ব্যবসায়ীরাই করে থাকেন।

অরক্ষিত ১১ পয়েন্ট :

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর এক কর্মকর্তা বলেন, সড়কপথে বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কড়াকড়ি বৃদ্ধি পাওয়ায় পাচারকারীরা নৌপথকে নিরাপদ রুট হিসেবে বেছে নিয়েছে। নৌপথে বিভিন্ন মাছ ধরার ট্রলারে করে মাঝি-মাল্লাদের সহায়তায় এসব ইয়াবা পাচার হচ্ছে দেশের বিভিন্ন স্থানে। বেশি টাকার লোভে অনেক মাঝি-মাল্লা মাছ ধরা ছেড়ে ইয়াবার হাতবদলে সহায়তা করছে। নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশ সীমান্তের কাছে মিয়ানমারের ১৫টি স্থানে ৩৭টি ইয়াবা কারখানা রয়েছে। যেখান থেকে সাগর ও সড়কপথে টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ, নয়াপাড়া, সাবরাং, মৌলভীপাড়া, নাজিরপাড়া, জালিয়াপাড়া, নাইট্যংপাড়া, জলিলেরদিয়া, লেদা, আলীখালী, হূলাসহ অন্তত ১১টি পয়েন্ট দিয়ে ইয়াবার চালান বাংলাদেশে প্রবেশ করছে। এসব ইয়াবা তৈরি ও পাচারে আন্তর্জাতিক মাদক ব্যবসায়ী যেমন জড়িত রয়েছে তেমনি বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের গডফাদারও রয়েছে। যারা সীমান্তে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত বিজিবি, কোস্টগার্ড, র্যাব কিংবা পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে ইয়াবা পাচার করে আসছে। এর মাঝেও হাল ছাড়েননি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।

পাঠকের মতামত: