শাহীন মাহমুদ রাসেল :: গত ২৫ আগষ্ট মিয়ানমার সেনাবাহিনী রোহিঙ্গা অধ্যুষিত রাখাইনে অভিযান শুরু করে। সেই থেকে এ পর্যন্ত ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গা এসেছে বাংলাদেশে। তাদের ফিরিয়ে নেয়ার কোনো উদ্যোগ না নিয়ে কার্যত বরং ছলচাতুরিতেই দুই বছর পার করেছে মিয়ানমার।
তিন ধরনের বৈরী চাপের মুখে পড়ে পরিত্রাণের আশায় রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের নামে বিশ্বের সঙ্গে মিয়ানমার ফের আইওয়াশ করে ছলনার আশ্রয় নিতে যাচ্ছে বলে ধারণা করছেন বিশ্লেষকরা। এক, আগামী সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘের সাধারণ সভায় নিরাপত্তা পরিষদের মুখোমুখি হওয়ার কথা রয়েছে দেশটির গণতান্ত্রিক নেত্রী অং সান সু চির। সেখানে স্বাভাবিকভাবেই তাকে উত্তর দিতে হবে, রোহিঙ্গাদের মানবাধিকার সুরক্ষায় এ পর্যন্ত কী পদক্ষেপ নিয়েছেন শান্তিতে নোবেল জয়ী এ নেত্রী। দুই, আগামী ২৫ আগস্ট নিজ বাসভূম থেকে রোহিঙ্গা উচ্ছেদের দুই বছর পুরো হতে যাচ্ছে। ফলে ২২ আগস্ট রোহিঙ্গা ফেরত প্রকল্প স্বল্প মাত্রায় বাস্তবায়ন করতে পারলেও অন্তত মুখ রক্ষার একটা উপায় থাকবে তার। তিন, রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধ তদন্তে এ মুহূর্তে বাংলাদেশে অবস্থা করছে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের একটি শক্তিশালী প্রতিনিধি দল। এসব কারণে এতকাল যা-তা বলে কাটিয়ে এলেও এ মুহূর্তে একটি ত্রিশঙ্কু পরিস্থিতির মধ্যে পড়ে গেছে মিয়ানমার। ফলে বস্তুনিষ্ঠ কোনো পদক্ষেপ না নিয়েও ২২ আগস্ট একটি লোক দেখানো প্রত্যাবাসন আয়োজনে মরিয়া হয়ে উঠেছে মিয়ানমার।
মিয়ানমারের রাখাইন থেকে সেনাবাহিনী লেলিয়ে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা উচ্ছেদ ও তাদের বাংলাদেশ অভিমুখে বিতাড়ন প্রক্রিয়া শুরু হয় ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট। বাংলাদেশের তীব্র প্রতিবাদ এবং বিশ্ব সম্প্রদায়ের প্রবল সমালোচনার মধ্যেও প্রথম থেকেই এ বিষয়ে সেনাভিযানকে পরোক্ষ সমর্থন এবং রোহিঙ্গাদের মানবাধিকারের প্রশ্নে বিস্ময়কর নিষ্ক্রিয়তা দেখিয়ে এসেছেন দেশটির ডি-ফ্যাক্টো নেত্রী অং সান সুচি। এমনকি রোহিঙ্গাসংক্রান্ত প্রশ্নের মুখোমুখি হওয়ার পরিস্থিতি এড়াতে গত দুই বছরে জাতিসংঘের কোনো উদ্যোগ, আন্তর্জাতিক কোনো আয়োজন কিংবা বৈশ্বিক কোনো সম্মেলনে অংশ নেয়া থেকেও বিরত থাকেন তিনি। এই সময়ে কফি আনান কমিশনের সুপারিশ অনুসরণে জাতিসংঘ ও ইইউসহ একাধিক বৈশ্বিক সংস্থা মিয়ানমারকে তাগাদা দিলেও কিছুই করেনি তারা। ফলে পরবর্তীতে এসব সংস্থাসহ যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের মতো ক্ষমতাধর দেশগুলোর বহুবিধ অবরোধ ও নিষেধাজ্ঞার মুখে পড়ে দেশটির আসল ক্ষমতাধর মিয়ানমারের সেনানেতৃত্ব। এবার সেই একঘরে দশা কাটিয়ে ওঠার মানসেই প্রায় একতরফাভাবে ২২ আগস্ট রোহিঙ্গা ফেরতের তারিখ নির্ধারণ করে তারা যাতে অন্তত কথা বলার মতো একটা সুযোগ পায় তারা।
যদিও বিশ্ব সম্প্রদায় ও রোহিঙ্গাদের মৌলিক দাবি, যেমন- নাগরিকত্ব প্রদান ও স্বাধীন চলাফেরার অধিকারসহ অনেকগুলো প্রশ্নের কোনো মীমাংসা এখনো করেনি তারা। ফলে এ উদ্যোগটি শেষ পর্যন্ত বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে কি না তা নিয়ে সংশয়ে রয়েছে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। গত বছরের নভেম্বর মাসেও রোহিঙ্গা ফেরতের প্রথম উদ্যোগটি ভেস্তে গেছে মিয়ানমারের মিথ্যাচার ও নির্লজ্জ একগুঁয়েমির কারণে। ফলে ২২ আগস্ট রোহিঙ্গা ফেরতের উদ্যোগটিকে বিশ্বসভায় মিয়ানমারের মুখ রক্ষার মরিয়া প্রয়াস হিসেবে দেখা ছাড়া অন্যকোনো কিছু হিসেবে দেখার ভিত্তি নেই কোনো।
এদিকে মাঠপর্যায়ে ঘটনাপ্রবাহ বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, ২০১৭ সালের নভেম্বরে বাংলাদেশ-মিয়ানমারের মধ্যে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে চুক্তি সই হলেও এখনো শুরু হয়নি প্রত্যাবাসন। এরমধ্যে ঘটে গেছে নানা ঘটনা। চলেছে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের শীর্ষ পর্যায়ের একাধিক বৈঠক। গঠন করা হয় প্রত্যাবাসন কমিশন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও গত মাসে চীন সফরকালে দেশটির প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন বিষয়ে আলোচনা করে এ ব্যাপারে চীনের সহযোগিতা চান। সম্প্রতি মিয়ানমারের এক কর্মকর্তার বরাত দিয়ে রয়টার্স জানিয়েছে, আগামী ২২ আগস্ট প্রায় সাড়ে তিন হাজার রোহিঙ্গাকে ফেরত নেয়ার দিন ঠিক হয়েছে। এরপরেই নড়েচড়ে বসে রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলো।
গুলি খেয়ে মরব তবু ফিরব না, বলছে রোহিঙ্গারা: রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে প্রস্তুত করা হয়েছে ঘুমধুম সেতু ও টেকনাফের কেরুনতলী। কিন্তু তবুও গতি পাচ্ছে না প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া। এর মূলে অন্তরায় হিসেবে কাজ করছে একটি চক্র। নিজেদের স্বার্থে রোহিঙ্গাদের ভবিষ্যৎ গড়ে দেয়ার স্বপ্ন দেখিয়ে বাংলাদেশে থেকে যাওয়ার আহ্বান করে যাচ্ছেন তারা। সোমবার (১৯ আগস্ট) উখিয়ার বেশ কয়েকটি ক্যাম্প ঘুরে রোহিঙ্গা ও রোহিঙ্গা নেতা (মাঝি) দের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে। সরেজমিন উখিয়ার বালুখালির ৯ ও ১০ নম্বর ক্যাম্প ঘুরে বেশ কয়েকজন রোহিঙ্গার সঙ্গে কথা হয় এ প্রতিবেদকের। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তারা বলেন, আমরা ত্রাণ থেকে শুরু করে বাসস্থান পর্যন্ত এনজিওর মাধ্যমে পাচ্ছি। তারা আমাদের জানিয়েছে, মিয়ানমারে গেলে এভাবেই বন্দি জীবন কাটাতে হবে সারা জীবন। উল্টো মিয়ানমারে না গিয়ে এখানে থেকে গেলে আমাদের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ গড়ে দেয়া হবে। তাই আমরা মিয়ানমারে ফেরত না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। প্রয়োজনে বাংলাদেশে গুলি খেয়ে মারা যাব তবুও মিয়ানমারে আর ফেরত যাব না।
১০ নম্বর ক্যাম্পের এইচ-১১ ব্লুকের রোহিঙ্গা নেতা লালু মাঝি বলেন, আমরা কোন আশায় মিয়ানমারে যাব। এখানেই ভালো আছি। আর যদি মিয়ানমারে যেতেই হয় তাহলে পূর্ণ নাগরিকত্ব দিয়ে স্বাধীনভাবে চলাফেরার সুযোগ করে দিতে হবে। না হলে আমরা কেউ মিয়ানমারে ফিরে যাব না। এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, যাদের তালিকা করা হয়েছে তাদের মধ্যে আমাদের আত্মীয়স্বজন আছে। ওই স্বজনদের সঙ্গে কথা হয়েছে। তারাও যেতে আগ্রহী না। বাকিটা সময় বলে দিবে।
এনজিওর বিরুদ্ধে প্রভাব বিস্তারের অভিযোগ : ৯ নম্বর ক্যাম্পের একাধিক রোহিঙ্গা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ৯ ও ১০ নম্বর ক্যাম্প মূলত আইওএম (দ্য ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন মাইগ্রেশন) নামক একটি সংস্থার কথায় চলে। এ ছাড়াও ডব্লিওএফপি ও ব্র্যাকের প্রভাব রয়েছে চোখে পড়ার মতো। এই সংস্থাগুলো তাদের যা বলবে তারা সেটিই করবেন। অন্য কারা কি বলল সে বিষয়ে তাদের কিছু যায় আসে না। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, উখিয়া ও টেকনাফে মোট ৩২টি রোহিঙ্গা ক্যাম্প রয়েছে। জাতিসংঘের হিসেবে বর্তমানে এসব ক্যাম্পে বসবাস করছে ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গা। আর এদের ভরণপোষণসহ যাবতীয় জিনিসের ব্যবস্থা করে আসছে প্রায় দুশত আন্তর্জাতিক ও স্থানীয় এনজিও। নিজেদের স্বার্থে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে যেতে নিরুৎসায়িত করে আসছে তারা।
একাধিক সূত্রে জানা গেছে, প্রতিটি ক্যাম্পে অর্ধশতাধিক ব্লক রয়েছে। প্রতিটি ব্লকের দায়িত্বে রয়েছে একজন নেতা (মাঝি)। ওই নেতাদের প্রধান আবার তিনজন। যাদের মধ্যে দুজন রোহিঙ্গা। এনজিও কর্মিরা এই নেতাদেরই হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছেন।
পাঠকের মতামত: