ঢাকা,রোববার, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪

ঝিনুক আকৃতির দেশের প্রথম আইকনিক রেল স্টেশনের কাজ শেষ পর্যায়ে

কক্সবাজার প্রতিনিধি :: ঢাকা থেকে সকালে ট্রেনে উঠে দুপুরে কক্সবাজারে নেমে সমুদ্রে ঝাঁপ, ঘোরাঘুরি শেষে রাতের ট্রেনেই ফিরতি যাত্রা–এমন স্বপ্ন আগামী জুনেই বাস্তবে রূপ নেবে বলে আশা জাগছে। জানা গেছে, দোহাজারী-কক্সবাজার রেলপথের কাজের প্রায় ৮৫ শতাংশই শেষ। ঝিনুক আকৃতির দেশের প্রথম আইকনিক রেলস্টেশনের কাজও শেষ পর্যায়ে। চট্টগ্রামের কালুরঘাট সেতু নিয়ে কিছুটা অস্বস্তি আছে। তা সত্ত্বেও উদ্বোধনের প্রস্তুতি চলছে সৈকত ও পর্যটন শহরে ট্রেন পৌঁছানোর।

মঙ্গলবার কক্সবাজার সদর উপজেলার ঝিলংজা ইউনিয়নের চান্দেরপাড়ায় নির্মাণাধীন স্টেশন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, কারও দম

ফেলার সুযোগ নেই। খুট খুট আর বড় যন্ত্রের শব্দে টের পাওয়া যায় বিশাল কর্মযজ্ঞের। স্টেশন ভবনের এক পাশে ঝিনুকের স্টিলের কাজ শেষ। বহুদূর থেকেও নজর কাড়ে ছয়তলা স্টেশন ভবনের মূল কাঠামো। কথা বলে জানা গেল, পাঁচ শতাধিক প্রকৌশলী ও শ্রমিক দিনরাত কাজ করছেন। স্টেশন ভবন ছাড়াও ১৭টি স্থাপনা তৈরি হচ্ছে, যেগুলো ব্যবহার করা হবে রেলওয়ের নানা পরিচালনা ও বাণিজ্যিক কার্যক্রমে।

দোহাজারী-কক্সবাজার রেলওয়ে প্রকল্পের (আইকনিক স্টেশন বিল্ডিং) কনস্ট্রাকশন ম্যানেজার মো. আব্দুল জাবের মিলন বলেন, ‘যেটা সবচেয়ে চ্যালেঞ্জের ছিল, সেই স্টিল ক্যানোপির কাজ ৭৫ শতাংশ শেষ। প্ল্যাটফর্মের কাজও ৭৫ শতাংশ হয়ে গেছে। মূল ভবনের পুরোটাই শেষ। এখন বেশির ভাগ কাজই ফিনিশিংয়ের। তিন মাসের মধ্যেই মূল ভবন ও আশপাশের কাজ শেষ হবে আশা করছি।’

আব্দুল জাবের জানান, ঝিনুক স্টেশন নির্মাণকাজের ৭৫ শতাংশ সামগ্রী বিদেশ থেকে আনতে হয়। ডলার সংকটের কারণে কিছুটা সমস্যা হয়েছে।

সমুদ্রসৈকত থেকে তিন কিলোমিটার দূরে ২৯ একর জমির ওপর সামুদ্রিক ঝিনুকের আদলে নির্মিত হচ্ছে দেশের একমাত্র আইকনিক রেলস্টেশন। ব্যয় হবে ২১৫ কোটি টাকা।

প্রকল্প-সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, কক্সবাজারের আইকনিক রেলওয়ে স্টেশনের সম্পূর্ণ ফ্লোর এরিয়া ১ লাখ ৮৭ হাজার ৩৫ বর্গফুট। সারা বিশ্বের পর্যটকদের কথা মাথায় রেখে এটি নির্মাণ করা হচ্ছে। দৃষ্টিনন্দন অবকাঠামোর পাশাপাশি একজন পর্যটককে যেন ভ্রমণ-সংক্রান্ত কোনো জটিলতায় পড়তে না হয়, বেড়াতে এসে বাড়তি খরচ না করতে হয়, সেসব দিকে লক্ষ রেখেই বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা রাখা হচ্ছে। রেলওয়ে স্টেশনটি নির্মাণের পর পর্যায়ক্রমে প্রতিদিন ৪৬ হাজার যাত্রী কক্সবাজারে যাতায়াত করতে পারবেন।

ট্রেন চলতে পারবে জুন থেকেই : প্রকল্প পরিচালক মফিজুর রহমান বলেন, ‘পুরো প্রকল্পের ৮৫ শতাংশ কাজ শেষ। কালুরঘাট সেতুতে ৩০-৪০ কিলোমিটার গতিতে ট্রেন চলবে। বাকিটা ৮০ কিলোমিটার গতিতেই চলবে। এখন তো ট্রেন চলছে, তবে কক্সবাজার আসার ট্রেনগুলো বড় হবে। ভার নেওয়ার জন্য সেতুকে আরও শক্তিশালী করতে হবে। এ ক্ষেত্রে কিছুটা ঘাটতি থাকলেও জুনের মধ্যে আমরা সব কাজ শেষ করতে পারব। ট্রেন জুন থেকেই চলতে পারবে।’

কিছুটা বিপত্তি কালুরঘাট সেতুতে : তবে কিছুটা বিপত্তি আছে চট্টগ্রামে কালুরঘাট সেতুতে। এই সেতু দিয়ে বর্তমানে যেসব ট্রেন যায়, সেগুলোর এক্সেল লোড ১১ দশমিক ৯৬ টন। কিন্তু রেলওয়ে কক্সবাজারে যে ট্রেন নেওয়ার পরিকল্পনা করেছে, তার ইঞ্জিন ১৫ এক্সেল লোডের। কর্ণফুলী নদীতে নতুন রেলসেতু নির্মাণ করা অনেক সময়সাপেক্ষ হওয়ায় পুরোনো সেতুটি সংস্কার করেই এই পথে ট্রেন চালাতে চায় রেলওয়ে।

জানা যায়, ২০০১ সালে ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করা এই সেতুর ওপর দিয়ে ১৫ এক্সেল লোডের ট্রেন চালানো যায় কি না, তা যাচাই করতে ২০২১ সালে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) দ্বারস্থ হয় রেলওয়ে। বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ও পর্যবেক্ষক দলের প্রধান ড. এ এফ এম সাইফুল আমিনের নেতৃত্বে দলটি প্রথম প্রতিবেদন সম্প্রতি জমা দিয়েছে। আরও দুটি প্রতিবেদন করতে তিন-চার মাস লাগবে। সেই হিসাবে ২০২৪ সালের আগে পুরো গতিতে ঢাকা-কক্সবাজার পথে ট্রেন চালানো সম্ভব হচ্ছে না। প্রতিবেদন পাওয়ার পর বুয়েটের পরামর্শ অনুযায়ী কালুরঘাট সেতুটি সংস্কারের জন্য ঠিকাদার নিয়োগ করতে হবে। এরপর শুরু হবে সংস্কারকাজ। সব মিলিয়ে এক বছরের বেশি সময় লেগে যেতে পারে।

রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের প্রধান প্রকৌশলী আবু জাফর মিঞা বলেন, ‘গত সপ্তাহে বুয়েটের পরামর্শক দলের সঙ্গে বৈঠক করেছি। প্রাথমিক একটি রিপোর্ট তারা দিয়েছে। আরও দুটি রিপোর্ট আগামী তিন মাসের মধ্যে পাব। তারপর সংস্কারের জন্য ঠিকাদার নিয়োগের কাজ করা হবে।’

মোট নয়টি স্টেশন : চট্টগ্রামের দোহাজারী থেকে রামু হয়ে কক্সবাজার পর্যন্ত ১০০ দশমিক ৮৩ কিলোমিটার রেলপথের প্রথম ধাপের নির্মাণকাজ চলছে। এই রেলপথে কক্সবাজার আইকনিক স্টেশনসহ মোট নয়টি স্টেশন হচ্ছে। অন্য স্টেশনগুলো হলো দোহাজারী, সাতকানিয়া, লোহাগাড়া, হারবাং, চকরিয়া, ডুলাহাজারা, ইসলামাবাদ ও রামু।

দোহাজারী-কক্সবাজার রেলপথ প্রকল্পটি ২০১০ সালে একনেকে অনুমোদন পায়। ঠিকাদার নিয়োগের পর ২০১৭ সালে প্রকল্প নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ শুরু করে।

পুরো প্রকল্প বাস্তবায়নে ব্যয় ধরা হয়েছে ১৮ হাজার ৩৪ কোটি ৪৮ লাখ টাকা। এর মধ্যে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ঋণ দিচ্ছে ১৩ হাজার ১১৫ কোটি ৪১ লাখ টাকা। বাকি ৪ হাজার ৯১৯ কোটি ৭ লাখ টাকা সরকারি তহবিল থেকে সরবরাহ করা হবে।

চীনের দুটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না রেলওয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং করপোরেশন (সিআরইসি) ও চায়না সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন করপোরেশন (সিসিইসিসি) এই প্রকল্পে কাজ করছে। এর সঙ্গে যুক্ত বাংলাদেশের তমা কনস্ট্রাকশন কোম্পানি ও ম্যাক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেড।

প্রকল্প পরিচালক বলেন, ‘বিভিন্ন এলাকায় স্থানীয় কিছু লোক নানা দাবি নিয়ে আসছে। কারও দাবি ওভারব্রিজ, কেউ চায় নতুন রাস্তা। এটা নিয়ে কিছু সমস্যা রয়েছে।’

পাঠকের মতামত: